ভোট জালিয়াতির চাঞ্চল্যকর তথ্য

তিন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ভোট কারচুপি, জাল ভোট প্রদান, ফল জালিয়াতিসহ নানা অনিয়মের চাঞ্চল্যকর চিত্র এখনও বেরিয়ে আসছে। নির্বাচনে পরাজিত প্রার্থীরা এসব অনিয়মের বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত এবং ভোটগ্রহণ সময়ের অনিয়মের স্থির ও ভিডিও চিত্রসহ নানা অভিযোগ নির্বাচন কমিশন (ইসি) ও সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং কর্মকর্তাদের কাছে দায়ের করছেন। এতে ফল জালিয়াতির মাধ্যমে জয়ী প্রার্থীকে পরাজিত এবং পরাজিত প্রার্থী জয়ী ঘোষণার মতো ভয়ানক অভিযোগও রয়েছে। প্রার্থীরা এসব ঘটনার প্রতিকার এবং নির্বাচনের ফলাফলের গেজেট প্রকাশ না করতে ইসির কাছে অনুরোধ জানিয়েছেন। তবে ওইসব অভিযোগ আমলে নিচ্ছে না ইসি। ফল প্রকাশের পর ইসির এ বিষয়ে করণীয় কিছু নেই জানিয়ে সংক্ষুব্ধ প্রার্থীদের নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালে যাওয়ার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে।

এদিকে ইসির একাধিক সূত্র জানিয়েছে, তিন সিটিতে ভোটগ্রহণ ও ফলাফল ঘোষণার দৃশ্য ধারণের জন্য ৫৮টি কেন্দ্রে সিসি ক্যামেরা বসানোর কথা ছিল। কিন্তু আইনশৃংখলা বাহিনী, কেন্দ্র দখলকারী ও জালভোট প্রদানকারীদের বাধা ও যথাযথ প্রস্তুতি না থাকায় ওইসব কেন্দ্রের সার্বক্ষণিক দৃশ্য ধারণ করতে পারেননি দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা। ভিডিও করার সময় অন্তত দুটি ক্যামেরা ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনা ঘটে। ঢাকা উত্তর সিটিভুক্ত এলাকার একজন সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে জোরপূর্বক ভিডিও চিত্র মুছে ফেলার অভিযোগ পাওয়া গেছে। নির্বাচন কমিশন ঘুরে দেখা গেছে, নির্বাচনের অনিয়ম নিয়ে বৃহস্পতিবারও অনেক প্রার্থী নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ করতে এসেছেন। কয়েকজন প্রার্থী ইসির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করে এসব বিষয়ে করণীয় নিয়ে আলোচনা করেছেন। অনিয়মের ঘটনা প্রতিকারে সন্তোষজনক উত্তর না পেয়ে হতাশা প্রকাশ করেন কেউ কেউ।

এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে নির্বাচন কমিশন সচিব মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, প্রার্থীদের অভিযোগ আমলে নেয়ার কোনো সুযোগ এ মুহূর্তে নেই। ভোটে জয়ীদের গেজেট প্রকাশ করা হবে। ওই গেজেট প্রকাশের পর অভিযোগকারীরা নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালে যেতে পারেন। ওইসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ট্রাইব্যুনালের রায় অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে নির্বাচন কমিশন।

ফলাফল জালিয়াতি নিয়ে অভিযোগকারীদের একজন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের ২৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আবদুস সবুর লিটন। তিনি অভিযোগ করেছেন, প্রথমে তাকে জয়ী ঘোষণা করা হলেও পরে কারসাজি করে ওই ফল পরিবর্তন করে এসএম এরশাদ উল্লাহকে জয়ী ঘোষণা করা হয়েছে। অভিযোগের সপক্ষে প্রমাণ হিসেবে তিনি চট্টগ্রাম মহানগরীর ডিউ পয়েন্ট স্কুল কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসারের স্বাক্ষর করা ফলাফলের দুটি শিট উপস্থাপন করেন। প্রিসাইডিং কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবুল বশর স্বাক্ষরিত একটি শিটে দেখা গেছে, চারজন কাউন্সিলর প্রার্থীর মধ্যে আবদুস সবুর লিটন টিফিন ক্যারিয়ার প্রতীকে ২৪ ভোট, এসএম এরশাদ ৬১ ভোট, ফয়েজ আহামেদ ৩২ ভোট ও শহীদ মো. চৌধুরী ২২৬ ভোট পেয়েছেন। ওই কেন্দ্রে সবমিলিয়ে ৩৪৩টি বৈধ ভোট পড়েছে। বাতিল ভোট পড়েছে ৩২৭টি। মোট প্রদত্ত ভোট ৬৭০টি।

আবদুস সবুর লিটনের অভিযোগ, প্রতিপক্ষের লোকজন প্রিসাইডিং কর্মকর্তাকে চাপ দিয়ে ওই কেন্দ্রের ভোটের ফল জালিয়াতির মাধ্যমে আরেকটি ফলাফল শিট তৈরি করে এসএম এরশাদ উল্লাহকে ৬১ ভোটের স্থলে ৩৮১টি ভোট দেখানো হয়েছে। অর্থাৎ এক কেন্দ্রেই ৩২০ ভোট বাড়িয়ে তাকে জয়ী করা হয়েছে। দ্বিতীয় ফলাফল শিটে দেখা গেছে, প্রথম ফলাফল শিটে ৩২৭টি বাতিল ভোট দেখানো হলেও দ্বিতীয় শিটে বাতিল ভোট ৭টি দেখানো হয়েছে। আর এসএম এরশাদ উল্লাহর ভোট ৩৮১টি উল্লেখ রয়েছে। বাকি প্রার্থীদের ভোটের সংখ্যা হেরফের হয়নি। এ বিষয়ে মঙ্গলবার রাত ১টায় চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. আবদুল বাতেনের কাছে অভিযোগ করেও প্রতিকার পাননি বলে জানান আবদুস সবুর লিটন। এ বিষয়ে জানতে চেয়ে মো. আবদুল বাতেনকে ফোন দিয়ে পাওয়া যায়নি।

ভোট জালিয়াতির আরেক অভিযোগ দায়ের করেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ৫৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী মো. মনির হোসেন। তিনি বলেন, ভোট গ্রহণের দিন একজন কাউন্সিলর প্রার্থী অবৈধভাবে কেন্দ্র দখল করে ব্যালট পেপারে সিল মারে। ওই দৃশ্য মোবাইলে ধারণকৃত ভিডিও ফুটেজে ওঠে এসেছে। তারপরও আমি বেশিরভাগ কেন্দ্রে বিপুল ভোটে এগিয়ে থাকি। এ অবস্থায় রাত ১০টা পর্যন্ত ফল ঘোষণা না করে ফলাফল শিটে জালিয়াতি করে আরেকজন প্রার্থীকে জয়ী করার চেষ্টা হয়। অভিযোগে তিনি উল্লেখ করেন, ২০টি কেন্দ্রের মধ্যে ১৪টির ফলাফল শিটে প্রার্থীদের পোলিং এজেন্টদের স্বাক্ষর রয়েছে। বাকি ৬টি কেন্দ্রের শিটে জয়ী বা পরাজিত কোনো প্রার্থীর পোলিং এজেন্টদের স্বাক্ষর নেই। ভোট গণনার আগে পোলিং এজেন্টদের জোরপূর্বক ফল শিটে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করা হয় এবং প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যা হেরফের রয়েছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী মো. সামছুল হুদা কমিশনে কেন্দ্র দখল ও ভোট জালিয়াতির অভিযোগ এনে আবার নির্বাচন দাবি করেছেন। একই সিটির ৩১ নম্বর ওয়ার্ডের জুনায়েদ আদেল নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ এনে পুনর্নির্বাচনের জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন।

ক্যামেরায় দৃশ্য ধারণে বাধা : তিন সিটি নির্বাচনে ভোটগ্রহণ পরিস্থিতির দৃশ্য ধারণে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণে ২৩টি করে মোট ৪৬টি ও চট্টগ্রামে ১২টি সবমিলিয়ে ৫৮টি কেন্দ্রে ক্যামেরা বসানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল নির্বাচন কমিশন (ইসি)। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভিডিও দৃশ্য ধারণে ক্ষমতাসীনরা ও আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা বাধা দিয়েছেন। জাল ভোটের দৃশ্য ধারণ করায় দুটি ক্যামেরা ছিনিয়ে নিয়ে যাওয়ার হয়। ওইসব ক্যামেরায় ধারণকৃত ভিডিও মুছে ফেলে তা ফেরত দেয়া হয়েছে। এসব কারণে ক্যামেরাগুলোতে নির্বাচনের সার্বক্ষণিক দৃশ্য ধারণ করা সম্ভব হয়নি বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। দায়িত্বপ্রাপ্ত একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ঢাকা উত্তর সিটি এলাকায় একটি কেন্দ্রে জালভোটের দৃশ্য ক্যামেরায় ধারণ করায় স্থানীয় সংসদ সদস্য নিজে ওই ভিডিও ফুটেজ মুছে ফেলতে বাধ্য করেছেন।

তারা আরও বলেন, ভিডিও দৃশ্য ধারণ করার ক্ষেত্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণ ও লজিস্টিক সাপোর্ট দেয়া হয়নি। ভিডিও দৃশ্য ধারণের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের আইটি ইঞ্জিনিয়ার মো. মশিউর রহমান এবং আল সেইন্টস নার্সারি অ্যান্ড হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক বাহাউদ্দিন মৃধার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা বলেন, ভোট গ্রহণের আগের রাতে আমাদের নিয়োগ চূড়ান্ত করা হয়। কমিশন থেকে ওয়েবক্যাম ও ল্যাপটপ দেয়া হয়নি। নিজস্ব ক্যামেরায় কিছু সময়ের ভিডিও দৃশ্য ধারণ করেন বলে জানান তারা। যুগান্তর



মন্তব্য চালু নেই