ভারত ভুলে গেল ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ধ্বংসের দিনটি
মঙ্গলবার দিনভর আম্মার মৃত্যুসংবাদে দেশের ইতিহাসের এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা প্রায় ঢাকা পড়ে গেল। আজ গোটা দেশ যখন পুরাতচি তালাইভির (বিপ্লবী নেত্রী) মৃত্যুতে শোকস্তব্ধ তখনই অযোধ্যার বাবরি মসজিদ ধ্বংসের বর্ষপূর্তি নিয়ে কারও মাথাব্যথা দেখা গেল না।
সোশ্যাল নেটওয়ার্কে আম্মার জন্য সবার চোখের জল পড়ছে কিন্তু বাবরি ধ্বংস নিয়ে কোনও পোস্ট চোখে পড়ল না। অথচ ভারতের ইতিহাসের এমন উল্লেখযোগ্য দিন ভুলে গেলে চলবে! তবে সত্য সেলুকাস, বিচিত্র এই দেশ।
১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর। ২৪ বছর আগে এই দিনই ধ্বংস হয়েছিল অযোধ্যার বাবরি মসজিদ। আজ সেই ঘটনা ২৫ বছরে পা দিল। তবে বাবরি মসজিদ নিয়ে বিতর্ক, গণ্ডগোল যাই বলা হোক না কেন সবই কিন্তু নয়ের দশকে শুরু হয়নি।
বিবাদের সূত্রপাত আরও আগে। সিপাই বিদ্রোহের চারবছর আগে বাবরি মসজিদ নিয়ে প্রথম বিবাদের কথা উল্লেখিত রয়েছে ইতিহাসের পাতায়। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ২৪ তম বর্ষপূর্তিতে আসুন জেনে নেওয়া যাক বিবাদের ইতিবৃত্ত-
১) ১৫২৭ খ্রিস্টাব্দে প্রথম মুঘল সম্রাট বাবরের নির্দেশে উত্তরপ্রদেশের অযোধ্যায় নির্মিত হয় বাবরি মসজিদ। তার নামেই এই মসজিদের নামকরণ হয়। তবে এখানে হিন্দুদের দাবি, এটিই রাম জন্মভূমি এবং এখানে ভগবান রামের মন্দিরও ছিল।
২) ১৮৫৩ সালে সিপাই বিদ্রোহের চার বছর আগে প্রথম ধর্মীয় বিবাদের সূত্রপাত হয় এই মসজিদকে কেন্দ্র করে।
৩) ধর্মীয় বিবাদ আয়ত্তের বাইরে চলে যাওয়ায় ছ’বছর পর ব্রিটিশ সরকার বিতর্কিত কাঠামোর চারপাশ ঘিরে দেয়। ভিতরের অংশে মুসলিম সম্প্রদায় এবং বাইরের অংশে হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রবেশাধিকার করে দেওয়া হয়। প্রায় নব্বই বছর এইভাবেই ছিল সবকিছু।
৪) স্বাধীনতার তিন বছর পর ১৯৪৯ সালে স্থাপত্যের ভিতরে অলৌকিকভাবে রাম মূর্তি উদ্ধার হয়। মুসলিমরা অভিযোগ তোলে, এই কাজ হিন্দুদের। গোটা ঘটনায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু অত্যন্ত দুঃখপ্রকাশ করেন। গোটা বিষয় নিয়ে দুই সম্প্রদায়ই আইনি মামলার পথে যায়। স্থাপত্যটিকে বিতর্কিত
তকমা দিয়ে চিরতরের জন্য বন্ধ করে দেয় ভারত সরকার।
৫) ১৯৮৪ সালে বাবরির ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় সংযোজিত হয়। জাতীয় কংগ্রেসের পর এক নতুন রাজনৈতিক শক্তির উত্থান হয়। ভারতীয় জনতা পার্টি। তার সঙ্গে গোটা দেশে মাথাচাড়া দেয় হিন্দুত্ববাদ। ভগবান রামের জন্মভূমিকে অশুভ শক্তি থেকে ‘মুক্ত’ করার ডাক দিয়ে হিন্দুত্ববাদী সংগঠন বিশ্ব হিন্দু পরিষদের নেতৃত্বে গঠিত হয় রাম মন্দির কমিটি। তার পুরোধা করা হয় বিজেপি নেতা লালকৃষ্ণ আদবানীকে।
৬) ঠিক দু’বছর পর জেলা আদালতের বিচারক আচমকাই নির্দেশ দেন, হিন্দুদের পুজো-অর্চনার জন্য বিতর্কিত কাঠামোর গেট খুলে দেওয়া হোক। নির্দেশের ঘন্টাখানেকের মধ্যে গেট খুলে দেওয়া হয়। এই ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষরা বাবরি মসজিদ অ্যাকশন কমিটি গঠন করে ফেলেন।
৭) তিন বছর পর ১৯৮৯ সালে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ এক অভিযান শুরু করে। বিতর্কিত কাঠামো লাগোয়া জমিতে রাম মন্দির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয় এই অভিযানের মধ্য দিয়ে।
৮) পরের বছর বিশ্ব হিন্দু পরিষদের সদস্য-সমর্থকরা বিতর্কিত কাঠামোর উপর রাম মন্দির নির্মাণ করতে যাওয়ায় গম্বুজের আংশিক ক্ষতি হয়। এরপরই উত্তরপ্রদেশের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী মুলায়ম সিং যাদব করসেবকদের উপর গুলিচালনার নির্দেশ দেন। রাম মন্দির নির্মাণের সমর্থনে আদবানী দেশ জুড়ে রথযাত্রা বের করেন। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী চন্দ্রশেখর গোটা ঘটনায় মধ্যস্থতা করার চেষ্টা করলেও তা বিফলে যায়।
৯) এক বছর পরই সবাইকে চমকে দিয়ে উত্তরপ্রদেশে ক্ষমতায় আসে বিজেপি। কেন্দ্রে যথারীতি কংগ্রেস।
১০) ৬ ডিসেম্বর, ১৯৯২। ভারতের ইতিহাসের এক তাৎপর্যপূর্ণ দিন। ভিএইচপি, বিজেপি এবং শিব সেনার সমর্থকরা চড়াও হয়ে গুড়িয়ে দেয় বাবরি মসজিদের বিতর্কিত কাঠামো। শুরু হয় রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা। সেই দাঙ্গায় দু’সম্প্রদায়ের প্রায় দু’হাজারের বেশি মানুষের প্রাণ যায়।
১১) ১৯৯৮ সালে ভারতের ক্ষমতায় আসে বিজেপির জোট সরকার। প্রধানমন্ত্রী হন অটল বিহারী বাজপেয়ী। চার বছর পর বাজপেয়ী নিজের অফিসে একটি অযোধ্যা সেল গঠন করেন।
১২) ওই বছরই মার্চ মাসের মধ্যে মন্দির নির্মাণের কাজ সম্পূর্ণ করার চ্যালেঞ্জ নেয় ভিএইচপি। ফেব্রুয়ারির ২৭ তারিখ অযোধ্যা থেকে ফেরার সময় গুজরাতের গোধরার কাছে সবরমতী এক্সপ্রেসে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে মৃত্যু হয় ৫৮ জন আরএসএসের করসেবকের। তিনদিনের মধ্যে গোধরাকে কেন্দ্র করে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে দাঙ্গা বাধে। বহু মানুষের মৃত্যু হয় তাতে।
১৩) এপ্রিল মাসে বিতর্কিত কাঠামোয় অধিকার কোন সম্প্রংদায়ের, সেই মর্মে এলাহাবাদ হাই কোর্টে মামলার শুনানি শুরু হয়। আদৌ বিতর্কিত কাঠামোর মধ্যে রাম মন্দির ছিল কি না তা জানার জন্য পরের বছর জানুয়ারি মাসে আদালত আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়াকে সার্ভে করার দায়িত্ব দেয়।
১৪) ২০০৩ সালের আগস্ট মাসে এএসআই রিপোর্টে জানায়, মসজিদের নিচে রাম মন্দির থাকার অস্তিত্ব পাওয়া গিয়েছে। এই রিপোর্টকে চ্যালেঞ্জ করে মুসলিম ল’ বোর্ড। দু’বছর পর নির্মিয়মাণ রাম মন্দিরের সাইটে জিপবোঝাই বিস্ফোরক-সহ হামলা চালায় বেশ কিছু ইসলামিক উগ্রবাদী অস্ত্রধারীরা।
১৫) ২০১০ সালের সেপ্টেম্বর মাস। আরও এক অধ্যায় সংযোজিত হল অযোধ্যার ইতিহাসে। এলাহাবাদ হাই কোর্ট এক ঐতিহাসিক রায় দেয়। বিতর্কিত কাঠামোকে তিন ভাগে বিভক্ত করে দেওয়ার নির্দেশ দেয় আদালত। এক ভাগ পায় উত্তরপ্রদেশের সুন্নি সেন্ট্রাল ওয়াকফ বোর্ড এবং বাকি দুই ভাগ দেওয়া হয় নির্মোহী আখাড়া এবং রাম লালা কমিটিকে। কাঠামোর কর্তৃত্ব যায় হিন্দুদের দখলে। মুসলিমদের হয়ে এক আইনজীবী এই রায়কে চ্যালেঞ্জ জানান। ওই বছরের ডিসেম্বর মাসে অখিল ভারতীয় হিন্দু মহাসভা এবং সুন্নি ওয়াকফ বোর্ড এলাহাবাদ হাই কোর্টের রায়কে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়।
১৬) পরের বছর মে মাসে এলাহাবাদ হাই কোর্টের রায়কে খারিজ করে দেয় সুপ্রিম কোর্ট। তারপর থেকে এখনও পর্যন্ত কোনও সমাধানে পৌঁছনো যায়নি এই ইস্যুতে। তাই বিতর্কিত কাঠামো এখনও বন্ধই পড়ে রয়েছে। সংবাদ প্রতিদিন
মন্তব্য চালু নেই