‘মা, তোমায় ভালোবাসি’

মা হচ্ছেন একজন পূর্ণাঙ্গ নারী, যিনি গর্ভধারণ, সন্তানের জন্ম তথা সন্তানকে বড় করে তোলেন- তিনিই অভিভাবকের ভূমিকা পালনে সক্ষম ও মা হিসেবে সর্বত্র পরিচিত। প্রকৃতিগতভাবে একজন নারী বা মহিলাই সন্তানকে জন্ম দেয়ার অধিকারীনি। গর্ভধারণের ন্যায় জটিল এবং মায়ের সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় অবস্থানে থেকে এ সংজ্ঞাটি বিশ্বজনীন গৃহীত হয়েছে।

‘মা’ ছোট্ট একটা শব্দ, কিন্তু কি বিশাল তার পরিধি! সৃষ্টির সেই আদিলগ্ন থেকে মধুর এই শব্দটা শুধু মমতার নয়, ক্ষমতারও যেন সর্বোচ্চ আধার। মার অনুগ্রহ ছাড়া কোনো প্রাণীরই প্রাণ ধারণ করা সম্ভব নয়। তিনি আমাদের গর্ভধারিনী, জননী।

আল কুরআনে বলা হয়েছে, আমি (আল্লাহ) মানুষকে তাদের পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করার জোর নির্দেশ দিয়েছি। যদি তারা তোমাকে আমার সাথে এমন কিছু শরীক করার জোর প্রচেষ্টা চালায়, যার সম্পর্কে তোমার কোন জ্ঞান নেই, তবে তাদের আনুগত্য করো না। আমারই দিকে তোমাদের প্রত্যাবর্তন। অতঃপর আমি তোমাদেরকে বলে দেব যা কিছু তোমরা করতে।

একটি হাদীসে ইসলামের নবী মুহাম্মদ (সা:) বলেছেন, মাতার পদতলে সন্তানের বেহেশত (স্বর্গ)।

সনাতন ধর্মে উল্লেখ আছে স্ববংশবৃদ্ধিকামঃ পুত্রমেকমাসাদ্য..”। আবার সন্তান লাভের পর নারী তাঁর রমণীমূর্তি পরিত্যাগ করে মহীয়সী মাতৃরূপে সংসারের অধ্যক্ষতা করবেন। তাই মনু সন্তান প্রসবিনী মাকে গৃহলক্ষ্মী সম্মানে অভিহিত করেছেন। তিনি মাতৃগৌরবের কথা বিশ্ববাসীকে জানিয়েছেন এভাবে- উপাধ্যায়ান্ দশাচার্য্য আচায্যাণাং শতং পিতা। সহস্রন্ত পিতৃন্মাতা গৌরবেণাতিরিচ্যতে” (মনু,২/১৪৫) অর্থাৎ “দশজন উপাধ্যায় (ব্রাহ্মণ) অপেক্ষা একজন আচার্য্যরে গৌরব অধিক, একশত আচার্য্যরে গৌরব অপেক্ষা পিতার গৌরব অধিকতর; সর্বোপরি, সহস্য পিতা অপেক্ষা মাতা সম্মানার্হ।”

জন্মদাত্রী হিসেবে আমার, আপনার, সকলের জীবনে মায়ের স্থান সবার ওপরে। তাই তাঁকে শ্রদ্ধা, ভালোবাসা জানানোর জন্য একটি বিশেষ দিনের হয়ত কোনো প্রয়োজন নেই। তারপরও আধুনিক বিশ্বে মে মাসের দ্বিতীয় রবিবারটিকে ‘মা দিবস’ হিসেবে পালন করা হচ্ছে, যার সূত্রপাত ১৯১৪ সালের ৮ই মে থেকে।

এক সমীক্ষায় জানা গেছে, বছরের আর পাঁচটা দিনের তুলনায় এদিন অনেক বেশি মানুষ নিজের মাকে ফোন করেন, তাঁর জন্য ফুল কেনেন, উপহার দেন৷ আচ্ছা সত্যি করে বলুন তো, মায়েদের কি আলাদা করে কোনো উপহারের প্রয়োজন পড়ে? তাঁরা যে সন্তানের মুখে শুধুমাত্র ‘মা’ ডাক শুনতে পেলেই জীবনের পরম উপহারটি পেয়ে যান৷

আমাদেও দেশে মাকে নিয়ে অসংখ্য গান কবিতা রয়েছে যেমন, মাগো মা ওগো মা, আমারে বানাইলি তুই দিওয়ানা- খুরশীদ আলম, মায়ের একধার দুধের দাম কাটিয়া গায়ের চামড়া- ফকির আলমগীর, এমন একটা মা দে না- ফেরদৌস ওয়াহিদ, রাতের তারা আমায় কি তুই বলতে পারিস- জেমস, ওই আকাশের তারায় তারায়- রাশেদ, ছেলে আমার মস্ত বড় মস্ত অফিসার- নচীকেতা ঘোষ, পথের ক্লান্তি ভুলে স্নেহ ভরা কোলে তব মাগো- হেমন্ত মুখোপাধ্যায় মত শিল্পীরা গেয়েছেন।

বিখ্যাত কবিদের ও অসংখ্য কবিতা আছে মাকে নিয়ে তার মধ্যে উল্লেখ যোগ্য, কাজী নজরুল ইসলাম এর মা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বীরপুরুষ/মনে পড়া/লুকোচুরি, শামসুর রাহমান এর কখনো আমার মাকে, হুমায়ুন আজাদ এর আমাদের মা, কামিনী রায় এর কত ভালবাসি ইত্যাদি।

হিন্দু ধর্মীয় মতে, ‘মাতৃ দেব ভব’। অর্থাৎ মা দেবী স্বরূপিনী, জীবন্ত ঈশ্বরী। তাছাড়া হিন্দুধর্মে মহাশক্তি, আদিশক্তি, রক্ষাকর্ত্রীর ভূমিকায় আমরা যাঁদের পেয়েছি, তাঁদের কিন্তু আমরা মাতৃরূপেই চিনেছি। এ জন্য কুসন্তান বলা হলেও, কুমাতা কখনও বলা হয় না।

প্রতি বছর মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে বিশ্ব মা দিবস পালিত হয়। নানা সূত্র থেকে জানা গেছে, প্রথম মা দিবস উদযাপন শুরু হয় গ্রিসে। গ্রিকরা তাদের মাতা-দেবি ‘রেয়া’র নামে পূজা করত। ১৯১৩ সালে অ্যামেরিকান কংগ্রেস মা দিবসকে সরকারিভাবে পালনের অনুমতি দেয়। তারপর থেকেই বিভিন্ন দেশে মা দিবস উদযাপন শুরু হয়। তবে মা দিবস উদযাপনের প্রথম ভাবনাটি এসেছে অ্যামেরিকান সমাজকর্মী জুলিয়া ওয়ার্ডের মাথা থেকে৷

কোনো মা, তা তিনি যে পেশাতেই থাকুন না কেন, যত কুশ্রীই হন না কেন, সন্তানের কাছে তিনি কিন্তু দেবীর মতোই। আর শুধু হিন্দু ধর্মে কেন? ইসলামে ‘মায়ের পায়ের নীচে বেহেস্ত’ পাওয়ার কথা বলা হয়েছে। খ্রিষ্টধর্মেও রয়েছে ‘মাদার মেরির’ বিশেষ তাৎপর্য।

অনেকেই আবার ভেবে থাকেন বা বলেন দিবস দিয়ে কি হবে। তাদের জন্য বলা, এ রীতিকে বোধহয় একেবারে তাচ্ছিল্য করা ঠিক নয়। অন্তত একটা দিন তো মায়ের কথা, তাঁর সুখ-দুঃখ, চাওয়া-পাওয়ার কথা ভাবেন বিশ্ববাসী।

আজকাল কত ছেলে-মেয়ে, পুত্রবধুকে দেখা যায়, মায়েদের অযত্ন করতে, তাঁদের অবহেলা করতে। যে মা-বাবা আমাদের আঙুল ধরে হাঁটতে শিখিয়েছে, কথা বলতে শিখিয়েছে, মুখে তুলে দিয়েছে অন্ন, সেই বাবা-মা বৃদ্ধ বয়সে সন্তানের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়লে, তাঁদের হাতে গড়া সন্তানটি ছোটবেলার কথা ভুলে বাবা-মা কে পাঠিয়ে দিচ্ছে বৃদ্ধাশ্রমে।

অনেকেই হয়ত বলবেন বিদেশের কথা। কিন্তু বিদেশে সমাজব্যবস্থা ভিন্ন, রীতি-নীতিও আলাদা। সামাজিক নিরাপত্তাও বিদেশে অনেক বেশি। ওইসব দেশে বৃদ্ধ বাবা-মা বৃদ্ধাশ্রমে যাবেন, অথবা তাঁদের নিজেদের খরচ নিজেরাই বহন করবেন এটাই স্বাভাবিক। কর্ম-জীবনের উপার্জনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে, এ জন্য সরকারি ভাতাও পেয়ে থাকেন তাঁরা।

কিন্তু, আমাদের দেশে? আমরা তো দেশকেও ‘মা’ বলে ডাকি। দেশের মাটিকে মা জ্ঞান করে তাঁর পায়ে মাথা ঠেকাই আমরা। বড় গলায় গর্ব করি দেশমাতৃকার জন্য। এ রকম একটি গানও আছে ‘ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকায় মাথা’।

অথচ নিজের মায়ের বেলায় আমরা কতটুকু কি করেছি একটু ভেবে দেখা যাক? বেঁচে থাকতে কতদিন, কতবার তাঁকে আদর করেছি আমরা? কতবার বলেছি ‘মা, তোমায় ভালোবাসি’? দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা দিন। যতদিন ‘মা’ ও বাবা বেঁচে আছেন, ততদিন, তাদের প্রতি যত্ন নিন। ভালোবাসুন তাদের কারন তাদের দয়ায়ই আপনার আমার এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকা।

ছাটবেলা কাটিয়ে উঠে কৈশোর, যৌবন, প্রৌঢ়ত্ব, বার্ধক্য, আর সবশেষে অনিবার্য মৃত্যু। এই ধ্রুব সত্য শুধু আপনার-আমার নয়, সবার জন্য। আপনি বৃদ্ধ হবেন, আপনি সন্তানের পিতা মাতা হবেন। আপনার সন্তানের জন্য রেখে যান উজ্জল দৃষ্টান্ত।

এবারের বিশ্ব ‘মা’ দিবসে জগতের সকল মা’র প্রতি রইল ভালবাসা ও বিনম্র শ্রদ্ধা।

লেখক: তপু সারোয়ার



মন্তব্য চালু নেই