ভারতীয় মিডিয়ায় মুস্তাফিজ-সৌম্য বন্দনা
ঘরের মাঠে ভারতের শক্তিশালী ব্যাটিং লাইনকে নাকানি-চুবানি খাইয়েছিলেন মুস্তাফিজুর রহমান। এই তরুণ পেসার অভিষেকেই কাটার, স্লোয়ারে ধোনিদের জীবন বিষিয়ে তুলেছেন। সেই থেকেই মুস্তাফিজে মজেছে ভারতীয় মিডিয়া, বিশেষ করে দেশটির জনপ্রিয় দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা।
অন্যদিকে সৌম্য সরকার বিশ্বকাপ থেকেই ব্যাট হাতে আলো ছড়িয়ে যাচ্ছেন। বিশ্বকাপের পর পাকিস্তানের বিপক্ষে তিন ম্যাচ ওয়ানডে সিরিজের শেষটিতে ১২৭ রানের হার না মানা নান্দনিক ইনিংস উপহার দিয়ে পাদপ্রদীপের আলোয় এসেছেন এই তরুণ উদীয়মান ক্রিকেটার। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে তিন ম্যাচ ওয়ানডে সিরিজের দ্বিতীয়টিতে ৭৯ বলে ৮৮ রানের হার না মানা ইনিংস খেলে বাংলাদেশকে জিতিয়েই মাঠ ছাড়েন।
মুস্তাফিজ ও সৌম্য সরকারের অসাধারণ পারফরম্যান্সের কল্যাণেই দক্ষিণ আফ্রিকাকে দ্বিতীয় ম্যাচে উড়িয়ে দিয়ে সিরিজ জয়ের সম্ভাবনা জাগিয়ে তুললো মাশরাফির বিন মুর্তজার দল।
এমন অসাধারণ পারফরম্যান্সের জন্য মুন্তাফিজুর রহমান ও সৌম্য সরকার যেমন বাংলাদেশে প্রশংসা জোয়ারে ভাসছেন, ঠিক তেমনি পদ্মার ওপারে ভারতীয় মিডিয়াও এই দুজনের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছে। দ্বিতীয় ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে পাওয়া অসাধারণ জয় নিয়ে আনন্দবাজার যেই রিপোর্ট ছেপেছে, তার অধিকাংশ জুড়েই ছিল মুস্তাফিজ ও সৌম্য সরকারের প্রশংসা।
আনন্দবাজারের প্রতিবেদনের শুরুতে মুস্তাফিজুর রহমান ও সৌম্য সরকারকে নিয়ে অসাধারণ বর্ণনা তুলে ধরা হয়। শুরুটা করা হয় নাটকীয়ভাবে, ‘হাতিবাগান মার্কেটের অলিগলিতে যদি দু’জনকে ছেড়ে দেওয়া হয়, চিনে বেরোতে পারবেন কি না সন্দেহ। লাজুক, শান্ত, মিষ্টভাষী, বিনয়ী— ভাল ছেলের ব্যাখ্যায় যে যে উপমা ব্যবহার সম্ভব, স্বাচ্ছন্দে সেগুলো এদের নামের পাশে বসিয়ে দেওয়া যেতে পারে। মুস্তাফিজুর রহমানকে দেখলে বিশ্বাস হবে না, তাঁর হাত থেকে ও রকম মারণ-কাটার বেরনো সম্ভব। শান্তশিষ্ট কলেজপড়ুয়া হিসেবে বিশ্বাসযোগ্য, কিন্তু ক্রিকেট-বিশ্বকে কাঁপিয়ে দেওয়া বোলার হিসেবে নয়। পেস বোলারের গলায় যে আগুনে ভাষাটা থাকতে দেখা যায়, সেটা শত চেষ্টাতেও খুঁজে পাওয়া কঠিন। সৌম্য সরকার দ্বিতীয়জন। কথাবার্তা এতটা মার্জিত, ব্যবহারে এতটা ভদ্র যে মনে হবে, এ ছেলে তো সাহিত্যের প্রফেসর হতে পারত! এ ক্রিকেটে কেন?
এরপর উদাহরণ টেনে এনে রিপোর্টে বলা হয়, ‘দৃষ্টির বিচার অধিকাংশেই ভ্রমাত্মক এবং এখানেও তা ব্যতিক্রম নয়। সে তো ইতালির আন্দ্রে পিরলোকে দেখলেও মনে হয়, ইনি ফুটবলে না থেকে সঙ্গীতজগতের কেউ হলে বেশি মানাত। ইংল্যান্ডের অ্যালেস্টার কুককে দেখলে ক্রিকেটারের চেয়ে হলিউডের রোম্যান্টিক নায়কের চরিত্রে বেশি উপযোগী লাগে। মুস্তাফিজুর-সৌম্যরও তাই আফ্রিকার সিংহদের বিস্ফারিত করে ছেড়ে দেওয়ায় অবিশ্বাস্য কিছু নেই।’
এরপর টাইগারদের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে বলা হয়, ‘কিন্তু শুধু বিস্ফোরিত করে আফ্রিকার সিংহদের এরা ছেড়ে দিলেন বললে, খুব অন্যায় হবে। রবিবাসরীয় মিরপুর আরও একটা দেশের ইতিহাস শুধু দেখল না, দেখল দেশের ক্রিকেট-ভবিষ্যতও ঠিক দিকে এগোচ্ছে। মাশরফি মর্তুজার পরে কে, তামিম ইকবালদের পরে কে, এ দিনের পর থেকে প্রশ্নগুলোর ভিড় আর থাকা উচিত নয়।’
এরপরের বর্ণনা ছিল আরো অসাধারণ, ‘পাকিস্তান, ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা— ক্রিকেটের তিন মহাশক্তিকে পর্যদুস্ত করে ছেড়ে দিলেন মাশরফি মর্তুজারা। নির্যাসে ধরলে ওই দু’জন— মুস্তাফিজুর এবং সৌম্য। প্রথম জন স্বমূর্তি ধরে প্রোটিয়া ব্যাটসম্যানদের নাচিয়ে তিনটে উইকেট। দ্বিতীয়জন, ম্যাচ জেতানো অপরাজিত ৮৮। পদ্মাপারের ক্রিকেটকে তারা মনে রাখার মতো দিনই উপহার দিলেন না, চলতি ওয়ানডে সিরিজের সিংহদরজাও হাট করে দিলেন। সিরিজ এখন সেই স্টেশনে দাঁড়িয়ে যেখান থেকে দু’টো ট্রেন ছাড়তে পারে। একটা, ও পারের গৌরবের। অন্যটা, আফ্রিকার সম্মানের। সিরিজ এখন তো ১-১।’
বাংলাদেশি বোলারদের অকুণ্ঠ প্রশংসা করা হয় প্রতিবেদনটি। বলা হয়, ‘দক্ষিণ আফ্রিকা প্রথমে ব্যাট করে এদিন তুলেছিল ১৬২। যাকে মোটেও অঘটন বলা যাবে না। কারণ এর পিছনে একটাই কারণ—বাংলাদেশের দুর্ধর্ষ বোলিং। মুস্তাফিজুরের যে বলটায় কুইন্টন ডি’কক আউট হলেন, সেটা কাটার ছিল না। কিন্তু স্বপ্নের ডেলিভারি ছিল। যা ডি’কককে অসহায় করে দিয়ে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়ে গেল। দক্ষিণ আফ্রিকা বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে যখন, দ্বিতীয় ধাক্কাটা দেন মুস্তাফিজুর। জেপি ডুমিনিকে তুলে নিয়ে। হাসিম আমলাও ব্যর্থ। এবি ডি ভিলিয়ার্সের জায়গায় তাকে অধিনায়কের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তাকে তো বল্গাহীন দৌড়ের সুযোগই দিচ্ছে না বাংলাদেশ। এ দিন ২২ রানে বোল্ড। ঘাতকের নাম রুবেল হোসেন। একশো রানেরও কমে এ দিন পাঁচ উইকেট চলে গেল, দেড়শোর আগে সাতটা, বাংলাদেশকে বাঁচাত কে? মুস্তাফিজুর তিনটে, নাসির হোসেন তিনটে, রুবেল দু’টো, মাশরফি একটা— এরা মাত্র ১৬২ রানে গুঁড়িয়ে দিলেন বাংলাদেশকে।’
জয়ের লক্ষ্য মাত্র ১৬৩ হলে দক্ষিণ আফ্রিকার বোলিং আক্রমণের সামনে সেটাও নিরাপদ ছিল না। বাংলাদেশের জয়ের বাকি কাজটুকু যে সৌম্য ও মাহমুদুল্লাহ সারলেন আনন্দবাজারের প্রতিবেদনে সেটি ফুটে উঠে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘কিন্তু তখনও অর্ধেক কাজ সমাপ্ত মাত্র, পুরোটা নয়। বরং উদ্যত দাঁতনখ নিয়ে পূর্ণ উদ্যমে বাংলা ব্যাটিংয়ের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়েছে আফ্রিকার বোলিং। তামিম ইকবাল আউট। লিটন দাস আউট। বাংলাদেশ ২৪-২। ওই সময় স্রোতের টানে ভেসে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা ছিল, কিন্তু তার সামনে দুর্ভেদ্য প্রাচীর হয়ে দাঁড়ালেন সৌম্য সরকার। ৭৯ বলে অপরাজিত ৮৮, ১৩টা বাউন্ডারির সঙ্গে একটা ছক্কা। মাহমুদউল্লাহকে কৃতিত্ব অবশ্যই দিতে হবে। অর্ধশতরানের জন্য শুধু নয়, অন্য দিকটাও তিনি নিশ্ছিদ্র করে দেন। সবচেয়ে বড় কথা, এরা দু’জন একদম শেষ পর্যন্ত থেকে জিতিয়ে ফিরলেন। সৌম্যকে তো আউট করাই গেল না। মাহমুদউল্লাহ আউট হলেন ঠিকই, কিন্তু তখন বাংলাদেশের জয় স্রেফ সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
প্রতিবেদনের শেষটাতেও ছিল টাইগারদের প্রশংসা-গাঁথা। শেষ টানা হয় এভাবে, ‘যদি এটা সামিয়ক সু-সময়ের আশীর্বাদ হয়, আলাদা কথা। কিন্তু এমন মহাসাফল্য যদি এখন থেকে বাংলাদেশ ক্রিকেটের পরিচিতি হয়, তা হলে একটা কথা লিখে ফেলা উচিত। পদ্মাপারের সামনে ক্রিকেট-গৌরবের অনন্ত আকাশ অপেক্ষা করে আছে।’
মন্তব্য চালু নেই