মহানবী (সা.)-এর জীবনে কুরবানি
মুফতি হুমায়ুন কবির খালভি: রাসুলুল্লাহ (সা.) মদিনায় হিজরত করার পর কুরবানির বিধান অবতীর্ণ হয়। কোরবানি নতুন কোনো বিষয় নয়। এর ধারাবাহিকতা আদম (আ.)-এর যুগ থেকেই চালু হয়েছে। আল কোরআনে কাবিল ও হাবিলের কুরবানির কথা এসেছে। তাঁদের দুজনের কোরবানি থেকে হাবিলের কোরবানি কবুল হয়েছিল। আর মুসলিম সমাজের কোরবানি মিল্লাতে ইব্রাহিমের অনুসরণ। তাঁর স্মৃতি ধারণের জন্য এ উম্মতের ওপর কুরবানি ওয়াজিব করে দেওয়া হয়েছে। মহানবী (সা.) কোরবানির অনেক মর্যাদা বর্ণনা করেছেন। সাহাবায়ে কেরাম রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! কোরবানি প্রথাটা কী?’ রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘এটা তোমাদের পিতা ইব্রাহিম (আ.)-এর সুন্নত।’ সাহাবায়ে কেরাম পুনরায় জিজ্ঞেস করেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! এতে আমাদের কী লাভ রয়েছে?’ রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘কুরবানির পশুর প্রতিটি পশমের বিনিময়ে একটি করে নেকি পাওয়া যাবে।’ সাহাবায়ে কেরাম পুনরায় জিজ্ঞেস করেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! সওফ তথা দুম্বা, ভেড়া ও উটের পশমের বিনিময়ে কি এ পরিমাণ সওয়াব পাওয়া যাবে?’ রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘হ্যাঁ, প্রতিটি পশমের বিনিময়ে একটি করে নেকি দেওয়া হবে।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৩১২৭)
রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রতিবছরই কুরবানি করেছেন। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) মদিনার ১০ বছর জীবনের প্রতিবছরই কোরবানি করেছেন।’ (তিরমিজি, হাদিস : ১৫০৭)
তিনি ঈদগাহেই কুরবানির পশু জবেহ করতেন। আর তিনি উট, গরু ও ভেড়া—সবই কোরবানি করতেন। এ ক্ষেত্রে তিনি নিজেই জবেহ করতেন। প্রখ্যাত তাবেয়ি হজরত নাফে (রহ.) ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) ঈদগাহে (কুরবানির পশু) জবেহ করতেন ও নাহর (উটের কুরবানি) করতেন। (বুখারি, হাদিস : ৫৫৫২)
লক্ষণীয় যে আরবি পরিভাষা মতে, ‘জবেহ’ হয় গরু, মহিষ, ভেড়া, দুম্বা ও ছাগলের ক্ষেত্রে। আর ‘নহর’ হয় উটের ক্ষেত্রে। মহানবী (সা.) সাধারণত প্রতিবছর দুটি ভেড়া জবেহ করতেন। একটি নিজের জন্য, অন্যটি উম্মতের জন্য। হজরত আনাস ইবনে মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘নবী করিম (সা.) দুটি ভেড়া কোরবানি দিতেন। আর আমি দুটি ভেড়া কোরবানি দিতাম।’ (বুখারি, হাদিস : ৫৫৫৩)
অন্য হাদিসে এসেছে, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘নিশ্চয়ই রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন কুরবানি করতে ইচ্ছা করতেন, তিনি চিত্রবিচিত্র, শিংবিশিষ্ট, মোটাতাজা দুটি খাসি-ভেড়া কোরবানি দিতেন। এর একটি তিনি ওই সব উম্মতের জন্য
কুরবানি করতেন, যারা আল্লাহর একত্ববাদের সাক্ষ্য দেবে ও তাঁর দায়িত্ব পালনের কথা স্বীকার করবে। অন্যটি তিনি নিজের ও তাঁর পরিবারের নামে জবেহ করতেন।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৩১২২)
এ হাদিসের ব্যাখ্যায় জালালুদ্দিন সুয়ুতি (রহ.) বলেন, ‘এর আলোকে বোঝা যায়, নিজের কোরবানির মধ্যে পরিবারকে অন্তর্ভুক্ত করা বিশুদ্ধভাবে প্রমাণিত। এটা তাদের পক্ষ থেকে আদায় হবে। বেশিরভাগ আলেম তা-ই বলেছেন। কিন্তু আবু ইমাম হানিফা ও ছওরি (রহ.) তা মাকরুহ বলেন। (তাঁদের মতে, ওয়াজিব কোরবানিতে পরিবারকে অন্তর্ভুক্ত করা বৈধ নয়)। ইমাম তাহাবি (রহ.) বলেন, একটি ছাগল দুজনের পক্ষ থেকে বৈধ নয়। তিনি উল্লিখিত বিধানকে রহিত বলেন।’ (আশ শামাইলুশ শরিফাহ : ১/৩২৯)
আমরা মনে করি, রহিত বলার দরকার নেই। কেননা রাসুলের কোরবানি নফল ছিল। তিনি তো সম্পদ জমা রাখতেন না। তাই তিনি নিসাবের মালিক থাকতেন না। তাঁর ওপর জাকাত ফরজ ছিল না। তিনি নফল সদকা করতেন, তেমনি তাঁর কোরবানি নফল ছিল। আর নফল কুরবানিতে একাধিক ব্যক্তির নিয়ত করা যায়। কেননা তাতে কুরবানি দাতার জন্য হয় আর পুণ্য সবার জন্য পৌঁছে যায়। নফল কোরবানির জন্য অনুমতিও লাগে না। কারো নামে ওয়াজিব কুরবানিকরার জন্য অনুমতি লাগে। বিদায় হজেও মহানবী (সা.) দুটি ভেড়া জবেহ করেছেন। এক হাদিসে এসেছে : ‘অতঃপর (বিদায় হজের ভাষণের পর) তিনি চিত্রবিচিত্র দুটি ভেড়া নিলেন ও তা জবেহ করলেন। একটি ছাগলের পাল তিনি সাহাবাদের মধ্যে বণ্টন করেন।’ (মুসলিম, হাদিস : ১৬৭৯)
হজের সময় তিনি তাঁর স্ত্রীদের জন্য কুরবানি করেছেন। সেটা ছিল তাঁদের অনুমতিবিহীন। কেননা তা নফল কোরবানি ছিল। আর নফল কোরবানির জন্য অনুমতি লাগে না। হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, “আমরা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে জিলকদের ২৫ তারিখে বের হলাম, তখন আমরা হজের নিয়ত করেছি। যখন আমরা মক্কার কাছে গেলাম তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) আমাদের মধ্যে যারা ‘হাদি’র প্রাণী আনেনি, তাদের ইহরাম খুলে ফেলার নির্দেশ দিলেন। তখন আমাদের মধ্যে কোরবানির দিন গরুর গোশত বিতরণ করা হলো। আমি (বাহককে) বললাম, এটা কী? বাহক বলল, রাসুলুল্লাহ (সা.) বিবিদের পক্ষ থেকে গরু কোরবানি করেছেন।” (বুখারি, হাদিস : ১৭০৯)
বিদায় হজে মহানবী (সা.) ‘দমে শোকর’ হিসেবে ১০০টি উট কুরবানি করেছেন। ৬৩টি উট তিনি নিজে জবেহ করেছেন আর বাকিগুলো হজরত আলী (রা.) জবেহ করেছেন। হজরত জাবির (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘নবী (সা.) একটি উট হাদি দিলেন। আর জবেহতে এক-তৃতীয়াংশে আলী (রা.)-কে শরিক করলেন।’ (ত্বহাবি, হাদিস : ৬২৩৬)
মহানবী (সা.) তাঁর কোরবানি থেকে নিজেও খেতেন, পরিবারকেও আহার করাতেন, গরিব ও আত্মীয়স্বজনকেও আহার করাতেন। বিখ্যাত হাদিসগ্রন্থ আবু দাউদের ব্যাখ্যাগ্রন্থ আউনুল মাবুদে এসেছে—‘মহানবী (সা.)-এর নিয়মিত অভ্যাস ছিল কুরবানির গোশত তিনি নিজে খেতেন, পরিবারকে আহার করাতেন ও মিসকিনদের মধ্যে সদকা করতেন আর তিনি উম্মতকেও তার নির্দেশ দিয়েছেন।’ (আউনুল মাবুদ, খণ্ড ৭, পৃ.৩৪৫)
হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর পরিবারকে কুরবানির এক-তৃতীয়াংশ আহার করাতেন, প্রতিবেশীদের এক-তৃতীয়াংশ আহার করাতেন আর ভিক্ষুকদের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ সদকা করতেন।’ (মুগনি, খণ্ড ৯, পৃ. ৪৪৯)
এসব বর্ণনার আলোকে ফুকাহায়ে কেরাম বলেন, কুরবানির গোশত তিন ভাগ করা মুস্তাহাব। এক ভাগ নিজের ও নিজের পরিবারের জন্য, আরেক ভাগ আত্মীয়স্বজনের জন্য, আরেক ভাগ গরিবদের জন্য। তবে কারো পরিবারের সদস্য বেশি হলে সবটুকু গোশত রেখে দিলেও কোনো ক্ষতি হবে না।
কোরবানির জন্তু—উট, গরু, মহিষ, দুম্বা, ভেড়া ও ছাগল দ্বারা কুরবানি করা জায়েজ। অন্যান্য জন্তু দ্বারা কোরবানি নাজায়েজ। ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা কমপক্ষে এক বছর পূর্ণ হতে হবে, গরু-মহিষ দুই বছর পূর্ণ হতে হবে, উট পাঁচ বছর পূর্ণ হতে হবে। (হিদায়া, খণ্ড ৪, পৃ. ১০৩)
সাধারণত যেসব পশু দামি তা-ই উত্তম। দামে সমান হলে যে পশুর গোশত বেশি তা উত্তম। তাতেও সমান হলে যে পশুর গোশত ভালো তা উত্তম। নিতাফ ফিল ফতওয়া কিতাবে এসেছে—‘সবচেয়ে উত্তম হলো উট কোরবানি, অতঃপর গরু (ও মহিষ), অতঃপর ভেড়া (ও দুম্বা), অতঃপর ছাগল। আর উট, গরু (ও মহিষ)-এ সাতজন শরিক হতে পারে, ভেড়া (ও দুম্বা) ও ছাগলে একজনই করতে পারে।’ (নিতাফ ফিল ফতওয়া, খণ্ড ১, পৃ. ২৩৮)।
এর আলোকে বোঝা যায়, কুরবানিতে উট উত্তম, অতঃপর গরু-মহিষ, অতঃপর ভেড়া-দুম্বা, অতঃপর ছাগল, অতঃপর উট, গরু-মহিষের এক অংশ।
আর দুম্বায় মাদির চেয়ে নর উত্তম। ছাগলের মধ্যে ছাগি উত্তম, ছাগির চেয়ে খাসি উত্তম। উট ও গরুর মধ্যে মূল্য সমপরিমাণ হলে মাদিই উত্তম।
কোরবানি একটি মহৎ কাজ। এর মাধ্যমে মহান আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করা যায়। হাদিসের ভাষ্য মতে, কোরবানির জন্তু পুলসিরাতের বাহন হবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) হিজরত করার পর প্রতিবছর কুরবানি দিতেন। নফল হিসেবে তিনি উম্মতকেও তাতে শরিক করতেন। আমাদের উচিত, মহানবী (সা.) যেভাবে কুরবানি আদায় করেছেন, সেভাবে কোরবানি আদায় করা।
লেখক : লেকচারার, আরবি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
মন্তব্য চালু নেই