‘মুক্তির লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন’

অসহযোগ আন্দোলনের ১৯তম দিনে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে প্রাক্তন নৌ-সেনাদের এক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশে তারা বঙ্গবন্ধু ঘোষিত মুক্তি সংগ্রামের প্রতি সংহতি প্রকাশ করেন এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে সহযোগিতা করার জন্য একটি সম্মিলিত মুক্তিবাহিনী কমান্ড গঠনের জন্য সশস্ত্র বাহিনীর প্রাক্তন বাঙালী সৈনিকদের প্রতি আহ্বান জানান।

সকালে কঠোর সামরিক প্রহরা পরিবেষ্টিত রমনার প্রেসিডেন্ট ভবনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের মধ্যে চতুর্থ দফা আলোচনা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে বঙ্গবন্ধুর সাথে তার ছয়জন শীর্ষস্থানীয় সহকর্মী উপস্থিত ছিলেন।

প্রায় সোয়া দুই ঘণ্টা আলোচনা শেষে বঙ্গবন্ধু প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে বের হয়ে এসে দেশী-বিদেশী সাংবাদিকদের বলেন, আলোচনায় কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে। তিনি এর বেশী কিছু বলতে অপারগতা জানিয়ে বলেন, সময় এলে অবশ্যই আমি সব কিছু বলব।

মুক্তিপাগল মানুষের দৃপ্ত পদচারণায় রাজধানী টালমাটাল হয়ে ওঠে। মিছিলের পর মিছিল এগিয়ে চলে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। সেখানে শপথ গ্রহণের শেষে একের পর এক শোভাযাত্রা বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে গিয়ে সমবেত হয়। বঙ্গবন্ধু সমবেত জনতার উদ্দেশে একাধিক সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে দৃঢ়তার সাথে বলেন, মুক্তি পাগল সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর চূড়ান্ত বিজয়কে পৃথিবীর কোন শক্তিই রুখতে পারবে না। বাংলাদেশের মানুষের সার্বিক মুক্তি অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত এই আন্দোলন চলবে।

কাউন্সিল মুসলিম লীগ প্রধান মিয়া মমতাজ মোহাম্মদ খান দৌলতানা ও জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামের মহাসচিব মওলানা মুফতি মাহমুদ পৃথক পৃথক বৈঠকে মিলিত হন।

সুপ্রীম কোর্টের প্রখ্যাত আইনজীবী ও আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম কৌঁসুলি এ কে ব্রোহি সকালে করাচী থেকে ঢাকায় আসেন।

রাতে এক বিবৃতিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জনগণের প্রতি শান্তিপূর্ণ ও সুশৃঙ্খলভাবে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, মুক্তির লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত এই আন্দোলন অব্যাহত থাকিবে। বর্তমানের গণ-আন্দোলন প্রতিটি গ্রাম, শহর ও নগরীর নারী-পুরুষ-শিশু নির্বিশেষে সকলকে বাংলাদেশের দাবির পিছনে সুসংগঠিত করিয়াছে। বাংলাদেশের জনসাধারণ সমগ্র বিশ্বের স্বাধীনতাপ্রিয় মানুষের অন্তর জয় করিয়াছে। বাংলাদেশ আজ বিশ্বের দরবারে একটি অনুপ্রেরণাদায়ী দৃষ্টান্ত হিসেবে পরিচালিত এবং ইহা হইতেছে আপন লক্ষ্যে দৃপ্ত পদক্ষেপে অগ্রসরমান দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ও ঐক্যবদ্ধ জনসাধারণের সংগ্রামের দৃষ্টান্ত।

জীবনের সকল স্তরের মানুষ-মাঠের কৃষক, কারখানার শ্রমিক, ব্যাংক, অফিস, বন্দর এবং সরকারি চাকরিতে নিযুক্ত কর্মচারীবৃন্দ- যাহারা আমাদের নির্দেশাবলীর কাঠামোর মধ্যে অর্থনীতিকে রক্ষা করার জন্য নিরলস পরিশ্রম করিয়া যাইতেছেন তাদের সকলের প্রতি আমার অভিনন্দন। এইসব নির্দেশ কার্যকর করার ব্যাপারে ছাত্র, শ্রমিক এবং কর্মচারী সংগঠনগুলোর সজাগ দৃষ্টির জন্য তাহারা বিশেষভাবে অভিনন্দনযোগ্য। আমাদের জনসাধারণ প্রমাণ করিয়াছেন যে, তাহারা তাহাদের নিজেদের বিষয় অত্যন্ত আদর্শ পদ্ধতিতে পরিচালনা করিতে সক্ষম।

স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হিসাবে বাঁচার উদ্দেশ্যে জনসাধারণ সকল প্রকার ত্যাগ স্বীকারে বদ্ধপরিকর। তাই মুক্তির লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন অবশ্যই অব্যাহত থাকিবে। শান্তিপূর্ণ ও সুশৃঙ্খল পদ্ধতিতে জনসাধারণ তাহাদের আন্দোলন চালাইয়া লইয়া যাইবেন, তাহাদের নিকট ইহাই আমার আবেদন। নাশকতামূলক কার্যে লিপ্ত ব্যক্তিদের দুরভিসন্ধিমূলক ও উস্কানির বিরুদ্ধে আমি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করিতেছি। আমাদের জনসাধারণ অবশ্যই অর্থনৈতিক তৎপরতার প্রতিটি ক্ষেত্রে কঠোর শৃঙ্খলা পালন করিয়া যাইবেন, যাহাতে জনসাধারণের অত্যাবশ্যক চাহিদা পূরণের ব্যবস্থা অব্যাহত থাকিতে পারে।

পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো করাচীতে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, তিনি লন্ডন পরিকল্পনা যা ১৯৬৯ সালে লন্ডনে বসে শেখ মুজিব, খান আবদুল ওয়ালী খান ও মিয়া মমতাজ মোহম্মদ খান দৌলতানা কর্তৃক প্রণীত তা মানবেন না। তিনি বলেন, ঐ পরিকল্পনা আওয়ামী লীগ প্রধান ঘোষিত ৬-দফার ভিত্তিতেই করা হয়েছে।

তথ্যসূত্র : মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর



মন্তব্য চালু নেই