আওয়ার নিউজ এক্সক্লুসিভ

মানবতার সেবায় এগিয়ে চলেছেন মনের ধনী আলাউদ্দীন

প্রখর রোদে কৃষক যখন ফসলী মাঠে কাজ করছে তখন দেখা গেলো এক যুবক স্যালাইন পানি নিয়ে ওই তৃষ্ণার্ত কৃষকের সামনে উপস্থিত। পানি পান করালো সেই কৃষককে। সেখানে আশপাশে মাঠে যারা কাজ করছিল তাদেরকেও অনুরূপ ভাবে তৃষ্ণা নিবারণ করলো সেই যুবকটি। ওই ঘটনার বেশ কিছুদিন পরে গ্রামের ভাঙ্গা রাস্তার অংশবিশেষ স্বশ্রমে নিজ উদ্যোগে মেরামত করতে দেখা গেছে ওই যুবককে। যাদের স্যানেটারী ল্যাট্রিন নেই তাদের বাড়িতে স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা নিশ্চিত করতে স্যানিটারী ল্যাট্রিন তৈরি করে দিচ্ছে নিজ হাতে নিজের স্বল্প টাকা দিয়েই। যুবকটি নাম আলাউদ্দীন। বাড়ি সাতক্ষীরা জেলার সদর উপজেলার বাশদহা ইউনিয়নের প্রত্যন্ত গ্রাম হাওয়ালখালীতে। মৃত সুজাউদ্দীনের দুই ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে আলাউদ্দীন মেঝ।

কৃষক পিতার মৃত্যুর পর আলাউদ্দীনের বন্ধ হয়ে যায় নিজের লেখা পড়া। ৫ম শ্রেনি পর্যন্ত পড়ালেখা করা আলাউদ্দীন প্রতিটি শ্রেনিতেই প্রথম হতো। পিতার মৃত্যুতে দারিদ্র সংসারের ঘানি টানতে তাই তাকে অল্প বয়সেই জীবিকার তাগিদে চলে যেতে হয় ঢাকায়। সংসারের অভাবের কারণে লেখাপড়া আর করা হলো না আলাউদ্দীনের। বন্ধ হয়ে গেলো মেধা আর আগ্রহের পরিস্ফুটিত এক প্রাথমিক স্তর। ঢাকা গিয়ে মা সোয়েটার নামের একটি ফ্যাক্টরিতে হেল্পার হিসেবে প্রথমে কর্মজীবনের সূত্রপাত। তিন মাসের মধ্যে সুপ্ত প্রতিভা আর কর্মপ্রচেষ্টায় ফ্যাক্টারিতে অপারেটর পদে উন্নীত হয় সে। কিন্তু থেমে থাকেনি তার সমাজ, রাষ্ট্র, মানুষ আর জীবনসংসারকে ভিন্নরূপে দেখা। এগুলো নিয়ে ভাবতে গিয়ে সে শুরু করে মানবতার সেবায় মহৎ কর্মউদ্যোগ।

Alauddin3
গার্মেন্ট ফ্যাক্টারীতে নিয়মিত ৮ঘন্টার পাশাপাশি অতিরিক্ত ‘ওভার টাইমে’ আরো ৭/৮ঘন্টা কাজ করে আলাউদ্দীনের মাসিক আয় পৌছায় ১৩ থেকে ১৪হাজার টাকা। ওই বেতন থেকে নিজের খরচের জন্য মাত্র ৩হাজার টাকা ও বাড়ির জন্য ৩হাজার টাকা পাঠিয়ে দিয়ে অবশিষ্ট টাকা দিয়ে সমাজ, রাষ্ট্র আর আর্তমানবতার সেবায় বিলিয়ে দেয় আলাউদ্দীন। আর সেই লক্ষ্যেই ৩ মাস পর পর ছুটি নিয়ে নিজের গ্রামের বাড়িতে গিয়েই তিন মাসের সঞ্চয়ী ২০ থেকে ২২হাজার টাকা দিয়ে শুরু করে মহতি উদ্যোগ গুলো বাস্তবায়নে। ছুটি শেষে কর্মস্থলে ফিরতে ২/১দিন দেরি হলেই তাঁর কপালে জোটে অফিসের তরফ থেকে বকাঝকা আর তিরষ্কর। কোন কোন ক্ষেত্রে সাসপেন্ডও জুটেছে। আর তাই তাকে অনেকবার ফ্যাক্টারীও বদল করতে হয়েছে। কিন্তু এতটুকু পরিমাণ দমে যাননি ২৮বছর বয়সী আলাউদ্দীন। মনের কষ্টগুলো চাপা রেখে ফের জোর কদমে ছুটে চলেছে পরবর্তী মহৎ উদ্যোগ গুলো বাস্তবে রূপ দিতে।

আলাউদ্দীনের মানবতার সেবার উদাহরণ নিয়ে সাতক্ষীরার ঝাউডাঙ্গা ডিগ্রী কলেজের প্রভাষক বাশদহা ইউনিয়নের বাসিন্দা অহিদুজ্জামান লাভলু জানালেন আরো চমকপ্রদ ঘটনা। তিনি জানান, প্রতি ঈদের দিন ঈদগাহে গিয়ে আলাউদ্দীন গরীব মানুষের মাঝে টুপি বিতরণ করেন। ঈদের দিন সকালে গ্রামের অনেক বৃদ্ধ মানুষকে নিজ হাতে গোসল করান। শুধু তাই নয় নিজ উদ্যোগে ভ্যান ভাড়া নিয়ে নিজেই বৃদ্ধ মানুষকে ঈদগাহে নামাজের আগে নিয়ে যান আবার নামাজ শেষে বাড়িতে পৌছে দেন। এলাকার গরীব ও অসহায় পরিবারের মাঝে চিনি, সেমাই ইত্যাদি বিতরণ করেন। সবই নিজের স্বল্প টাকায় দারিদ্রদের মাঝে বিনামূল্যে বিতরণ করেন যুগের রোল মডেল আলাউদ্দীন। প্রচার বিমুখ আলাউদ্দীনের নিজের মহতি উদ্যোগের তেমন ভালো ছবিও নেই তার সংরক্ষণে।
Alauddin2
এখানেই থেমে থাকেন না আলাউদ্দীন। অর্থনৈতিক ভাবে নিজে দারিদ্র হলেও মন ও মানসিকতার দিকে থেকে সে মোটেই দারিদ্র নয় বরং অনেক ধনী। বাশদহা ইউনিয়নের আইচপাড়া, ভবানিপুর, হাওয়ালখালী, কাউনডাঙ্গা, রেউই, পাচরখি গ্রাম গুলোতে নিয়মিত বিরতিতে মহতি কার্যক্রম গুলো নিজ হাতে নিজের পয়সায় সম্পাদন করে বড় সাদা মনের অধিকারী আলাউদ্দীন। ওই অঞ্চলের পরিবেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন সমুন্নত রাখতে এলাকাবাসীর দৃষ্টিআকর্ষনের জন্য বিভিন্ন প্লাকার্ড, ব্যানার, টি-শার্ট ও বাহারি ঢং-এ নিজেকে উপস্থাপন করে সে। ‘পরিবেশ পরিচ্ছন্ন ও পরিষ্কার রাখুন- নিজের শরীর নিয়ে সুস্থ থাকুন’ স্লোগান নিয়ে প্রতিবার উপস্থিত হয় সাধারণ মানুষের সামনে।

04
এছাড়াও ওই অঞ্চলের এতিম, গরীব, প্রতিবন্ধি শিশু ও শিক্ষার্থীদেরকে বিনামূল্যে খাতা, বই, কলম সহ নানান কিছু বিতরণ করেন আলাউদ্দীন। ‘মানবতার হাসপাতাল’ শীর্ষক স্লোগানে অসহায় মানুষকে চিকিৎসা সেবার ব্যবস্থার করতে বিনামূল্যে ঔষধ বিতরণ ও ডাক্তার নিয়ে গ্রামের গরীব-অসহায়দের ফ্রি-চিকিৎসা প্রদাণ বাস্তবায়ন করেছে উঠতি ওই যুবকটি। শুধু তাই নয়, এতিম, গরীব, অসহায় ও প্রতিবন্ধি শিশুদের মাঝে নগদ অর্থ প্রদানও তার নিয়মিত কর্মসূচির অংশ। গ্রামের বাড়িতে অবস্থানকালীন সময়ে রাতের প্রহরি হিসেবেও পাড়া-মহল্লায় নিজেই ‘নাইট গার্ড’ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। করেছেন বিনোদনের ব্যবস্থাও। বিভিন্ন উৎসব-পার্বনে নিজে বাহারী ঢং-এ সেজে যেমন অপরকে আনন্দ দিয়েছেন তেমনি বিনোদনের অন্যান্য উদ্যোগও গ্রহণ করেছেন।

আর্তমানবতার সেবায় আলাউদ্দীনের মহৎ কর্মকান্ড ও কর্মসূচি অব্যহত আছে প্রত্যন্ত অঞ্চলের অতিসাধরণ মানুষের কল্যাণে। এ প্রসঙ্গে আওয়ার নিউজ বিডি ডটকম কে আলাউদ্দীন জানান, ‘যতদিন বেঁচে থাকবো মানুষের সেবার কর্মসূচি গুলো বাস্তবায়ন অব্যাহত রাখার চেষ্টা করবো। আল্লাহর রহমতে আমার উপার্জিত টাকা মানবতার সেবায় বিলিয়ে দিতে আমার কোন কষ্ট হয় না। বরং আত্মতৃপ্তি অনুভব করি, আর এই মনের তৃপ্তিই আমার চলার পাথেয়।’ তিনি সমাজের বিত্তবানদের সমাজ, রাষ্ট্র ও মানুষের কল্যাণে আর্তমানবতার সেবায় এগিয়ে আসার আহবান জানান।



মন্তব্য চালু নেই