ভিসির বাসভবনে বিউটি পার্লার!
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর ড. খোন্দকার নাসির উদ্দিনের বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির বিস্তর অভিযোগ উঠেছে। ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত শিক্ষক প্যানেল সোনালি দলের সাবেক এ যুগ্ম সম্পাদকের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনেও (দুদক) অভিযোগ করা হয়েছে। ভর্তি বাণিজ্য থেকে শুরু করে নিয়মবহির্ভূত নিয়োগ বাণিজ্য, ক্যাম্পাসে নিজের বাসভবনে বিউটি পার্লার দিয়ে জমজমাট ব্যবসা চালানের অভিযোগও রয়েছে ছাত্রদলের যুক্তরাজ্য শাখার সাবেক এই নেতার বিরুদ্ধে। তার এ স্বেচ্ছাচারিতায় কেউ মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছেন না। তবে ভেতরে ভেতরে অনেকেই ভিসির এ আচরণে ক্ষুব্ধ।
কোটালীপাড়া উপজেলার হিরণ গ্রামের মো. মোদাচ্ছের খানের ছেলে শাওন খান এরই মধ্যে ভিসি নাসির উদ্দিনের বিরুদ্ধে দুদক চেয়ারম্যানের কাছে অভিযোগ করেছেন। সেখানে তিনি তার বিরুদ্ধে নানা আর্থিক অনিয়ম, শিক্ষক ও কর্মচারী নিয়োগে অনিয়মের চিত্র তুলে ধরেছেন। এর পাশাপাশি তিনি ভিসির কবল থেকে পাবলিক এ বিশ্ববিদ্যালয়কে রক্ষারও আহ্বান জানিয়েছেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দুর্নীতি দমন কমিশন সম্প্রতি ওই অভিযোগের ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) মাধ্যমে ৭ কর্মদিবসের মধ্যে ব্যাখ্যা চেয়েছে।
এ ব্যাপারে ভিসি প্রফেসর ড. খোন্দকার নাসির উদ্দিনের বক্তব্য জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘আমার থেকে অনেক যোগ্য লোক থাকার পরও গোপালগঞ্জের ছেলে হিসেবে প্রধানমন্ত্রী আমাকে এ পদে নিয়োগ দিয়েছেন। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছি। কতিপয় বাইরের শিক্ষক আমার বিরোধিতা করে চলেছেন। দুদকে অভিযোগ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘ওটার জবাব দেয়া লাগবে না। ওপর থেকে আমি এসব ম্যানেজ করে ফেলেছি।’ এছাড়া তার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ অস্বীকার করে ভিসি বলেন, ‘এসব অভিযোগের কোনো ভিত্তি নেই।’
অভিযোগ রয়েছে, তার আমলে শিক্ষাগত যোগ্যতা শিথিল করে এমএলএসএস পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে শিক্ষাগত যোগ্যতা হিসেবে এসএসসি বা সমমানের পাসের কথা বলা হলেও অষ্টম শ্রেণী পাস প্রার্থীদেরও নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
এর পাশাপাশি বিভিন্ন কর্মকর্তা-কর্মচারী পদে শিক্ষাজীবনে তৃতীয় বিভাগ বা ২ দশমিক ৫০ গ্রেডের প্রার্থীদেরও নিয়োগ প্রদান করেছেন, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রচলিত নিয়োগবিধির পরিপন্থী। অথচ নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে ন্যূনতম যোগ্যতা লেখা ছিল দ্বিতীয় বিভাগ। ভিসির বিরুদ্ধে আরও অভিযোগের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপন প্রকল্পের (অব্যয়িত) প্রায় ১ কোটি ৬০ লাখ টাকা ভুয়া ভাউচারের মাধ্যমে তুলে নিয়ে আত্মসাৎ এবং প্রায় ২ কোটি টাকার অধিক মূল্যের বই ক্রয়ের অভিযোগ ছাড়াও দুই থেকে তিনগুণ অধিক মূল্যে কোটি টাকার বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি ক্রয়ের বিষয়টিও রয়েছে।
ভর্তি বাণিজ্যেরও অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। অনৈতিক সুবিধা নিয়ে ‘ভিসি কোটার নামে তিনি নিয়মবহির্ভূতভাবে ফার্মেসি বিভাগ, আইন বিভাগ ও বায়ো টেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে ভর্তি করানোর অভিযোগ রয়েছে। তথ্যপ্রমাণে দেখা যাচ্ছে, ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষে ফার্মেসি বিভাগে মেধাক্রম ২০৮৪ নিয়েও ভর্তি হয়েছেন মারিয়া খানম নামের এক শিক্ষার্থী। ১৩৩৩ মেধাক্রম নিয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হয়েছেন ওবায়দুর রহমান নামে একজন ছাত্র। অথচ এসব বিভাগে এক থেকে ১৫০ জন ছাত্রের বেশি ভর্তি হওয়ার কথা নয়। এর বাইরে বায়ো টেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে ভর্তি পরীক্ষায় ফেল করেও ভর্তি হয়েছেন মো. আকাশ নামে এক শিক্ষার্থী। ‘ভিসি কোটা’র নামে অনেক বিভাগে বিধিবহির্ভূতভাবে আরও অনেক শিক্ষার্থী ভর্তির অভিযোগ রয়েছে। একটি সূত্র বলছে, ভর্তিতে মুক্তিযোদ্ধাসহ অন্যান্য কোটা থাকলেও ভিসি কোটা বলতে কোনো কিছু নেই। এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে কথা বলতে গিয়ে অনেক শিক্ষকের কপালে জুটেছে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কারের হুমকি।
ভিসি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের নিজের বাংলোয় সম্প্রতি প্রাথমিক বিদ্যালয় ছাড়াও একটি বিউটি পার্লার খুলে বসেছেন। ভিসি নিজে বিউটি পার্লার দেখভাল করেন। অনুসন্ধানে এ প্রতিবেদকের ক্যামেরায় ধরা পড়েছে যে, ভিসি নিজে বিউটি পার্লারের সিরিয়াল মেনটেন করছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আগের ভিসি প্রফেসর ড. খায়রুল আলম খানের সময় একজন শিক্ষার্থী ৩-৪ হাজার টাকায় ভর্তি হতে পারতেন। এখন ভর্তিতে লাগছে ১৪-১৫ হাজার টাকা। শিক্ষার্থীরা এ নিয়ে এর আগে আন্দোলন করলেও তাতে তিনি গা-করেননি। অভিযোগ রয়েছে, নতুন ভিসির স্বেচ্ছাচারিতায় অনেক সিনিয়র শিক্ষক চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। তাদের জায়গায় অনভিজ্ঞ শিক্ষকদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এর ফলে শিক্ষার্থীরা ভালো শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কিছু শিক্ষক অভিযোগ করেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০১ সালের ১৩ জুলাই বঙ্গবন্ধুর নামে বিশ্ববিদ্যালয়টির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। পরবর্তী সময়ে ২০০২ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়। পরে ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিশ্ববিদ্যালয়টির কার্যক্রম পুনরায় চালু করা হয়।
মন্তব্য চালু নেই