মুখ বন্ধ রাখার সময়ে হুমায়ূনই বলেছিলেন ‘তুই রাজাকার’

আজ যখন প্রথম সারির যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি কার্যকর হচ্ছে একের পর এক, তখন শহীদ সন্তান বাংলাদেশের তরুণদের স্বপ্ন, বিশিষ্ট সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ নেই। আজ ১৯ জুলাই। ২০১২ সালের এই দিনে বাংলাদেশ সময় রাত সাড়ে ১১টায় বাংলা সাহিত্যের এই নক্ষত্রের চোখে চির রাত নেমে আসে। একই সঙ্গে মৃত্যু ঘটে বইয়ের পাতার হিমু, রূপা, মিসির আলী বা শুভ্র চরিত্রগুলোর। কিন্তু এরপর বইয়ের পাতা থেকে চরিত্রগুলো মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে যায় আরও তীব্রভাবে। কেননা, হুমায়ূনের এই চরিত্রগুলো আজও তরুণ বয়সের কাছে অনুকরণীয়।

১৯৭৫- এর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর যুদ্ধাপরাধীদের অপরাধ নিশ্চিহ্ন করে ফেলা হয়েছিল। কেউ তাদের দিকে আঙুল তুলে যখন ইতিহাস মনে করিয়ে দিতে পারতেন না, সেই স্বৈরাচার আমলে হুমায়ূন আহমেদ নাটকে তুলে আনেন এক পাখি চরিত্র যাকে বলতে শেখানো হয়- ‘তুই রাজাকার’।

রাজাকারকে বর্তমানে আবারও ঘৃণ্য হিসেবে উপস্থিত করেন সকলের প্রিয় হুমায়ূন আহমেদ। তার সহযোদ্ধারা বলেন, তিরস্কার করে আসল কথাটা বলতে পারার সক্ষমতা ছিল তার। সময়ের সঙ্গে এগিয়ে যাওয়ার অসম্ভব আকাঙ্ক্ষাও ছিল।

হুমায়ূন আহমেদের জন্ম ১৯৪৮ সালের ১৩ নভেম্বর মামাবাড়ি নেত্রকোনার মোহনগঞ্জে।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ -এর মে মাসে এই কথাশিল্পীর বাবা পুলিশ অফিসার ফয়জুর রহমান আহমেদ পাকিস্তানিদের হাতে নিহত হন। শিক্ষক হুমায়ূন আহমেদ এক সময় বুঝতে পারেন, তার আশেপাশে ঘুরে বেড়ানো চরিত্রগুলোকে এক জায়গায় বইয়ের পাতায় নেওয়ার দায়িত্ব তারই। আর এ ভাবনার মধ্য দিয়েই হুমায়ূন দেশের তরুণ-তরুণীকে পাঠ্যপুস্তকের বাইরে বই কেনা এবং বই পড়ায় আগ্রহী করে তোলেন। তার লেখা নিয়ে যত সমালোচনাই থাকুক না কেন, নিজের ভাই সম্পর্কে মূল্যায়নে সবচেয়ে কার্যকর মন্তব্য করেন তার ছোট ভাই অধ্যাপক জাফর ইকবাল, ‘আমার বড় ভাই হুমায়ূন আহমেদ’ লেখায়। যেখানে তিনি বলছেন, হুমায়ূন আহমেদ কি শুধু জনপ্রিয় লেখক, নাকি তার লেখালেখির সাহিত্য মর্যাদাও আছে সেটি বিদগ্ধ মানুষের একটি প্রিয় আলোচনার বিষয়। আমি সেটি নিয়ে কখনও মাথা ঘামাইনি। কারও কাছে মনে হতে পারে দশ প্রজন্মের এক হাজার লোক একটি সাহিত্যকর্ম উপভোগ করলে সেটিই সফল সাহিত্য! আবার কেউ মনে করতেই পারেন তার দশ প্রজন্মের পাঠকের প্রয়োজন নেই, এক প্রজন্মের এক হাজার মানুষ পড়লেই তিনি সফল।

আমি নিজেও যেহেতু অল্প বিস্তর লেখালেখি করি, তাই আমি জানি একজন লেখক কখনও সাহিত্য সমালোচকের মন জয় করার জন্য লেখেন না, তারা লেখেন মনের আনন্দে। যদি পাঠকেরা সেই লেখা গ্রহণ করে সেটি বাড়তি পাওয়া। হুমায়ূন আহমেদের লেখা মানুষ শুধু যে গ্রহণ করেছিল তা নয়, তার লেখা কয়েক প্রজন্মের পাঠক তৈরি করেছিল। বড় বড় সাহিত্য সমালোচকেরা তার লেখাকে আড়ালে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেছে। কিন্তু ঈদসংখ্যার আগে একটি লেখার জন্য তার পেছনে ঘুরঘুর করেছে পত্রিকাগুলো, সেটি আমাদের সবার জন্য একটি বড় কৌতুকের বিষয় ছিল।’

এক জীবনে একজন মানুষ কতটাইবা করতে পারেন? হুমায়ূনের কাজের পরিধি সে প্রশ্নে হোঁচট খাওয়ায়। পাঠক বিবেচনায় হুমায়ূন আহমেদ দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক। উপন্যাসে নিজের বিস্তার ঘটালেও শুরুটা ছিল কবিতা দিয়েই। এর পর নাটক, শিশুসাহিত্য, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী থেকে শুরু করে চলচ্চিত্র পরিচালনা, কোথায় নেই তিনি!

হুমায়ূন আহমেদের লেখা উপন্যাসের সংখ্যা দুই শতাধিক। রচনা ও পরিচালনা করেছেন বহু একক ও ধারবাহিক নাটক। পরিচালনা করেছেন চলচ্চিত্রও। মধ্যবিত্তকে সিনেমা হলে দীর্ঘসময় পর তিনিই ঢুকিয়েছিলেন। তার সর্বশেষ চলচ্চিত্র ‘ঘেটুপুত্র কমলা’র জন্য তিনি লাভ করেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার।

হুমায়ূন আহমেদ দীর্ঘ চার দশকের সাহিত্যজীবনে বহু পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে একুশে পদক (১৯৯৪), বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৮১), হুমায়ূন কাদির স্মৃতি পুরস্কার (১৯৯০), লেখক শিবির পুরস্কার (১৯৭৩), মাইকেল মধুসূদন দত্ত পুরস্কার (১৯৮৭), জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (১৯৯৩ ও ১৯৯৪), বাচসাস পুরস্কার (১৯৮৮) ইত্যাদি।



মন্তব্য চালু নেই