ভাষা আন্দোলনের ওপর কোনো চলচ্চিত্র নেই কেন?

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষার জন্য রক্ত দিয়েছিলেন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারের মতো তাজা প্রাণ। এই দিনকে সম্মান জানাতে, নিজের ভাষাকে শ্রদ্ধা দেখাতে বিশ্ববাসী ২১ ফেব্রুয়ারিকে মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করে। অথচ এই ভাষা আন্দোলন নিয়ে এ পর্যন্ত কোনো চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয়নি বাংলাদেশে। কিন্তু কেন? এ বিষয়ে এনটিভি অনলাইনের কথা হয় চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ব্যক্তির সঙ্গে।
ভাষা আন্দোলন নিয়ে কেন তরুণ প্রজন্ম চলচ্চিত্র নির্মাণ করছে না, এই প্রশ্ন বিশিষ্ট চলচ্চিত্রকার আমজাদ হোসেনের। তিনি তরুণদের উদ্দেশে বলেন, ‘তোমাদের দেশ স্বাধীন করতে হবে না। ভাষার জন্য রক্ত দিতে হবে না। সিনেমা বানাতে হবে। সিনেমা বানানো ওসবের থেকে সোজা। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সারাজীবন চলচ্চিত্র নির্মাণ করলেও যেমন শেষ হবে না। তেমনি ভাষা আন্দোলন নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করলেও হাজার ছবি করা যায়। তোমাদের এগিয়ে আসতে হবে। জানি সরকারি অনুদানের টাকায় ওই ছবি নির্মাণ করা সম্ভব নয়। তবুও আমি মনে করি, কেউ উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে এলে সরকারের বিশেষ সহযোগিতায় ঠিকই এটি করা সম্ভব। আমার নতুন প্রজন্মের ওপর বিশ্বাস আছে, অবশ্যই তারা আজ না হোক কাল ভাষা আন্দোলন নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণে এগিয়ে আসবে।’
বাংলাদেশ চলচ্চিত্র অনুদান কমিটির সদস্য ও চলচ্চিত্রকার নাসির উদ্দিন বাচ্চু বলেন, ‘ব্যক্তি উদ্যোগে ভাষা আন্দোলন নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করা সম্ভব নয়। কারণ গেরিলা করতে গিয়ে আমার অনেক টাকা খরচ হয়েছে। স্ত্রীর ফ্ল্যাট, মেয়ের টাকা, আমার কাছে যা ছিল সেই টাকা, এমন কি বন্ধু-আত্মীয়দের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়েছি। যা এখনো ফেরত আনতে পারিনি। গেরিলা ছবিতে মাত্র কয়েকটি দৃশ্য করতে গিয়েই আমার এত টাকা চলে গেছে। এখন যদি ৫২ সালের ভাষা আন্দোলন নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করি, সেই পরিবেশ ফুটিয়ে তুলতে চাই, তাতে আরো কয়েক গুণ টাকা বেশি খরচ করতে হবে। যা ব্যক্তি উদ্যোগে করা সম্ভব নয়।’
অনুদানের চলচ্চিত্রে ভাষা আন্দোলন উপেক্ষিত কেন? জানতে চাইলে নাসির উদ্দিন বলেন, ‘যেসব ছবির মাধ্যমে দেশের উপকার হবে, যেসব ছবি দেশের ইতিহাস তুলে ধরবে, সেই ছবিকে অনুদান দেওয়া হয়। কিন্তু ভাষা নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য কোনো আবেদন তো কেউ করে না। আবার অনুদানে যে টাকা পাওয়া যায় তা দিয়ে ভাষা আন্দোলনের গল্পটা ফুটিয়ে তোলা কঠিন। একমাত্র সরকারের বিশেষ উদ্যোগে ভাষা আনন্দোলন নিয়ে ছবি নির্মাণ সম্ভব।’
এ বিষয়ে বাংলাদেশ চিত্রপরিচালক সমিতির মহাসচিব মুশফিকুর রহমান গুলজার বলেন, ‘৫২ সালের চিত্র ক্যামেরায় তুলে আনতে অনেক টাকার প্রয়োজন। একাত্তরের চলচ্চিত্র বানাতে গিয়ে গ্রামের দিকে চলে গেলেই অনেকটা তুলে আনা যায়। সাথে পোশাক ও সজ্জা ঠিক মতো দিতে পারলেই হলো। কিন্তু ভাষা আন্দোলনের জন্য সেটা অনেক কঠিন হবে। সাধারণ ছবির তুলনায় অনেক বেশি কষ্ট করে ছবিটি তৈরি করতে হবে। আবার প্রযোজক টাকা ফেরত পাবে না। কারণ সাধারণ দর্শক হলে ছবিটি দেখতে যাবে না। তো কেন একজন প্রযোজক টাকা দেবে ছবিটি বানানোর জন্য?’
মুশফিকুর রহমান গুলজার এরই মধ্যে ‘লাল সবুজের সুর’ নামে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক একটি চলচ্চিত্রের শুটিং শেষ করেছেন, আগামী ২৬ মার্চ ছবিটির মুক্তি দেওয়ার কথা রয়েছে। এই ছবি সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমি এই চলচ্চিত্র বানাচ্ছি সরকারি অনুদানের টাকায়। যে কারণে এখানে বাড়তি টাকা খুব বেশি খরচ হয়নি। যা হয়েছে তা যেকোনো টিভিতে বিশেষ দিনে প্রচার করলেই উঠে আসবে। যে কারণে এই চলচ্চিত্র নিয়ে ক্ষতির হিসাব গুনতে হবে না।’
সরকারি অনুদান নিয়ে ভাষা আন্দোলন ভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মাণ হয়নি কেন? নির্মাতারা মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্রের জন্যই সরকারেরর কাছে অনুদানের আবেদন করছেন কিন্তু ভাষা আন্দোলন নিয়ে কোনো চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য আবেদন করছেন না কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে গুলজার বলেন, ‘ফরিদুর রেজা সাগর সাহেবের মুক্তিযুদ্ধের ওপর লেখা গল্প পড়ে আমার মনে হয়েছে এটি নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করা যায়। সেজন্যই সরকারের সহযোগিতা নিয়ে ছবিটা করাছি। আর ভাষা নিয়ে কোনো গল্প চোখে পড়েনি, যে কারণে কোনোদিন অনুদানের জন্য চেষ্টা করিনি। তবে এখন বিষয়টা নিয়ে ভাবব।’
চলচ্চিত্র প্রযোজক মোজ্জাম্মেল হোসেন বলেন, ‘আমরা যারা চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য টাকা খরচ করি, আমাদের একটা হিসাব থাকে কতদিনে আমরা টাকাটা তুলে আনতে পারব। যে ছবিতে নিশ্চিত টাকা ফেরত আসবে না সেই ছবিতে একজন প্রযোজক কেন টাকা খরচ করবেন? মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যত ছবি হয়েছে তার বেশির ভাগই সরকারি অনুদানের ছবি। এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের পর পরই ব্যক্তি উদ্যোগে আগে কিছু ছবি হয়েছে। তখন মানুষ চলচ্চিত্র এমনিতেই দেখত, কিন্তু এখন বাংলাদেশে চলচ্চিত্রের যে অবস্থা, তাতে করে কোনো প্রযোজক ভাষার ওপর ছবি বানানোর জন্য টাকা দেবেন না।’

































মন্তব্য চালু নেই