মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বহনকারী ঐতিহ্যবাহী হার্ডিঞ্জ ব্রিজের ১০১ বছর

শৈল্পিক কারুকাজের দৃষ্টিনন্দন হার্ডিঞ্জ ব্রিজ শুধু পাবনা বা কুষ্টিয়া নয়, গোটা বাংলাদেশের গৌরব আর অহঙ্কারের প্রতীক হিসেবে আজও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে কালের সাক্ষী হয়ে। পাকশী পদ্মা নদীর ওপর স্থাপিত মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বহনকারী ঐতিহ্যবাহী এই রেলসেতু চালুর আজ ১০১ বছর পূর্ণ হলো।

ব্রিটিশ স্থাপত্যশৈলীর অনন্য নিদর্শন ও এশিয়ার অন্যতম এই রেলওয়ে সেতুর ১০১ বছর পূর্তিতে উদ্বেলিত পাবনাবাসী। সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে যুগ যুগ ধরে ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে চির জাগরুক থাকবে দৃষ্টিনন্দন হার্ডিঞ্জ ব্রিজ-এমন প্রত্যাশা সবার।

4-3-2015-hardinge-bridge

প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, ঈশ্বরদী থেকে ৫ মাইল দক্ষিণে এবং আগের সাঁড়াঘাট স্টেশন থেকে ৩-৪ মাইল পূর্ব-দক্ষিণে পাকশী নামক স্থানে তৎকালীন পাবনা ও নদীয়া জেলার মধ্যে বিস্তৃত পদ্মা নদীর ওপর নির্মিত এই প্রসিদ্ধ রেলসেতুটি পুরোনো কাগজপত্রে ‘লোয়ার গ্যাঞ্জেস ব্রিজ, সাঁড়া’ নামে খ্যাত হলেও পরবর্তীতে তা হার্ডিঞ্জ রেলসেতু হিসেবেই ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করে। তবে ১৯০৮ সালে চূড়ান্তভাবে এই ব্রিজ নির্মাণ প্রকল্পটি অনুমোদিত হওয়ার অন্তত ২০ বছর আগে থেকে এই সেতু নির্মাণের প্রস্তাবনা ও এর সম্ভাব্যতা নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা শুরু করা হয়। অবিভক্ত ভারতের কলকাতার সঙ্গে আসাম এবং ইস্ট বেঙ্গলের যোগাযোগ সহজীকরণের লক্ষ্যে ১৮৮৯ সালে পদ্মা নদীর উপর সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেয় ব্রিটিশ সরকার। দীর্ঘ ২০ বছর আলোচনার পর ১৯০৮ সালে প্রস্তাব গৃহিত হয়। ১৯১০ সালে ২৪ হাজার লোকবল দিয়ে পদ্মা নদীর উপর রেলসেতুর নির্মাণকাজ শুরু করা হয়। আর ৪ কোটি ৭৫ লাখ ৫০ হাজার ভারতীয় রূপি ব্যয়ে সেতুর নির্মাণ শেষ হয় ১৯১৫ সালে। ১ দশমিক ৮১ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে রেলসেতুটির অর্ধেক অংশ পাবনার পাকশী অংশে এবং বাকি অংশ কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা অংশের মধ্যে অবস্থিত। ১৯১৫ সালের ৪ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রীবাহী রেল চালুর মাধ্যমে এ সেতু উদ্বোধন করেন তৎকালীন ভারতের গভর্নর জেনারেল ভাইসরয় লর্ড চার্লস হার্ডিঞ্জ। তার নামেই এ সেতুর নামকরণ করা হয় হার্ডিঞ্জ ব্রিজ। সেতুটি নির্মাণের প্রধান প্রকৌশলী ছিলেন ব্রিটিশ প্রকৌশলী রবার্ট গেইল্স। এই রেলব্রিজের ভারবহন ক্ষমতা ১ হাজার ৯২৭ টন। সেতুটি খুলনা থেকে পার্বতীপুর পর্যন্ত ব্রডগেজ রেলপথকে সংযুক্ত করেছে। শৈল্পিক কারুকার্য খচিত ঐতিহ্যময় হার্ডিঞ্জ ব্রিজ ১০১ বছর ধরে আকৃষ্ট ও মুগ্ধ করে চলেছে পর্যটকদের মন। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় সেতুটির ১২ নম্বর স্প্যানটি মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হলে এগার মাস ট্রেন চলাচল বন্ধ ছিল। পরের বছর ১৯৭২ সালের অক্টোবরে সংস্কারের মাধ্যমে পুনরায় চালু করা হয়।

10703521_994116787280823_7953988382141775846_n

পৃথিবীর দীর্ঘতম রেলসেতুগুলোর একটি হার্ডিঞ্জ ব্রিজ। এই সেতুটিতে রয়েছে মূল ১৫টি স্প্যান, যার প্রতিটির (একটি থেকে অন্যটির) বিয়ারিংদ্বয়ের মধ্যবর্তী দৈর্র্র্ঘ্য ১৪৫ ফুট ১.৫ ইঞ্চি। স্প্যানগুলোর উচ্চতা ৫২ ফুট। প্রতিটি স্প্যানের ওজন ১২৫০ টন। প্রধান ১৫টি স্প্যান ছাড়াও সেতুর উভয় পাশে রয়েছে ৩টি করে অতিরিক্ত ৬টি ল্যান্ডস্প্যান। ল্যান্ডস্প্যানগুলোর প্রতিটির বিয়ারিংদ্বয়ের দৈর্ঘ্য ৭৫ ফুট। নির্মাণশৈলী ও নান্দনিক দৃশ্যপটে চোখজুড়ানো হার্ডিঞ্জ সেতুটি সেই সময়ের বর্ষায় সর্বোচ্চ পানির লেভেল থেকে ৪০ ফুট এবং গ্রীষ্মে সর্বনি¤œ পানিপ্রবাহ থেকে ৭১ ফুট উচ্চতায় নির্মিত হয় এ কারণে, যাতে সেতুর নিচ দিয়ে স্টিমারসহ বড় বড় নৌকা নির্বিঘেœ চলাচল করতে পারে।

কালের পরিক্রমায় হার্ডিঞ্জ ব্রিজ চালুর ১০১ বছর পূর্তি হচ্ছে আজ। এতে আনন্দে উদ্বেলিত স্থানীয় বাসিন্দাসহ পাবনাবাসী। পাকশী এলাকার প্রবীণ শিক্ষক রেজাউল আলম মিন্টু বলেন, ‘হার্ডিঞ্জ সেতুর ১০১ বছর পূর্ণ হচ্ছে, এতে আমরা খুবই আনন্দিত। আমরা চাই আরও শত শত বছর এই সেতু থাকুক এবং সেজন্য এর রক্ষণাবেক্ষণ সঠিকভাবে করা হোক। আমাদের আশা এই ব্রিজ গোটা জাতির কাছে অহঙ্কার হয়ে থাকবে।’

OMwoXvgfGmvZ

পাকশী রেলওয়ে ডিগ্রি কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও ইতিহাস গবেষক আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘এই ব্রিজ আমাদের ইহিতাস ঐতিহ্যের অংশ, আমাদের গৌরব। পাকিস্তান আমলে ব্রিজটি মাঝে মধ্যে পরিষ্কার করে ধোয়ামোছা করা হতো, রঙ করা হতো। কিন্তু এখন সেগুলো দেখা যায় না। এ কারণে এর গুণগত মান নষ্ট হওয়া নিয়ে আমরা শঙ্কায় আছি। শুধু ১০১ বছর নয়, আরও এক বা দু’শ বছর এই ব্রিজটি টিকে থাক এই কামনা করি।’

হার্ডিঞ্জ ব্রিজের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ আব্দুল আউয়াল এক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘আমরা ছোটবেলায় এই ব্রিজের ইতিহাস পড়েছি। আমি তো ভাবতেই পারছি না সেই ব্রিজের একশ এক বছর পূর্তি হচ্ছে আর সেই সময় আমি এই ব্রিজের নিরাপত্তার দায়িত্বে আছি। খুবই ভাল লাগছে, নিজেকে গর্বিত মনে হচ্ছে, এই ব্রিজতো আমাদের দেশের একটা গৌরব, ঐতিহ্যের অংশ।’

Bheramara-Hading-Brige

পাকশী বিভাগীয় পরিবহণ কর্মকর্তা (ডিটিও) শফিকুল ইসলাম জানান, বর্তমানে হার্ডিঞ্জ ব্রিজের উপর দিয়ে কলকাতা-ঢাকাগামী মৈত্রি এক্সপ্রেসসহ প্রতিদিন গড়ে ১৪টি আন্ত:নগর ট্রেন, ৪টি মেইল ট্রেন এবং ৮টি মালট্রেন চলাচল করছে।

পশ্চিমাঞ্চল পাকশী বিভাগীয় রেলওয়ের ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ার আরিফুল ইসলাম বলেন, সেতু বিভাগ থেকে হার্ডিঞ্জ ব্রিজের পরিচর্যা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য রঙ করা থেকে শুরু করে যা যা করা দরকার তা যথাসময়ে নিয়মিত করা হয়। ১০১ বছর পরেও এই ব্রিজের গঠন চমৎকার আছে। তারপরও আমাদের রেল কর্তৃপক্ষ এই ব্রিজের স্থায়িত্ব আরও কিভাবে বাড়ানো যায় সে চিন্তা থেকে কাজ করে যাচ্ছে।



মন্তব্য চালু নেই