মূসা বিন শমসের পুত্র ববি হাজ্জাজের আসল রহস্য উদঘাটন!
কে এই ববি হাজ্জাজ। আর কিই বা তার মিশন। আর কেনই বা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের বিশেষ উপদেষ্টা হলেন। এ সব বিষয় নিয়ে জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীদের মধ্যেও কৌতূহলের অন্ত নেই। এ বিষয়ে খোঁজ নিতে গিয়ে পাওয়া গেছে অবাক করা অনেক তথ্য।
জানা গেছে, বিতর্কিত ব্যবসায়ী মুসা বিন শমসেরপুত্র এই ববি হাজ্জাজ। ফরিদপুরের নগরকান্দা থানার কাজী কড়িয়াল গ্রামে তার বাড়ি। তার বাবা মুসা মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাদের সহযোগীর ভূমিকা পালন করেন। বিতর্কিত মুসার নির্দিষ্ট কোনো দল নেই, তবে আওয়ামী লীগবিরোধী। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী মানেই তার মিত্র। পিতার আদর্শেই উদ্বুদ্ধ ববি হাজ্জাজও।
যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যেও জাতীয় এবং স্থানীয় সরকার নির্বাচনে রাজনৈতিক ও সামাজিক কৌশল নির্ধারণী পরামর্শক হিসাবে কাজ করেছেন বলে জনশ্রুতি আছে । এছাড়া ববি হাজ্জাজ নিজেও এমন দাবিই করেছেন। এরশাদের উপদেষ্টা হিসেবে তার নিয়োগ পাওয়ার সময় জেপিআরএস-এর বিজ্ঞপ্তিতেও এমন কথাই বলা হয়েছিল। সেখানে আরও বলা হয়েছিল বিদেশে অভিজ্ঞতাকে তিনি জাপার স্বার্থে কাজে লাগাতে চান। জাতীয় পার্টিকে এগিয়ে নিতে রিসার্চ করার সুযোগ চান। এজন্য জাতীয় পার্টির রিসার্চ অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক উইং (জেপিআরএস) প্রতিষ্ঠার ইচ্ছার কথাও জানান এরশাদকে। এভাবে এরশাদের মন জয় করেন ববি।
এরশাদ তাতে সায় দিলে প্রতিষ্ঠা করা হয়(জেপিআরএস)। এরশাদের মালিকানাধীন গুলশান-২ এর ১১৩ নম্বর রোডের ৯ নম্বর বাসায় স্থাপন করা হয় এর কার্যালয়। জানা যায়, এ-খাতে ব্যয়বাবদ প্রতিমাসে নাকি ১৩ লাখ টাকা ব্যক্তিগত তহবিল থেকে দিতেন এরশাদ। কিন্তু এখানে রিসার্চের নামে যা হতো তার বিশ্বাসযোগ্যতা ও উদ্দেশ্যে নিয়ে খোদ দলের নেতাদের মধ্যেও ছিল নানা সংশয়।
ববির এই ‘জাপাপ্রীতি’ নিয়ে সংশয়ে ছিলেন অনেক জাপানেতা। তাদের অনেকেই জানিয়েছেন, ২০০৯ সালে বিপুল ভোটে মহাজোট ক্ষমতাসীন হলে গোপন এজেন্ডা নিয়ে দেশে আসেন ববি হাজ্জাজ।
জাপার একাধিক নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সিনিয়র নেতা জানিয়েছেন, ববির প্রধান এজেন্ডা ছিল, এরশাদের মনে বিষ ঢুকিয়ে দিয়ে মহাজোটে ভাঙ্গন ধরানো। এজন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছেন ববি। এতে অনেকখানি সফলও হয়েছেন।
জনশ্রুতি আছে, ববির পরামর্শেই নাকি গত সংসদ নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান এরশাদ এবং নির্বাচনে না যেতে অনড় অবস্থান নেন ।
এরশাদ সিএমএইচ’এ ভর্তি হলে ববিকে করা হয়েছিল তার মুখপাত্র। এতেই বিষয়টি দিবালোকের মতো পরিষ্কার বলে জানিয়েছেন জাপার একাধিক সিনিয়র নেতা।
জাপা নেতারা জানিয়েছেন, তার বিভিন্ন কর্মকান্ড ও ‘গবেষণা’ পর্যালোচনা করলে তার উদ্দেশ্য বোঝা যাবে। তারা দাবি করেছেন, ববি হাজ্জাজ ২০১৩ সালে একটি জরিপ প্রকাশ করেন। তাতে ১৩টি প্রশ্ন ও একটি মন্তব্যের ঘর রাখা হয়। প্রশ্নেগুলোতে টিক চিহ্ন দেওয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়।
এক পাতার ‘ঢাকা ওপিনিয়ন সার্ভে-২০১৩’ নামে ওই জরিপে প্রথম প্রশ্ন ছিল, সার্বিকভাবে দেশ কোন দিকে যাচ্ছে বলে আপনি মনে করছেন।
দ্বিতীয় প্রশ্ন ছিল আপনার মতে বিএনপি নির্বাচনে না এলে নির্বাচন গ্রহনযোগ্য হবে কি?
তিন নম্বের প্রশ্ন ছিল, রাজনৈতিক দলগুলো যদি সমঝোতায় না আসতে পারে এবং সেনাবাহিনী যদি ক্ষমতায় আসে তাহলে সেটি কি আপনার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে? এর হ্যাঁ-সূচক জবাব দেখানো হয়েছে জরিপের ফলাফলে। এখানে বিদেশিদের বোঝাতে চেয়েছেন বাংলাদেশের মানুষ সেনাশাসন সমর্থন করে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এই দেশের মানুষ কোনোভাবেই সেনাশাসন চায় না।
ইচ্ছা করেই জয় ও তারেক প্রসঙ্গ আনা হয়েছে। এখানে তারেককে জনপ্রিয় এবং ভবিষ্যত নেতা হিসেবে দেখানো হয়েছে। এতে প্রথমেই প্রশ্ন ছিল: দেশের ভবিষ্যত নেতা হিসেবে তারেক রহমানকে কিভাবে দেখেন? এখানে দেখানো হয় খুবই যোগ্য হিসেবে।
আর একই প্রশ্নে জয়ের ক্ষেত্রে উত্তর দেওয়া হয়েছে, যোগ্য। এরপরের প্রশ্ন ছিল দেশের ভবিষ্যৎ নেতা হিসেবে তারেক না-কি জয়কে সমর্থন করেন?
এখানেও তারেক রহমানকে উপরে তোলা হয়।
এর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল এরশাদকে বোঝানো যে, আওয়ামী লীগের চেয়ে বিএনপি অনেক বেশি জনপ্রিয়। তাই মহাজোট ছাড়া সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
জরিপের ফল সাংবাদিক সম্মেলন করে বলেছিলেন ববি হাজ্জাজ। কিন্তু সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জরিপের কোনো প্রমাণই পাওয়া যায় নি। মূলত ঘরে বসেই এসব সার্ভে করা হয়েছে। হাতে আসা বেশ কয়েকটি ফর্ম যাচাই করে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
আমির মাসুদ নামে একজন তথ্য সংগ্রহকারি তথ্য সংগ্রহ করেছেন। আর মতামত নেওয়া হয়েছে সেলিম নামের একজনের কাছ থেকে। তথ্য ফর্মে সেলিম মিয়ার ঠিকানা ও ফোন নম্বর রয়েছে। সেই ফোনে কল দিলে ফোন রিসিভকারী নিজের নাম সেলিম বলে স্বীকার করলেও তার বাসায় কোনো জরিপকারি যায় নি বলে দাবি করেছেন।
ফরমটিতে সেলিম মিয়ার পেশার স্থলে কৃষিতে টিক চিহ্ন দেওয়া হয়েছে। অথচ বাড্ডা থানার বাসিন্দা সেলিম মিয়া নিজেকে ব্যবসায়ী বলে জানিয়েছেন। অন্য ফর্মগুলোরও একই ধরনের মতামত পাওয়া গেছে।
ববি হাজ্জাজ নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন বলে জানা গেছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে সৃষ্টি হয়েছে আনসারুলাহ বাংলাটিম। যে কারণে ববির চলাফেরা নিয়ে নানা রকম গুঞ্জন রয়েছে।
২০১৩ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি এরশাদের বিশেষ উপদেষ্টা করা হয় ববি হাজ্জাজকে। রিসার্চের পাশাপাশি গত উপজেলা নির্বাচনে প্রধান সমন্বয়ক করা হয় তাকে। ওই নির্বাচনে জাতীয় পার্টির চরম ভরাডুবি হয়। এরশাদের ঘাঁটি বলে পরিচিত রংপুরের সবকটি জেলায় জাপার প্রার্থীরা পরাজিত হন।
সেই থেকে এরশাদ কিছুটা নাখোশ থাকলেও ববিকে হাতছাড়া করতে চান নি। তবে সম্প্রতি এরশাদকে চ্যালেঞ্জ করে নিজেকে ডিসিসি উত্তরের মেয়র প্রার্থী ঘোষণা করলে বেঁকে বসেন এরশাদ। রোববার (২২ মার্চ) এরশাদ তাকে বিশেষ উপদেষ্টার পদ থেকে বহিষ্কার করেন।
ববি হাজ্জাজকে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান শুধুমাত্র বিশেষ উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালনের জন্য নিয়োগ করেছিলেন। এই দায়িত্ব থেকে তাকে অব্যাহতি প্রদান করায়, জাতীয় পার্টির সাথে তার আর কোনো সংশ্লিষ্টতা থাকবে না বলে পার্টি চেয়ারম্যান হিসেবে নির্দেশ দিয়েছেন এরশাদ।
জাতীয় পার্টির মহাসচিব জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু বলেন, তার (ববি) সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করতে চাই না। সে জাতীয় পার্টির কেউ ছিল না। এখনও নাই।
তার উদ্দেশ্য নিয়ে দলের অনেকের মধ্যে অস্বস্তি ছিল বলে জানান জাপা মহাসচিব।
মন্তব্য চালু নেই