‘বোরখা’–স্বতীত্ব বিলানোর জন্য নয়, স্বতীত্ব রক্ষার জন্য
লেখার শিরোনামটা কিছুটা অদ্ভূত, তাই না? অনেকেই হয়ত ভাবছেন, এ কেমন শিরোনাম রে বাবা! বোরখা কেন স্বতিত্ব বিলানোর মাধ্যম হবে। এই ছেলেটা কি ইসলাম সম্পর্কে কোন জ্ঞানই রাখেনা? ইত্যাদি ইত্যাদি!
বিশ্বাস করুন আমিও চিন্তা করেছি শিরোনাম নিয়ে। পরে মনে হল, কে কি ভাববে তা নিয়ে আমার মাথা ব্যাথা কেন! আমার উদ্দেশ্য আল্লাহ বুঝলেই হবে। এবার মূল প্রসঙ্গে আসি-
বোরখার সাথে আমার পরিচয় ছোটবেলা থেকেই। আম্মার পরনে দেখে। একদিন আম্মাকে জিজ্ঞেস করলাম- তোমার কলিগরা তো অনেকেই শাড়ি পরে আসে, তুমি বোরখা পর কেন?আম্মা বললেন- ‘পরপুরুষের সামনে গেলে পর্দা করে যেতে হয়, এটি ইসলাম ধর্মের নিয়ম। তাই আমি আমি বোরখা দ্বারা পর্দা করি’।
ছোট থাকলেও এটুকু বুঝতে অসুবিধা হয়নি, যে নারীরা ইসলাম ধর্ম মেনে চলে তাদেরকে পর্দা করে বাইরে যেতে হয়। এরপর কুরআন থেকেও পর্দা বিষয়ক কিছু জ্ঞান অর্জন করলাম। যেমন-
“হে নবী আপনি আপনার পত্নী গনকে ও কন্যা গনকে এবং মুমিনদের স্ত্রীগনকে বলুন, তারা যেন তাদের চাদরের কিয়দাংশ নিজের বুকের উপর টেনে নেয়। এতে তাদের চেনা সহজ হবে, ফলে তাদের উত্যক্ত করা হবে না, আল্লাহ ক্ষমাশীল পরম দয়ালু”।
[আল আহযাবের-৫৯]
অর্থাত্ মুসলিম নারীদের চেনার একটি সহজ উপায় হল তারা পর্দা মেনে চলবে। বর্তমানে যেহেতু পর্দা মেনে চলতে গেলে বোরখাকে ব্যবহার করতে হয়, তাই বলা যায়- বোরখা পরিহিত মেয়েরা ইসলামের নিয়ম কানুন মেনে চলে।
কিন্তু কিছু তিক্ত অভিজ্ঞতা আমার এ জানা বিষয়টাকে দ্বিধায় ফেলে দিয়েছে। আজকের লেখাটি সেই খন্ড খন্ড দৃশ্যের সমষ্টিকে নিয়ে। আসুন দৃশ্যপটগুলোতে একবার চোখ বুলিয়ে নেই।
২০০৯ সালের প্রথম দিকের ঘটনা। মিডিয়ায় বাংলা ছায়াছবি ‘মনপুরা’র ব্যাপক প্রচার চলছে। এমন ছবি নাকি এক’শ বছরে একটা হয়না… আরো কত কথা। প্রবল আগ্রহ নিয়ে ‘মনপুরা’ দেখতে এক বন্ধুকে সহ জেলা শহরের একটি সিনেমা হলে গেলাম। আমাদের সামনে সিটে একজোড়া ছেলে মেয়ে বসেছিল। মেয়েটির পরনে বোরখা ছিল। সিনেমা শুরু হবার ঘন্টাখানিক পর হঠাত্ সামনের সিটে চোখ গেল। রীতিমত আঁতকে উঠলাম। ওরা সিনেমা দেখা বাদ দিয়ে অনৈতিক কর্মকান্ডে লিপ্ত হয়ে আছে। চারপাশে চোখ বুলিয়ে দেখি এমন আরো চার-পাঁচটি দৃশ্য।
সিনেমা শেষ হবার আগেই বের হয় গেটের পাশে গিয়ে দাড়ালাম। কোন চেনা মেয়ে থাকলে সতর্ক করে দেব এই ভেবে। সিনেমা শেষ হলে অবাক হয়ে দেখলাম সবক’টি মেয়ে নেকাব পরে বের হয়ে যাচ্ছে। মুখ ঢেকে রাখার কারনে কাউকে চেনার সুযোগ পেলাম না।
২০০৯ সালের মাঝামাঝি সময়। এডমিশন কোচিং করতে ঢাকায় এসেছি। নিয়ে এসেছে খালাত ভাই। বয়সে বড় হলেও বন্ধুর চেয়েও বেশি। বললেন- ‘ঢাকায় নতুন এসেছিস, চল তোকে চিড়িয়াখানা, বোটানিক্যাল গার্ডেন ঘুরিয়ে নিয়ে আসি’। ভাইয়ের সাথে গেলাম। চিড়িয়াখানা ঘুরে বোটানিক্যাল গার্ডেনে প্রবেশ করলাম। আমার তো চোখ ছনাবরা! কি দেখছি এসব! বোরখা পরা মেয়েরা এতটা খারাপ হয় কখনো? সেখানে প্রায় শতকরা বিশজন মেয়ের পরনে বোরখা ছিল। বেশিক্ষন থাকতে পারিনি।
বের হবার পর ভাই বলল- ‘এই মেয়েগুলো বোরকা পরে এসেছে কেন জানিস? এরা বোরকা পরে বাবা মা’র সামনে ছেলেদের নিয়ে টাংকি মারলেও তারা বুঝতে পারবেনা বলে’। আমি হা করে শুনছিলাম। এমনও হয়?
‘হায় বোরখা, হায় স্বতিত্ব রক্ষাকারী কাপর!’
ভার্সিটিতে ভর্তি হবার পর হলে উঠলাম। রুমমেটদের সাথে পরিচয় হল। একজন নতুন প্রেম শুরু করেছে। সে ফোনে তার গার্লফ্রেন্ড (?) কে বলছে- ‘তোমার সৌন্দর্য শুধু আমার জন্য, অন্য কোন পুরুষের জন্য নয়। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে আমি তোমার পরনে বোরখা দেখতে চাই’।
যে কথা বলবে স্বামী, সে কথা বলছে প্রেমিক। সাবাশ ইসলামিক দেশের মুসলমান।
বছর খানিক আগে আমার এক স্কুল বন্ধু স্কুলের এক মেয়ে ক্লাসমেটের কথা উল্লেখ করে বলছে- ‘জানিস ঐ মেয়েটা এখন এরাবিয়ান বোরখা ব্যবহার করে’। মেয়েটা ইসলাম ভীরু টাইপ ছিলনা। তাই আমি বললাম- ‘আমি নিশ্চিত ও কোন ছেলের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পরেছে’। আগের পয়েন্ট তো তাই বলে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেলে মেয়েটা দু’তিন মাস ধরে একটা ছেলের সাথে দিল্লীকা লাড্ডু খাচ্ছে।
আপনি গ্রামের পরিসংখ্যান শুনলে উত্কন্ঠায় শিউরে উঠবেন। গ্রামের স্কুল কলেজের অধিকাংশ মেয়েরা এখন বোরখা ব্যবহার করে। একজন মুসলমান হিসেবে এই কথাটি সুসংবাদের হতে পারত। কিন্তু ওরা কেন বোরকা পরিধান করে জানেন (সবাই নয় তবে বেশিরভাগ)??
‘ক্লাস ফাঁকি দিয়ে যেন ছেলেদের সাথে সিনেমা হলে, পার্কে, উদ্যানে যেতে পারে এ জন্য’। থানা পর্যায়ে বিনোদন পার্কের ব্যবস্থা এদের জন্য আরো সহজতর করে দিয়েছে।
অনেক বাবা মা-ই এখন মেয়েদের এই ভয়ে বোরখা ব্যবহার করতে দেন না। ভয়টি কিন্তু অমূলক নয়।
আমার মনে হয় উপোরক্ত ঘটনাগুলি সম্পর্কে আপনারাও সজ্ঞান রয়েছেন। কেউ লিখতে চায়নি, আমি লিখেছি; এই যা পার্থক্য।
ইদানিং আবার বোরকায় আধুনিকতা এসেছে। যে বোরকায় চাকচিক্য বেশি, শরীরের অবয়ব ফুটে ওঠে সেগুলো নাকি আধুনিক বোরকা। ক্লাসেও শুনি, এক মেয়ে আরেক মেয়েকে বলছে- ‘তোর বোরখাটা কি সুইট’!
এভাবেই বোরখাকে ফ্যাশন হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে, হারিয়ে যেতে বসেছে বোরখা ব্যবহারের মূল প্রয়োজনীয়তা। আলহামদুলিল্লাহ! এখনো কিছু ইসলামিস্ট বোন আছেন বলে স্বপ্ন দেখি একটি সুন্দর সকালের, হিজাব সমৃদ্ধ ইসলামিক সমাজের। যেখানে সবাই বোরখাকে ব্যবহার করবে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির নিমিত্তে, অন্য কোন উদ্দেশ্যে নয়।
জানি আমার এই একটি লেখা দিয়ে আমূল পরিবর্তন হবেনা। কিন্তু আমরা যদি লক্ষ্য করি, ইদানিং অনলাইন এক্টিভিটিজদের কারনে অনেক বড় ঘটনা ঘটছে। সেক্ষেত্রে আমরা সবাই মিলে যদি পর্দার ব্যবহার বিষয়ে গণসচেতনটা তৈরীর চেষ্টা করি তখন হয়ত সফলতা আসবে, যদি আল্লাহ রাজী থাকেন।
মন্তব্য চালু নেই