মামলা-গ্রেফতারে বিএনপির পুনর্গঠন প্রক্রিয়া বিপর্যস্ত
মামলা-গ্রেফতারে বিএনপির পুনর্গঠন প্রক্রিয়া বিপর্যস্ত । নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে অব্যাহত মামলা আর ধারাবাহিক গ্রেফতারে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে বিএনপির সাংগঠনিক পুনর্গঠন প্রক্রিয়া। নাশকতাসহ বিভিন্ন মামলায় বিএনপির শীর্ষ নেতা থেকে শুরু করে স্থানীয় অসংখ্য নেতার কারাগার যাপন এবং বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার দেশে ফেরা বিলম্ব হওয়ায় এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে এই তথ্য।
তারা জানান, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বর্ষপূর্তিকে কেন্দ্র করে বিএনপির আন্দোলনের পূর্বাপর থেকেই দলের শীর্ষ নেতা থেকে শুরু করে স্থানীয় নেতারাও কারাগারে যাওয়া-আসার মধ্যে রয়েছেন। এ কারণে কাক্সিক্ষত গতি পাচ্ছে না দলটির বহুল প্রত্যাশিত পুনর্গঠন প্রক্রিয়া। যদিও দলের দায়িত্বশীলরা বিভিন্ন সময়ে অভিযোগ জানিয়ে আসছেন, পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতেই সরকার ‘মিথ্যা মামলায়’ তাদের নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করছে।
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া নিজেই অভিযোগ করেছেন, দলের শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দকে কারাগারে বন্দি রাখা সরকারের দুরভিসন্ধি রয়েছে।
লন্ডনে এক আলোচনা সভায় বিএনপি নেত্রী বলেন, ‘যখন সারাদেশে তৃণমূল পর্যায় থেকে কাউন্সিল করে দলকে পুনর্গঠনের উদ্যোগ নিয়েছি, তার পরপরই সারাদেশে দলের নেতাকর্মীদের বিভিন্ন মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার করা হচ্ছে। সরকারের এ ধরনের দমন নিপীড়ন থেকে দলের বয়োজ্যেষ্ঠ নেতারাও বাদ পড়ছেন না।’
দলীয় সূত্র জানায়, বিএনপি পুনর্গঠনে এখন সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে মামলা। নাশকতার মামলায় দলটির গুরুত্বপূর্ণ অনেক নেতা এখনও কারাগারে। গ্রেফতার আতঙ্কে ও ‘হয়রানিমূলক বিভিন্ন মামলা’য় আসামি হয়ে আত্মগোপনে চলে গেছেন শীর্ষ পর্যায়ের অনেক নেতা। নাশকতার তিন মামলায় জামিনে থাকা দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে আবারো জামিন বাতিল করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
নতুন করে কারাগারে গেছেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়। কারাগারে আছেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন এবং এম কে আনোয়ার। দীর্ঘদিন কারাগারে রয়েছেন দলটির দপ্তরের দায়িত্বে থাকা দলের গুরুত্বপূর্ণ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীসহ আরো অনেকে। শুধু কেন্দ্রীয় পর্যায়েই নয়, স্থানীয় তৃণমূল নেতাকর্মীরা কারাগারে আসা-যাওয়ার মধ্যে রয়েছেন।
এদিকে গ্রেফতারের ভয়ে আত্মগোপনে রয়েছেন শীর্ষ থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যন্ত অসংখ্য নেতা। তাদের নামেও রয়েছে অসংখ্য মামলা। তারা শিগগিরই জামিন পাচ্ছেন না বলে ধারণা নেতাকর্মীর। উপরন্তু নিম্ন আদালতে হাজির হলে উল্টো কারাগারে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। মামলার সঙ্গে আবার যোগ হয়েছে শারীরিক অসুস্থতা। কারাগারে থাকা প্রায় সব নেতাই অসুস্থ। যারা জামিনে বের হয়েছেন তারা দলীয় প্রক্রিয়ার চেয়ে চিকিৎসায় ব্যস্ত সময় পার করছেন।
ফখরুলের পর স্থায়ী কমিটির সদস্য তরিকুল ইসলাম দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতা। দল পুনর্গঠনসহ যে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, একাধিক মামলায় গ্রেফতার এড়াতে কৌশলে আত্মগোপনে আছেন তিনিও।
একইভাবে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া, মির্জা আব্বাস, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবদুল আউয়াল মিন্টু, এম এই কাইয়ুম সাংগঠনিক সম্পাদক ফজলুল হক মিলন, ঢাকা মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব হাবিব-উন-নবী খান সোহেলসহ অনেক দায়িত্বশীল ও গুরুত্বপূর্ণ নেতার বিরুদ্ধেই রয়েছে একাধিক মামলা। গ্রেফতার এড়াতে তারা এখনও প্রকাশ্যে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া চালাতে পারছেন না। আদালতে হাজির হলে জামিন না দিয়ে কারাগারে পাঠিয়ে দিতে পারেন এমন আশঙ্কাও রয়েছে।
এর মধ্যে সম্প্রতি দুই বিদেশি হত্যায় নতুন করে এম এ কাইয়ুম এবং হাবিব উন নবী খান সোহেলের নাম আলোচিত হচ্ছে। যদিও বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, দলের শীর্ষ নেতাদের জাতীয় নির্বাচন থেকে দূরে রাখতে এবং দলকে সন্ত্রাসী দল হিসেবে পরিচিত করাতে সরকার ‘ষড়যন্ত্র’ করছে। এজন্য বিদেশি হত্যায় বিএনপির নেতাদের জড়ানো হচ্ছে।
দলের দায়িত্বশীল নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আগামী ডিসেম্বর-জানুুয়ারিতে দলের ষষ্ঠ কাউন্সিল করার চিন্তা ভাবনা করা হচ্ছে। সেজন্য আগে তৃণমূল পর্যায়ে দলকে পুনর্গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এর অংশ হিসেবে গত ৯ আগস্ট সারাদেশে বিএনপির ৭৫টি সাংগঠনিক জেলাকে কেন্দ্র থেকে চিঠি দেওয়া হয়। চিঠিতে গত ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে ওয়ার্ড, ইউনিয়ন, পৌরসভা ও উপজেলা পর্যায়ের মেয়াদোত্তীর্ণ সব কমিটি ভেঙে নতুন কমিটি গঠনের নির্দেশনা দেওয়া হয়। ওই পুনর্গঠনের শেষ হলেই কাউন্সিলের জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার কথা। তবে হামলা-মামলা আর গ্রেফতারে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কমিটিগুলো করা সম্ভব হয়নি। পরে মৌখিকভাবে নভেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত সময় বাড়ানো হয়। কিন্তু গ্রেফতার আর মামলায় সেই তারিখেও কমিটি সমাপ্ত করা সম্ভব হবে কিনা-নেতাকর্মীদের মাঝে তা নিয়েও সন্দেহ আছে। কারণ বেশিরভাগ জেলাগুলোতে এখনো পুনর্গঠন কাজ অর্ধেকও শেষ করতে পারেনি। এজন্য নেতাকর্মীরা পুলিশি হয়রানিকে দায়ী করছেন।
বিএনপির সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, সরকার বিএনপির পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। এর অংশ হিসেবে দলের শীর্ষ থেকে শুরু করে স্থানীয় নেতাকর্মীদের মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার করছে। তবে বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার মধ্যেও বিএনপি পুনর্গঠন প্রক্রিয়া চালাচ্ছে। বিএনপি নেত্রী দেশে ফিরলে এই প্রক্রিয়া আরো জোরদার হবে বলে জানান তিনি।
মন্তব্য চালু নেই