মা বিক্রি করে সবজি, ছেলে সোনার টুকরো
পাঁচ বছর বয়সে বাড়ির সামনে খেলা করছিলেন তিনি৷ সে সময়ই তার ডান পায়ের পাতার ওপর দিয়ে চলে গিয়েছিল সরকারি বাস৷ তারপর থেকেই তার হাঁটুর তলা থেকে পায়ের পাতা কার্যত নেই৷ পলকে প্রতিবন্ধী হয়ে গিয়েছিলেন মারিয়াপ্পান থাঙ্গাভেলু৷
এই সময়ের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তামিলনাড়ুর সালেমের সেই প্রতিবন্ধীই শনিবার ভারতের খেলার জগত্কে অন্য আকাশে তুলে দিলেন৷ একুশ বছর বয়সে রিওতে প্যারা অলিম্পিকের হাইজাম্পের টি-৪২ ক্যাটাগরিতে সোনা জিতে৷ ভারতের অলিম্পিকের ইতিহাসে এ দিন সংযোজিত হলো এক নতুন অধ্যায়ের৷
একা থাঙ্গাভেলু নয়, এ বিভাগে ব্রোঞ্জ জিতলেন ভারতেরই বরুণ সিং ভাটি৷ একই ইভেন্টের পোডিয়ামে দু’জন ভারতীয় এর আগে কখনও ওঠেননি৷ বরুণ প্রতিবন্ধী পোলিও রোগে আক্রান্ত হয়ে৷ এ বিভাগে রুপা পেয়েছেন আমেরিকার সাম গ্রোয়ে৷ ভারতের শরদ যাদব এ বিভাগে পদকের আশা জাগালেও শেষ পর্যন্ত ষষ্ঠ হন৷
সরকারি বাসের দুর্ঘটনায় পা হারিয়েছিলেন থাঙ্গাভেলু৷ কিন্ত্ত ১৬ বছর পরেও তিনি এর জন্য কোনও ক্ষতিপূরণ পাননি৷ সেই মামলা বেশিদিন চালাতে পারেননি তার মা সরোজা৷ কারণ আর্থিক সমস্যা৷ সাইকেলে করে গ্রামে ঘুরে আনাজ বিক্রি করে চার সন্তানের সংসার চালান সরোজা৷ থাঙ্গাভেলুর বাবা তাদের ছেড়ে চলে গেছেন বহু বছর আগে৷
তার অলিম্পিক সোনা জয় দেশের অসংখ্য দরিদ্র প্রতিবন্ধীর কাছে অনু্প্রেরণা হতে পারে৷ পাঁচ বছর বয়সে পা হারালেও জীবনের লড়াইয়ে হেরে যাননি কখনও৷ দেড় খানা পা নিয়ে তিনি খেলাধুলা, পড়াশুনো সবই চালিয়েছেন সমানতালে৷
সেটা করতে পেরেছেন তার মায়ের আশীর্বাদে৷ তামিলনাড়ুর সালেম জেলার পেরিয়াভাদামপট্টির এক কামরার ছোট ঘরে থাকতেন৷ পাঁচশ’ টাকা ভাড়া৷ ছেলেদের বড় করতে অবিশ্বাস্য লড়াই চালিয়েছেন সরোজা৷
সবজি বিক্রির পাশাপাশি পরের বাড়ি ফাইফরমাশ খেটে দিনে তিনি বাড়তি ১৫০-২০০ টাকা রোজগার করেছেন৷ এর মধ্যে ছেলেদের লেখাপড়া শিখিয়েছেন৷ থাঙ্গাভেলু বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন পাসও করেছেন৷ এই পাস করার পর তিনি একটা চাকরির খোঁজেই ছিলেন৷ কিন্ত্ত প্রতিবন্ধী বলে তাঁর দিকে কেউ ফিরে তাকাননি৷ শনিবার তাঁদের সেই এক কামরার বাড়ির সামনেই ফেটেছে বাজি৷ বিলি হয়েছে মিষ্টি৷ মারিয়াপ্পান তাঁদের এলাকার গর্ব বলে৷
যে সরকার তাঁদের এই কষ্টের জীবনে ঠেলে দিয়েছিল, শনিবার সেই তামিলনাড়ু সরকারই তাঁর জন্য দু’কোটি টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছে৷ থাঙ্গাভেলুকে ‘রাজ্যের গর্ব’ বলে এ ঘোষণা করেছেন তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতা স্বয়ং৷ আর সোনা জেতার জন্য ভারত সরকার এবং আইওএ-ও তাকে দিচ্ছে ৭৫ লক্ষ টাকা৷
পুরস্কারের কথা শুনে মারিয়াপ্পানের চোখে জল৷ ‘আমার চিকিত্সার জন্য মা তিন লক্ষ টাকা দেনা করেছিল৷ সেই দেনা শোধ না হওয়ায় আমাদের বাড়ি বন্ধক দিতে হয়েছিল৷ এবার সেই দেনা শোধ করে আমি মায়ের কষ্ট একটু কমাতে পারব৷’
রিওতে সোনার পদক গলায় ঝোলানোর পর উপস্থিত সাংবাদিকদের এমন কথাই বলেন ভারতের সোনার ছেলে৷
প্যারা অলিম্পিকে এর আগে সোনা পেয়েছিলেন ভারতের দু’জন৷ ১৯৭২ সালে পশ্চিম জার্মানির হেইডেনবার্গের সাঁতারে মুরলিকান্ত পাটেকর ও ২০০৪ সালে আথেন্স প্যারা অলিম্পিকের জ্যাভলিন থ্রোতে দেবেন্দ্র ঝাঝারিয়া৷
এবার অলিম্পিক শুরুর আগে ভারতীয় প্রতিবন্ধী টিমের সত্যপাল সিং প্রচন্ড আশাবাদী ছিলেন প্যারা হাইজাম্পারকে নিয়ে৷ বলেছিলেন, ‘এ ছেলে পদক জিততেই পারে৷’ আর তিউনেশিয়াতে মার্চ মাসে কোয়ালিফাইংয়ের গন্ডি টপকানোর পর মারিয়াপ্পান নিজেও আত্মবিশ্বাসী ছিলেন৷ ‘বাছাইয়ে যখন ১.৭৭ মিটার টপকাতে পেরেছি, তখন ব্রাজিলে গিয়ে পদকের লড়ইতেই নামব৷’
শনিবার সেই মারিয়াপ্পান তার দশম চেষ্টায় ১.৮৯ মিটার টপকে সোনা জেতা নিশ্চিত করেন৷ বরুণ ব্রোঞ্জ জেতেন ১.৮৬ মিটারে৷
থাঙ্গাভেলু তার মায়ের কষ্টের লড়াইয়ের সঙ্গে কৃতিত্ব দিচ্ছেন তাঁর কোচ, বেঙ্গালুরুর সত্যেন্দ্রনারায়নকে৷ এই কোচের হাত ধরেই লন্ডন প্যারা অলিম্পিকে পদক পেয়েছিলেন এইচ এন গিরিশা৷
সত্যেন্দ্রনারায়নই তিন বছর আগে জাতীয় প্যারা গেমসে থাঙ্গাভেলুকে আবিষ্কার করেন৷ তখন থাঙ্গাভেলু ভলিবলার৷ ভলিবলারকে হাইজাম্পার বানিয়ে তাকে অলিম্পিক সোনা জয়ী করে তোলার কারিগরকে তাই ভোলেননি সোনা জয়ী৷ বলছেন, ‘আজ যা কিছু করতে পেরেছি সবই মা-আর কোচের জন্য৷’
১১৮ জনের টিম নিয়ে গিয়ে ক’দিন আগেই রিও অলিম্পিকে কোনও সোনা পায়নি ভারত৷ সেখানে ১৯ জনের টিমে নিয়ে গিয়ে প্যারা অলিম্পিকের দ্বিতীয় দিনেই ভারত সোনা সহ জোড়া পদক পেয়ে গেল৷
দুর্গম গিরি, কান্তার মরু পেরোতে যে প্রতিবন্ধীরাও পারেন, তা ফের দেখিয়ে দিলেন থাঙ্গাভেলু ও বরুণ সিং৷ একইসঙ্গে আমেরিকা ও চীনকে হারিয়ে৷
মন্তব্য চালু নেই