মানবতাবিরোধী অপরাধ : রায়ের অপেক্ষায় ৭ মামলা

মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলাগুলোর রায়ের অপেক্ষমাণ তালিকা ক্রমেই বেড়ে চলছে। রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ তালিকা বাড়লেও ১০ মাসের অধিক সময় ধরে রায় শূণ্য রয়েছে ট্রাইব্যুনাল।
মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সর্বশেষ গত বছরের ৩ নভেম্বর প্রবাসী জামায়াত নেতা চৌধুরী মঈনুদ্দিন ও আশরাফুজ্জামানের ফাঁসির রায় হয়। এরপর আর কোনো রায় হয়নি। বর্তমানে ট্রাইব্যুনালে ৬টি ও আপিল বিভাগে একটি মামলা রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রয়েছে।
এর মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের মামলা, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী, জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজহারুল ইসলাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাবেক আওয়ামী লীগ নেতা মোবারক হোসেন ও ফরিদপুরের পলাতক বিএনপি নেতা জাহিদ হোসেন খোকনের মামলা এবং ট্রাইব্যুনাল-২ এ রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রয়েছে জামায়াতের নির্বাহী পরিষদ সদস্য মীর কাসেম আলী ও জাতীয় পার্টির সাবেক মন্ত্রী সৈয়দ কায়সারের মামলা। রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ থাকা মামলাগুলোর মধ্যে বেশি সময় ধরে ঝুলে রয়েছে জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীর মামলাটি।
অন্যদিকে জামায়াতের নায়েবে আমির মাওলানা আব্দুস সোবহানের মামলার কার্যক্রমও প্রায় শেষদিকে।
আপিলে এবার কামারুজ্জামান : সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় বর্তমানে শুধু জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের মামলা চূড়ান্ত রায়ের জন্য অপেক্ষায় আছে। গত ১৭ সেপ্টেম্বর বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন ৪ বিচারপতির আপিল বেঞ্চ রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখেন।
এর আগে ওই একই দিনে আপিল বিভাগ জামায়াতের নায়েবে আমির মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া মৃত্যুদণ্ড কমিয়ে আমৃত্যু কারাদণ্ডাদেশ দেন।
গত বছরের ১২ ডিসেম্বর আপিল নিষ্পত্তি শেষে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর হয়।
ঝুলে গেছে নিজামীর রায় : নিজামীর মামলার বিচারিক কার্যক্রম শেষ হয়েছে ১০ মাসের অধিক সময় আগে। কিন্তু এখনো রায় ঘোষণা হয়নি। ট্রাইব্যুনালের মামলাগুলোর মধ্যে নিজামীর মামলাটিই বিচারিক কার্যাক্রম শেষ হওয়ার পর সবচেয়ে বেশি দিন রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রয়েছে। প্রথম দফায় নিজামীর মামলার কার্যক্রম শেষ হয় গত বছরের ১৩ নভেম্বর। নিজামীর আইনজীবীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে চূড়ান্ত যুক্তি উপস্থাপন শেষে গত বছরের ২০ নভেম্বর দ্বিতীয় দফায় আবারো মামলার কার্যক্রম শেষ হয়। কিন্তু রায় ঘোষণার আগেই একই বছরের ৩১ ডিসেম্বর অবসরে যান ট্রাইব্যুনাল-১-এর তৎকালীন চেয়ারম্যান বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবীর। এরপর দীর্ঘ ৫৩ দিন পর গত চলতি বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমকে এই ট্রাইব্যুনালে চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার পর নিজামীর মামলায় দুই পক্ষ আবার নতুন করে যুক্তি উপস্থাপন করেন। গত ২৪ মার্চ তৃতীয় দফায় নিজামীর মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ বলে ঘোষণা দেওয়া হয়।
এরপর ২৩ জুন নিজামীর রায় ঘোষণার নির্ধারিত দিন ছিল। কিন্তু নিজামীর অসুস্থতার কারণে সেদিনও রায় ঘোষণা করেননি ট্রাইব্যুনাল। সেই থেকে মামলাটির রায় ঘোষণার অপেক্ষা এখনো শেষ হয়নি।
এ বিষয়ে নিজামীর মামলার প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘ট্রাইব্যুনালে নিজামীর মামলার রায় হয়েও হচ্ছে না।  ১০ মাস অতিক্রান্ত হলেও রায় না হওয়াটা দুঃখজনক। এ নিয়ে অস্বস্তি আর দুশ্চিন্তার মধ্যে আছি আমরা।  নিজামীর মামলার রায় না হওয়া পর্যন্ত অন্য কোনো মামলাতেও মনোযোগ দিতে পারছি না।’
পলাতক খোকন রাজাকার : একাত্তরে স্থানীয়ভাবে ‘খোকন রাজাকার’ নামে পরিচিত ফরিদপুরের নগরকান্দা পৌরসভার মেয়র ও বিএনপির নেতা পলাতক এম এ জাহিদ হোসেন খোকনের মামলাটি গত ১৭ এপ্রিল রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখেন ট্রাইব্যুনাল। পাঁচ মাস পেরিয়ে গেলেও এখনো রায় ঘোষিত হয়নি। কিন্তু এর আগে জামায়াতের সাবেক রুকন পলাতক আবুল কালাম আজাদের (বাচ্চু রাজাকার) রায় ঘোষণা করা হয়েছিল শুনানি শেষ হওয়ার পর মাত্র ২৬ দিনের মাথায়।
মীর কাসেম আলী : জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও দিগন্ত মিডিয়া কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান মীর কাসেম আলীর মামলার কার্যক্রম শেষ হয় গত ৪ মে। ওই দিন মামলাটির রায় ‘যেকোনো দিন ঘোষণা করা হবে’ মর্মে অপেক্ষমাণ রাখেন ট্রাইব্যুনাল-২। এই ট্রাইব্যুনালে এ পর্যন্ত ছয়টি মামলার রায় হয়েছে।  অপেক্ষমাণ রাখার পর রায় ঘোষণা করতে ট্রাইব্যুনাল-২-এর গড়ে এক মাস করে সময় লেগেছে।
মোবারক হোসেন : ব্রাহ্মণবাড়িয়া আওয়ামী লীগের সাবেক নেতা ও স্থানীয় রাজাকার কমান্ডার মোবারক হোসেনের মামলাটি গত ২ জুন থেকে রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রয়েছে ট্রাইব্যুনাল-১ এ। মোবারক হোসেনের পরিচয় সম্পর্কে জানা যায়,  ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া থানার নয়াদিল গ্রামের সাদত আলীর ছেলে তিনি। তার রাজনৈতিক পরিচয় সম্পর্কে তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, মোবারক হোসেন স্বাধীনতার পর জামায়াতের রুকন ছিলেন। পরে তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দেন। তবে মোবারক হোসেন তার সাক্ষ্যে দাবি করেন তিনি সব সময়ই আওয়ামী লীগ করতেন। এখনো আওয়ামী লীগেই আছেন। তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রতিহিংসামূলক।
এটিএম আজহার : জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজহারুল ইসলামের মামলা গত ১৮ সেপ্টেম্বর রায়ের জন্য অপেক্ষামাণ রাখেন বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ। এটিএম আজহারের বিরুদ্ধে গণহত্যা, হত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ, নির্যাতন, আটক, অপহরণ, গুরুতর জখম ও অগ্নিসংযোগের ৬টি অভিযোগ আনা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে তদন্ত কর্মকর্তা (আইও) এম ইদ্রিস আলীসহ রাষ্ট্রপক্ষের ১৯ জন সাক্ষী সাক্ষ্য দিয়েছেন। তাদের মধ্যে সপ্তম সাক্ষী আমিনুল ইসলামকে বৈরি ঘোষণা করেছেন রাষ্ট্রপক্ষ। আজহারের পক্ষে একমাত্র সাফাই সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দেন আনোয়ারুল হক।
সৈয়ম মো. কায়সার : এরশাদ সরকার আমলের সাবেক মন্ত্রী সৈয়দ মো. কায়সারের মামলার বিচারিক কার্যক্রম শেষ হওয়ায় গত ২০ আগস্ট রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখেন বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন ট্রাইব্যুনাল-২। সাবেক কৃষি প্রতিমন্ত্রী সৈয়দ মো. কায়সারের বিরুদ্ধে ১৮টি অভিযোগ আনে রাষ্ট্রপক্ষ।
গত বছরের ১৪ নভেম্বর তার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নেন আদালত। গত ৯ মার্চ থেকে তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। ৩১ জন সাক্ষী কায়সারের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছেন। তবে ট্রাইব্যুনালে এই প্রথম কোনো আসামি হিসেবে কায়সারের পক্ষে কোন সাফাই সাক্ষ্য দেওয়া হয়নি। মামলা চলাকালীন কায়সার শর্তসাপেক্ষে জামিনে ছিলেন।
 
বিচারিক কার্যনক্রম শেষ হওয়ার দিন গত ২০ আগস্ট কায়সারের জামিন বাতিল করে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন ট্রাইব্যুনাল।
টাইব্যুনালের প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ বলেন, ‘ট্রাইব্যুনালের রায়ের অপেক্ষায় আমরা উদগ্রীব হয়ে আছি। কেনো এত দেরি হচ্ছে আমরা বুঝতে পারছি না।’ বিশেষ করে নিজামীর মামলার রায় দ্রুতই আসা উচিত বলেও মন্তব্য করেন এ আইনজীবী।



মন্তব্য চালু নেই