ভেতরে-বাইরে রাজনৈতিক চাপে খালেদা জিয়া
রাজনৈতিকভাবে ঘরে বাইরে চাপের মুখে রয়েছেন বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া। কেন্দ্রীয় কমিটি পুনর্গঠনে দীর্ঘসূত্রতায় বিএনপিতে এক ধরনের অস্থিরতা, চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে। দলের অঙ্গসংগঠনগুলোর পুনর্গঠন ঘিরেও নেতাদের মধ্যে চলছে প্রতিযোগিতা। পদ পদবীর এসব প্রতিযোগিতা কাদা ছোড়াছুড়িতে রূপ নিচ্ছে। বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটিতে চাহিদা মতো পদ-পদবী ভাগিয়ে নিয়ে অথবা নিজেদের প্রভাব টিকিয়ে রাখতে দলটির শীর্ষ পর্যায়ের নেতারাও এক পক্ষ অপর পক্ষকে ঘায়েল করার চেষ্টা চালাচ্ছেন।
এদিকে সরকারবিরোধী আন্দোলনে ব্যর্থ বিএনপি যখন পুনর্গঠনের মাধ্যমে শক্তিশালী হয়ে নতুন নির্বাচন আদায়ে রাজপথে সক্রিয় রাজনীতিতে আসার লড়াই করছে তখন একের পর এক বিতর্কের জড়াইয়ে যাচ্ছেন দলের কেউ কেউ। যে বিতর্ক সামাল দিতে বিএনপি হাইকমান্ড হিমশিম খাচ্ছেন। সর্বশেষ স্পর্শকাতর একটি বিষয়ে নতুন করে এক বিতর্কের সৃষ্টি করেছেন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব আসলাম চৌধুরী। চট্টগ্রামের এই নেতা সম্প্রতি দিল্লি সফরে ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন এমন সংবাদ গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।
বৈঠকের পর বিএনপি নেতার সঙ্গে ইসরাইলের সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল ডিপ্লোমেসি অ্যান্ড অ্যাডভোকেসির প্রধান ও লিকুদ পার্টির নেতা মেন্দি এন সাফারির ছবিও প্রকাশ পেয়েছে। এরপর থেকেই রাজনৈতিক অঙ্গনে এই ঘটনা তোলপাড় হয়। ক্ষমতাসীন সরকারের পক্ষ থেকে অভিযোগ তোলা হয়েছে বিএনপি ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সঙ্গে মিলে সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। যদিও এই ঘটনার দায়-দায়িত্ব বিএনপি নিতে অস্বীকার করেছে।
চেয়ারপার্সনের গুলশান কার্যালয় ঘিরে কয়েক কর্মকর্তার প্রভাব নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই দলটির অভ্যন্তরে নানা আলোচনা-সমালোচনা রয়েছে। এমনকি চলমান ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন ও নতুন কমিটির পদ-পদবীর জন্য একটি প্রভাবশালী অংশ আর্থিক বাণিজ্যে লিপ্ত রয়েছে বলেও বিএনপিতে প্রকাশ্যে অভিযোগ রয়েছে। এসব কারণে সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপির অভ্যন্তরীণ নানা ঘটনা গণমাধ্যমে পর্যন্ত চলে এসেছে। যার বহির্প্রকাশ ঘটেছে বিএনপির নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সর্বশেষ বৈঠকেও।
সোমবার বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার সভাপতিত্বে দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে কাউন্সিলের পর দলের পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনে বিলম্ব, নিজেদের মধ্যে কাঁদা ছোড়াছুড়িসহ মনোনয়ন ও কমিটি বাণিজ্য নিয়ে খোলামেলা অভিযোগ করেছেন স্থায়ী কমিটির বেশ কয়েক নেতা। স্থায়ী কমিটির নেতারা এসব বিষয়ে দলীয় চেয়ারপার্সনের কঠোর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। কোনো কোনো নেতা পদ বাণিজ্যর সঙ্গে জড়িত তা খতিয়ে দেখারও পরামর্শ দিয়েছেন। একইসঙ্গে কাউন্সিলের পর কেন্দ্রীয় কমিটি গঠনে কেন এত সময় নেয়া হচ্ছে এ ব্যাপারেও প্রশ্ন তোলা হয়।
বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, জবাবে খালেদা জিয়া এসব অভিযোগের বিষয়ে ক্ষমতাসীন সরকারের ষড়যন্ত্রকে দায়ী করেছেন। ঢাকা মহানগর, যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দল পুনর্গঠনের বিষয়ে স্থায়ী কমিটির সদস্যদের অবহিত করেন। ঢাকা মহানগর দুইভাবে বিভক্ত করারও ইঙ্গিত দিয়েছেন। দলের শীর্ষ নেতাদের তিনি জানিয়েছেন, দলের কেন্দ্রীয় কমিটি পুনর্গঠনের প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। যথা সময়েই বাকি পদগুলোর ঘোষণাও দেয়া হবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব) মাহাবুবুর রহমান জানান, স্থায়ী কমিটির বৈঠকে চলমান ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন, দল পুনর্গঠনসহ সার্বিক পরিস্থিতি আলোচনা হয়েছে। সেখানে দলের নতুন কমিটিকে ঘিরে যেসব নেতিবাচক আলোচনা হচ্ছে তা নিয়েও কথা হয়েছে। এসব বিষয়ে খতিয়ে দেখার কথা জানিয়েছেন আমাদের চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া। বিএনপির এই নীতিনির্ধারক বলেন, আমাদের কেন্দ্রীয় কমিটি গঠনের পক্রিয়ায় এগিয়ে যাচ্ছে। খুব শিগগিরি নতুন কমিটি পুনর্গঠনের প্রক্রিয়া শেষ হবে।
কাউন্সিলের মাধ্যমে কমিটি গঠনে সর্বময় ক্ষমতাপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া এ পর্যন্ত দেড় মাসে নতুন কমিটির মহাসচিবসহ ৪১টি পদের নাম ঘোষণা করেছেন। এখনো স্থায়ী কমিটি, ভাইস চেয়ারম্যানসহ দলের গুরুত্বপূর্ণ নির্বাহী কমিটির সম্পাদকীয় পদগুলো ঘোষণার বাকি রয়েছে। ১৯ মার্চ রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তন ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নানা প্রতিকূলতার মধ্যেই বিএনপির ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। যেখানে কাউন্সিলররা দল পুনর্গঠনে সর্বসময় ক্ষমতা দলের চেয়ারপার্সনের ওপর অর্পণ করেছেন। কিন্তু দেড় মাসেরও বেশি সময় হয়ে গেলেও বিএনপির পূর্ণাঙ্গ নির্বাহী কমিটি গঠন করতে পারছেন না খালেদা জিয়া।
এদিকে সর্বশেষ স্পর্শকাতর একটি বিষয়ে নতুন করে এক বির্তকের সৃষ্টি করেছেন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব আসলাম চৌধুরী। চট্টগ্রামের এই নেতা সম্প্রতি দিল্লি সফরে ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন এমন সংবাদ গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। বৈঠকের পর বিএনপি নেতার সঙ্গে ইসরাইলের সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল ডিপ্লোমেসি অ্যান্ড অ্যাডভোকেসির প্রধান ও লিকুদ পার্টির নেতা মেন্দি এন সাফারির ছবিও প্রকাশ পেয়েছে। এরপর থেকেই রাজনৈতিক অঙ্গনে এই ঘটনা তোলপাড় হয়। ক্ষমতাসীন সরকারের পক্ষ থেকে অভিযোগ তোলা হয়েছে বিএনপি ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সঙ্গে মিলে সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে।
যদিও এই ঘটনার দায়-দায়িত্ব বিএনপি নিতে অস্বীকার করেছে। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সরকারের অভিযোগ নাকচ করে দিয়ে বলেছেন, ইসরাইলের সঙ্গে বিএনপির কোনো সম্পর্ক নেই। আসলাম চৌধুরী তার ব্যক্তিগত কাজে দিল্লি গেছেন। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের জের ধরে বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া আসলাম চৌধুরীকে তার কার্যালয়েও তলব করেছেন। সেখানে তার কাছে এই ঘটনার ব্যাখ্যা চেয়েছেন। জবাবে আসলাম চৌধুরী জানিয়েছেন তিনি ব্যক্তিগত কাজে দিল্লি গিয়েছিলেন। সেখানেই তার একজনের সঙ্গে পরিচয় হয়। যার মাধ্যমে একটি সেমিনারে তিনি অংশ নিয়েছিলেন। এরপর কয়েকজন মিলে ছবিও তোলা হয়েছে। এসব ছবি কিভাবে পত্রিকায় এসেছে তিনি জানেন না।
আসলাম চৌধুরী আরো বলেছেন, তিনি জানতেন না মেন্দি এন সাফারি ইসরাইলের লিকুদ পার্টির নেতা। এ ঘটনার জন্য বিএনপি সমালোচনার মুখে পড়েছে এমন কথা স্বীকার করে প্রয়োজনে দলের পদ ছাড়ার কথা জানান এই নেতা। নতুন জাতীয় নির্বাচন আদায়ে বিএনপি বরাবর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ওপর নির্ভরশীল থাকতে দেখা গেলেও সাম্প্রতিক সময়ে দলটির কূটনৈতিক যোগাযোগের ঘাটতি নিয়েও দলের মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে। বিশেষ করে একদিনের ব্যবধানে ঢাকা সফররত কুয়েতের প্রধানমন্ত্রী শেখ জাবের আল-মুবারক আল-হামাদ আল-সাবাহ ও যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই বাংলাদেশ সফর করলেও বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ না করার ঘটনা দলের নেতারা নেতিবাচক হিসেবে বিবেচনা করছেন।
বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া বিরোধী দলের নেতা না হলেও বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশ সফররত বিদেশি রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা তার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করে থাকেন। এমনকি সরকারের বাধার মুখে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও ঢাকা সফরে বিএনপি চেয়ারপার্সনের সঙ্গে বৈঠক করেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএনপির প্রভাবশালী এক নেতা জানান, বিএনপির আর্ন্তজাতিক বিষয়ক বিষয়াদি দেখভাল করেন এমন নেতাদের ওপর সরকার নানাভাবে চাপ সৃষ্টি করেছে। সরকারের চাপ নির্যাতনের কথা ভেবে অনেকেই হয়তো নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছেন। শফিক রেহমানের গ্রেফতার এবং ড. ওসমান ফারুকের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ আনার প্রসঙ্গও তুলে ধরেন ওই নেতা। এর একটা প্রভাব দলের ওপর পড়েছে বলে তিনি মনে করেন।
বিএনপির এই নেতা বলেন, তবে সৌজন্য সাক্ষাত না হওয়ায় সামগ্রিকভাবে বিএনপির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক কমে গেছে বিষয়টা এমন নয়। বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য বলেন, বিএনপির নতুন নির্বাচন আদায়ের দাবির সঙ্গে এখনো যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় একমত পোষণ করে। বিভিন্নভাবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কাছে তাদের সে কথা তুলে ধরেছেন।-মানবকন্ঠ
মন্তব্য চালু নেই