ভাঙনে পর পাল্টাপাল্টি সংবাদ সম্মেলন ইনু-বাদলের
ভাঙনের একদিন পরে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ ও সমালোচনা করলেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ-ইনু) এবং জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ-আম্বিয়া)।
গতকাল শনিবার ছয় বছর পর অনুষ্ঠিত কাউন্সিল অধিবেশনে নেতা নির্বাচন নিয়ে জাসদ ভেঙ্গে যায়। এরপর আজ উভয় দলই দুটি স্থানে সংবাদ সম্মলন করে একে অপরের প্রতি অভিযোগে করেন।
রোববার জাতীয় সংসদ ভবনে দুপুরে নিজ কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে হাসানুল হক ইনুর স্বেচ্ছাচারিতা, আর্থিক অস্বচ্ছতা ও ব্যক্তিগত অনুরাগের কারণে জাসদে ফের ভাঙন সৃষ্টি হয়েছে বলে অভিযোগ করেন দলের একাংশের কার্যকরী সভাপতি মঈনুদ্দিন খান বাদল।
তিনি বলেন, এই বিস্ফোরণ হওয়ার নেপথ্যে কাজ করেছে মন্ত্রী হওয়ার পর উনার (ইনু) আর্থিক অস্বচ্ছতা। তার আর্থিক আচরণ সম্পর্কে দলে বার বার প্রশ্ন উঠেছে। এ ব্যাপারে অস্পষ্টতা আছে, অস্বচ্ছতা আছে। দলীয় সভাপতি হিসেবে ব্যক্তিগত রাগ-অনুরাগ, ব্যক্তিগত সম্পর্কের ভিত্তিতে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। তিনি (ইনু) তাই নিয়েছেন। আমাদের সবচেয়ে বড় অভিযোগ, তিনি (ইনু) ৬ বছর আমাদের সাবেক সাধারণ সম্পাদক (বর্তমান সভাপতি) শরীফ নুরুল আম্বিয়াকে কোনো কাজ করতে দেন নাই। বাধা সৃষ্টি করেছেন।
এই বাধাদানের বিষয়ে তিনি বলেন, তিনি (ইনু) সাধারণ সম্পাদককে পার্টি অফিসে বসিয়ে রেখে অন্যকে কাজের নির্দেশ দিয়ে চিরকুট পাঠাতেন, বাণী পাঠাতেন। এভাবে দল চলে না।
বাদল আরও বলেন, আমরা তাকে (ইনু) বার বার বলেছি, সম্মেলনে কাউন্সিলরদের স্বাধীন মতামত ব্যক্ত করতে দিন। কাউন্সিলরদের রায় আমরা নতচিত্তে মেনে নেবার কথাও বলেছি। আমরা দল ভাঙতে চাইনি, ভাঙন কাঁধের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা ১৪ দলীয় জোটে থাকব। তবে ১৪ দলে আমাদের অবস্থান অনেক স্বচ্ছ হবে। আমাদের মানুষের স্বার্থে যা বলার, তা বলার চেষ্টা করব।
তিনি আরও বলেন, আমাদের দলের ছয়জন সংসদ সদস্যের চারজন আমাদের সঙ্গে রয়েছে। তারা হলেন আমি নিজে, সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হক প্রধান, রেজাউল করিম তানসেন ও সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য লুৎফা তাহের। দলের স্ট্যান্ডিং কমিটির ১৪ সদস্যের মধ্যে ১০ জনই আমাদের সঙ্গে আছেন।
বাদল বলেন, আমরা দল ভাঙিনি, ভাঙতে চাইনি, ভাঙার কোনো পরিকল্পনা আমাদের ছিল না। কয়েকজন সাংবাদিক আমাদের প্রশ্ন করেছেন, আমরা জাসদ ভাঙার কোনো গুঞ্জনও পাইনি। এমন কি সিক্রেট পার্টি আপনারা হলেন ভাঙার কোনো গুঞ্জন আমরা পেলাম না। দল ভাঙার কোনো নজির আমরা আগের দিনও পাইনি। সেটাই প্রমাণ করে এই ভাঙন কর্মটির সাথে আচরণ এবং দীর্ঘদিনের জমে থাকা ক্রোধ বিস্ফোরণ হয়েছে।
এদিকে আজ বিকেলে হাসানুল হক ইনু বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে দলের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন। সেখানে তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন, কাউন্সিল অধিবেশনের বাইরে রাস্তাঘাটে কমিটি গঠনের কোনো বিধান নেই। এটা সম্পূর্ণ গঠনতন্ত্রবিরোধী। কাউন্সিল অধিবেশন থেকে বেরিয়ে গিয়ে আরেকটি কমিটি ঘোষণাকারী দলীয় নেতাদের দলে ফিরে আসার আহ্বান জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, দলের রাজনীতি ও নীতিনির্ধারণে তারা আগের মতোই সুযোগ পাবেন।
তিনি আরও বলেন, মহাজোট সরকার ও ১৪ দলে জাসদ আছে ও থাকবে। সরকার ও জোট থেকে বেরিয়ে যাওয়ার যে দাবি কেউ কেউ তুলেছিলেন, কাউন্সিল তা প্রত্যাখ্যান করেছে।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে হাসানুল হক ইনু বলেন, আজ পর্যন্ত সরকার, গণমাধ্যম বা জাসদের নেতা-কর্মীসহ কোনো পর্যায় থেকে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও আর্থিক অস্বচ্ছতার কোনো অভিযোগ তোলা হয়নি। তাই এই অভিযোগ ডাহা মিথ্যা। তিনি বলেন, জঙ্গিবাদ ও জঙ্গিবাদের পাহারাদারদের দমন এবং উন্নয়নের সহযোগী হিসেবে জাসদ এগিয়ে যাবে। জঙ্গিবাদবিরোধী শেষ লড়াইয়ে জাসদ অংশ নেবে।
দলের একাংশের বক্তব্যের জবাবে ইনু বলেন, ‘আমার পক্ষ থেকে স্বৈরাচারী ও হঠকারী কোনো কাজ করা হয়নি। বরং তারা দলের ভেতর বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে চেয়েছিল। মহাজোট সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে চেয়েছিল। জঙ্গিবাদের সঙ্গে আপস করতে চেয়েছিল।’ সংবাদ সম্মেলনে জাসদের নবনির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক শিরিন আক্তারসহ জাসদ নেতা মীর হোসাইন আখতার উপস্থিত ছিলেন।
গতকাল রাজধানীর মহানগর নাট্যমঞ্চে জাসদের কাউন্সিল অধিবেশন থেকে বের হয়ে গতকাল রাতে দলের একটি অংশ নতুন কমিটি ঘোষণা করে। এই কমিটির সভাপতি হলেন শরীফ নূরুল আম্বিয়া, সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হক প্রধান। দলের অপর অংশে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সভাপতি হয়েছেন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু। আর ভোটের মাধ্যমে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন শিরীন আখতার।
জাসদ সূত্র জানায়, নির্বাচনে একাধিক প্রার্থী না থাকায় ইনুকে সভাপতি হিসেবে ঘোষণা করা হয়। কিন্তু সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচন নিয়ে হইচই ও বাগ্বিত-ার একপর্যায়ে দলের একটি অংশ গত রাতে অধিবেশন বর্জন করে। তারা জাতীয় প্রেসক্লাবে গিয়ে শরীফ নূরুল আম্বিয়াকে সভাপতি, নাজমুল হক প্রধানকে সাধারণ সম্পাদক ও মঈন উদ্দীন খান বাদলকে কার্যকরী সভাপতি ঘোষণা করে।
গতকালের পরিস্থিতিতে আজ রোববার জাসদের দুই পক্ষই তাদের নিজ নিজ অবস্থান ব্যাখ্যা করে আলাদা আলাদা সংবাদ সম্মেলন করেছেন।
প্রসঙ্গত, ১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর জাসদ গঠিত হয়। বিভিন্ন বিতর্ককে কেন্দ্র করে ১৯৮০ সালে প্রথম জাসদ ভাঙনের কবলে পড়ে। জাসদ থেকে বেরিয়ে একদল নেতা বাসদ গড়ে তোলেন। ১৯৮৬ সালে কাজী আরেফ ও হাসানুল হক ইনুর নেতৃত্বে জাসদ পুনর্গঠিত হয়, যা পরে জাসদ (ইনু) হিসেবে পরিচিতি পায়।
১৯৮৮ সালে জাসদ আবার ভেঙে সাত ভাগে বিভক্ত হয়। এরপর ১৯৯৭ সালে জাসদ (রব), জাসদ (ইনু) ও বাসদের (মাহবুব) একাংশ মঈন উদ্দীন খান বাদলের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হয়। ২০০২ সালে আ স ম রবের নেতৃত্বে কিছু নেতা জেএসডি নামে জাসদের কার্যক্রম পরিচালনা করেনন। আর ২০০৪ সালে থেকে হাসানুল হক ইনুর নেতৃত্বে জাসদ ১৪ দলের শরিক হয়।
মন্তব্য চালু নেই