বেরোবিতে শিক্ষক কর্মকর্তা-কর্মচারির ১১৮টি পদে নিয়োগ নিয়ে প্রহসন
বিশেষ প্রতিনিধি, রংপুর : রংপুরের রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) উপাচার্য অধ্যাপক ড. নুর উন নবীর চাকরির মেয়াদ আছে আর মাত্র ৩৭ দিন। নতুন করে আবারও তার চাকরির মেয়াদ না বাড়ার আশঙ্কায় এই অল্প সময়ে তড়িঘড়ি করে সব নিয়মকানুন বিধি-বিধানকে উপেক্ষা করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কর্মকর্তা ও কর্মচারীর ১১৮ পদে নিয়োগ দেয়ার নামে চলছে চাকরি প্রত্যাশীদের দিনভর সাক্ষাৎকার নেয়া।
ইন্টারভিউ কার্ড ইস্যু না করে শুধুমাত্র মোবাইলে এসএমএস পাঠিয়ে পছন্দের প্রার্থীদের নেয়া হচ্ছে ইন্টারভিউ। সাক্ষাৎকার নেয়ার নামে চলছে নজিরবিহীন প্রহসন। এদিকে বিভিন্ন পদে চাকরি প্রত্যাশীদের জন্যর্ স্বোচ্চ ২৫ লাখ থেকে সর্বনিম্ন ১০ লাখ টাকা দর উঠেছে। প্রকাশ্যেই চলছে টাকা নেয়ার কার্যক্রম। দিন-রাতভর রেজিস্টার দফতরে চলছে ইন্টারভিউ কার্ড তৈরি আর এসএম দেয়ার ধুম পড়েছে। উদ্দেশ্যে যেভাবে হোক উপাচার্যের মেয়াদের মধ্যে নিয়োগ সম্পন্ন করতে হবে। এ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক শিক্ষার্থী আর কর্মকর্তা কর্মচারীসহ রংপুরের সাধারণ মানুষের মাঝে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। তারা এখনই এ অবৈধ নিয়োগ দেয়ার প্রহসন বন্ধ করার দাবি জানিয়েছেন।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক নুর উন নবী উপাচার্য হিসেবে যোগদানের পর কখনই কোন নিয়োগ এক বছর কিংবা দেড় বছরের আগে হয়নি। ইউজিসি ও মন্ত্রণালয় থেকে নিয়োগ দেয়ার নির্দেশনা আসলেও এভাবে বছর পার করা হতো। এবারও শিক্ষকসহ ১১৮টি পদে নিয়োগ দেয়ার জন্য প্রায় এক বছর আগে সংশ্লিষ্ট দফতর থেকে প্রয়োজনীয় অনুমোদন দেয়া হলেও ওইসব পদে নিয়োগ দেয়ার জন্য আবেদনপত্র আহ্বান করা হয়নি।
এদিকে বর্তমান উপাচার্যের মেয়াদ আগামী ৫ মে শেষ হতে চলেছে এখন পর্যন্ত তার মেয়াদ বর্ধিত হওয়ার কোন সম্ভাবনা দেখতে না পেরে তড়িঘড়ি করে রেজিস্টার ইবরাহিম কবীর গত ৯ ফেরুয়ারি একইদিন ৩টি পৃথক স্মারকে শিক্ষক কর্মকর্তা ও কর্মচারী পদে ১১৮ জন নিয়োগ দেয়ার জন্য আবেদনকারীদের কাছে দরখাস্ত আহ্বান করেন। মজার ব্যাপার আবেদনকারীদের আবেদন করারও পর্যাপ্ত সময় দেয়া হয়নি। কর্মকর্তা পদে আবেদনপত্র জমা দেয়ার সর্বশেষ তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে ২৩ ফেব্রুয়ারি অর্থাৎ মাত্র ১৪ দিন। অন্যদিকে কর্মচারী পদে আবেদন করার সময় দেয়া হয়েছে ২৬ ফেব্রুয়ারি অর্থাৎ মাত্র ১৬ দিন। অন্যদিকে শিক্ষক পদে আবেদন করার সর্বশেষ সময় সময় নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে ২ মার্চ অর্থাৎ ২৪ দিন। রেজিস্টার দফতর সূত্রে জানা গেছে ১১৮টি পদের মধ্যে শিক্ষক পদে ২৫ জন, কর্মকর্তা পদে ১৭ জন এবং কর্মচারী পদে নিয়োগ দেয়ার কথা ৭৬ জনকে। এসব পদে আবেদনকারীর সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার। কিন্তু আবেদনকারীদের আবেদনপত্রগুলো যাচাই-বাছাই না করে তড়িঘড়ি করে পছন্দের প্রার্থীদের ইন্টারভিউ কার্ড দেয়া হয়েছে। আবার অনেককে মোবাইলে এসএমএস দিয়ে ইন্টারভিউতে আসতে বলা হচ্ছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন কর্মকর্তা জানান শিক্ষকসহ বিভিন্ন পদে যাদের চাকরি দেয়া হবে তারা অলরেডি রির্ধারিত হয়ে আছেন। ইন্টারভিউ দেয়ার তারিখ ঘোষণা করা আর ইন্টারভিউ নেয়া শুধু দেখানো। কারণ প্রতিটি পদের বিপরীতের্ স্বোচ্চ ২৫ লাখ সর্বনিম্ন ১০ লাখ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
মজার ব্যাপার রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ বাণিজ্যে এর আগের উপাচার্য অধ্যাপক আবদুল জলিল মিয়ার বিরুদ্ধে গঠিত দুর্নীতি প্রতিরোধ মঞ্চের নেতারা এবার নিজেরাই নিয়োগ বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এর আগে শিক্ষক কর্মকর্তা নিয়োগ বাণিজ্যের নামে অনেক টাকা কামিয়ে দুজন মিলে ৪১ লাখ টাকা দিয়ে জমি কিনেছেন এ বিষয়টি ওপেন সিক্রেট। এবারেও ওই শিক্ষক নেতা তার এক পছন্দের প্রার্থীকে ডেপুটি রেজিস্টার ও ডেপুটি কন্ট্রোলার এ দুটো পদে আবেদন করিয়েছেন। এ জন্য ২০ লাখ টাকাও নিয়েছেন চাকরি দেয়ার নামে। এ ছাড়াও শিক্ষক পদেও তিনি ২টি পদে তার পছন্দের প্রার্থীকে নিয়োগ দেয়ার জন্য ৫০ লাখ টাকা নিয়েছেন বলে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সবার মুখে মুখে ভেসে বেড়াচ্ছে এসব কথা। শুধু তাই নয় মার্কেটিং বিভাগে এক শিক্ষককে মোটা টাকা নিয়ে চাকরি পাইয়ে দিয়েছেন তিনি। ওই শিক্ষক নেতা বর্তমান উপাচার্যের ডান হাত বলে সবাই জানে। একইভাবে এর আগের উপাচার্যের দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনকারী অপর এক শিক্ষক নেতা এর আগে শিক্ষক নেয়ার জন্য দুজন আবেদনকারী শিক্ষক প্রার্থীর কাছ থেকে ৪০ লাখ টাকা নিয়েছেন। তারা যেহেতু প্রভাবশালী সে কারণে প্রতিটি নিয়োগের সময় তাদের কোটা থাকে বলে একাধিক শিক্ষক জানিয়েছেন। এরকম বেশ কয়েকজন শিক্ষক নেতা এবার কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য করার মিশন নিয়ে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন।
এছাড়াও একটি চক্র সরাসরি এসব নিয়োগ বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত। যার কারণে তড়িঘড়ি করে আবেদনপত্র আহ্বান করে যাচাই-বাছাই শেষ না করে পছন্দের প্রার্থীদের ডেকে এনে লোক দেখানে মৌখিক পরীক্ষা নেয়া হচ্ছে।
নাম প্রকোশে অনিচ্ছুক কয়েকজন শিক্ষক কর্মকর্তা জানান নিয়োগ বোর্ডে উপাচার্য এমন ব্যক্তিদের বাছাই করেছেন যারা তার কথামতো প্রার্থীদের পক্ষেই কথা বলবেন। যেমন বগুড়া আজিজুল হক কলেজের অধ্যক্ষকে কমিটিতে রাখা হয়েছে উনি উপাচার্যের দীর্ঘদিনের বন্ধু ফলে উনি বেশিরভাগ পরীক্ষায় উপস্থিত থাকছেন না। একইভাবে রংপুর বিভাগীয় কমিশনারকে নিয়োগ কমিটিতে রাখা হলেও উনি দাফতরিক ব্যস্ততার কারণে আসতে পারছেন না বলে জানা গেছে। এছাড়াও বাংলা বিভাগে শিক্ষক নিয়োগের নিয়োগ কমিটিতে এক শিক্ষক নেতার পছন্দের শিক্ষককে রাখা হয়েছে। অথচ অন্য বিভাগের কোন শিক্ষককে রাখা হয়নি। একইভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকর্মীসহ পছন্দের শিক্ষককে নিয়োগ কমিটিতে রাখা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। গত কয়েকদিন ধরে সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি বিভিন্ন পদে আবেদনকারীদের সাক্ষাৎকার নেয়ার নামে চলছে প্রহসন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন চাকরি প্রত্যাশী জানান যাদের নেয়া হবে তাদের নাম বাড়ি আর ছোটখাটো প্রশ্ন করে বিদায় করা হচ্ছে। অন্যদিকে যাদের নেয়া হবে না তাদের বিভিন্ন উদ্ভট প্রশ্ন করে বিদায় করে দেয়া হচ্ছে। চাকরি প্রত্যাশীদের অভিযোগ শুধুমাত্র সাক্ষাৎকার নিয়ে কোনদিন মেধা যাচাই করা যায় না। এভাবে এতগুলো পদে সাক্ষাৎকার নেয়ার নামে প্রহসন চালানো হচ্ছে। তারা এ ধরনের ভ-ামি বন্ধ করে লিখিত পরীক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে মেধা যাচাইয়ের সুযোগ দেয়ার দাবি জানান।
এদিকে উপাচার্য বেশ কয়েকটি বিভাগে শিক্ষক নিয়োগের জন্য সাক্ষাৎকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছেন। রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অন্য পদে সাক্ষাৎকার নিয়ে শুধু কয়েক বিভাগের শিক্ষক নিয়োগ কেন ঢাকায় নেয়া হচ্ছে এর কোন সদুত্তর পাওয়া যায়নি। জানা গেছে আগামী ৩১ মার্চ ও ১ এবং ২ এপ্রিল রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ইংরেজি, কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, ইলেকট্রনিঙ্ অ্যান্ড টেলিকমিউনিকেশন ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের আবেদনকারীদের সাক্ষাৎকার ঢাকায় নেয়া হবে বলে জানা গেছে। এতে প্রায় ২শ’ আবেদনকারী ঢাকায় গিয়ে সাক্ষাৎকার দেয়ার জন্য যেতে হবে। কিন্তু কেন এই সিদ্ধান্ত তার সঠিক ব্যাখ্যা কেউ দিতে পারছেন না। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন কর্মকর্তা জানান এসব বিভাগে চাকরি প্রত্যাশীদের মধ্যে যাদের চাকরি হবে তাদের নির্ধারণ করা হয়েছে। ফলে এটা হবে লোক দেখানো। তাছাড়া সাক্ষাৎকার নেয়া হবে লিখিত বা আর কোন পদ্ধতিতে পরীক্ষা নেয়া হবে না। এ ব্যাপারে রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন শিক্ষক নাম প্রকাশ না শর্তে সংবাদকে জানান কোন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে হয়েছে বলে জানা নেই। তাছাড়া ওই পরীক্ষা রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ঢাকায় যে লিয়াঁজো অফিস আছে সেখানেও করা যেত তা না করে কেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে করতে হবে এর নেপথ্যে উপাচার্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে ম্যানেজ করতে পারবেন বলে সেখানে করছেন।
রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের ৩৮ দিন চাকরির মেয়াদে এভাবে প্রহসনের নিয়োগ করার দাবি সব স্তরের মানুষের।
এ ব্যাপারে রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্টার ইবরাহিম কবীরের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলে তাড়াতাড়ি করতে গিয়ে একটু ভুল হতে পারে আমরা দিনরাত কাজ করছি। অনেককে এসএমএস দিচ্ছি বলে জানান। তবে কেন শিক্ষক নিয়োগের সাক্ষাৎকার ঢাকায় নেয়া হচ্ছে জানতে চাইলে তিনি বলেন এটা উপাচার্য ভালো বলতে পারবেন। তবে সেখানে এঙ্পার্টরা থাকবেন বলে ওখানে হচ্ছে বলে তার ধারণা।
এদিকে উপাচার্য অধ্যাপক নুর উন নবীকে তার মোবাইলে ফোন করা হলে ফোনটি বন্ধ পাওয়ায় তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
মন্তব্য চালু নেই