দুর্নীতির মানিক :
বেতন ৯৮০০, ব্যয় ২ লাখ টাকা
বান্দরবান উপজেলা সদর খাদ্য গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি এলএসডি) ফখরুল আলম ওরফে মানিক। বেতন পান ৯ হাজার ৮শ টাকা, আর প্রতি মাসে খরচ করেন সোয়া ২ লাখ। মাসে দু’এক দিন অফিসে হাজিরা দেন। চট্টগ্রাম মহানগরীর অভিজাত আগ্রাবাদ আবাসিক এলাকায় ৩৫ হাজার টাকার ভাড়া বাসায় থাকেন তিনি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সরকারি কাজ ফাঁকি দিয়ে ব্যক্তিগত কাজ করে অসৎ উপায়ে বিপুল অর্থ কামান তিনি। তিনি এখন কোটিপতি। সবাই জানার পরও তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। বান্দরবান জেলা খাদ্য কর্মকর্তা থেকে শুরু করে শীর্ষ কর্মকর্তা পর্যন্ত তার কাছ থেকে সুবিধা নেয়ার কারণেই তিনি নির্বিঘ্নে সব করে যাচ্ছেন।
বৃহস্পতিবার খাদ্য অধিদপ্তরের নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায়, মানিকের সরকারি মাসিক বেতন ৯ হাজার ৮শ টাকা হলেও খরচের তালিকা অনেক দীর্ঘ। তার এক ছেলে পড়ে রাজধানীর রাজউক উত্তরা মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজে, অপর ছেলে নটরডেম কলেজে এবং ছোট মেয়ে পড়ে ইংলিশ মিডিয়াম সিলভারডেল স্কুলে। ট্রাক কেনার কিস্তি বাবদ প্রতিমাসে ১ লাখ টাকা, বাড়িভাড়া প্রতিমাসে ৩৫ হাজার, ড্রাইভারের বেতন ১৪ হাজার, ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা বাবদ ৫০ হাজার, ঠিকাদারি লাইসেন্স পরিচালনার জন্য প্রতিনিধির বেতন ১১ হাজার ও অন্যান্য বাবদ ৩০ হাজার টাকা খরচ করতে হয়। অর্থাৎ তার প্রতিমাসে খরচ সোয়া ২ লাখ টাকার বেশি।
এ ব্যাপারে খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সারওয়ার খানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তার ব্যক্তিগত সহকারী জানান, মহাপরিচালক এ বিষয়ে কোনো কথা বলবেন না।
গত ৭ দিন খাদ্য অধিদপ্তরের পরিচালকের (প্রশাসন) সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করে বারবার দপ্তর থেকে জানানো হয়, ‘স্যার নিয়োগ পরীক্ষা নিয়ে ব্যস্ত আছেন। এ সময় তিনি কথা বলবেন না।’
খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তার জনসংযোগ কর্মকর্তা সুমন মেহদি বলেন, ‘এতো ছোট কর্মকর্তার সম্পর্কে মন্ত্রী কথা বলবেন না বলে জানিয়ে দিয়েছেন।’
মানিক ছোট কর্মকর্তা এবং তার ব্যাপারে মন্ত্রীর কথা বলা ‘অমর্যাদাকর’ হলেও তিনি কিন্তু প্রশাসনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করতে টাকার ভাগ দেন। ফলে কেউ তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে উদ্যোগী হন না। আর এ কারণে তিনি আরও বেপোয়ারা হয়ে উঠেছেন।
চলাচল ও সংরক্ষণ নিয়ন্ত্রকের (খাদ্য) এক তথ্য মতে, মানিকের মাধ্যমে সাজিদ এন্টারপ্রাইজ ২০১৩-১৪ অর্থবছরে বিল উত্তোলন করেছে ১৪ লাখ ২১ হাজার টাকা। কালাম অ্যান্ড সন্স ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বিল উত্তোলন করেছে ১৪ লাখ ৯৭ হাজার টাকা।
এসব প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে যত বিল হয় তার ২০ শতাংশ করে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে ভাগ দিতে হয়। মানিকের ঠিকাদারি লাইসেন্সের বিল আটকে থাকার নজির নেই।
মানিকের মেসার্স ছিদ্দিক এন্টারপ্রাইজ নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এ প্রতিষ্ঠানটির ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে বাড়ি নং ৬০৬, রোড নং ২২/২, সিডিএ আবাসিক এলাকা, আগ্রাবাদ চট্টগ্রাম। গত শুক্রবার এ ঠিকানায় গিয়ে এ নামে কোনো প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি।
চলাচল ও সংরক্ষণ নিয়ন্ত্রক (খাদ্য) জহিরুল ইসলাম জানান, খাদ্য বিভাগে কর্মরত কেউ ঠিকাদারি ব্যবসায় জড়িত থাকা আইনগতভাবে অবৈধ এবং অনৈতিক। সরকারি চাকরিবিধি অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
আরো জানা গেছে, মানিকের ব্যবহৃত প্রিমিও কারটি কেনা হয়েছে ১৮ লাখ টাকা দিয়ে। যার নম্বর চট্টমেট্রো গ ১২-৭৩২১।
বিআরটিএতে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কারটি নিবন্ধনে লেখা রয়েছে: জহিরুল ইসলাম, পিতা ওবাইদুল হক। ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে হাউস নম্বর ১১, রোড নম্বর ৩, লেন নম্বর ৫, ব্লক- কে, রামপুর, হালিশহর। ওই ঠিকানায় থাকেন জহিরুল ইসলাম নামে এক গাড়ি ব্যবসায়ী।
ঠিকাদারী ব্যবসার জন্য মানিক কিনেছেন দুটি ট্রাক। একটির নম্বর চট্টমেট্রো ট ১১-৩৯৭১। ট্রাকটি ২০১৩ সালের জুন মাসে স্ত্রীর নামে কেনা। ট্রাকটি কিনেছেন ৩৩ লাখ টাকা দিয়ে। ডাউনপেমেন্ট দিয়েছেন ১০ লাখ টাকা। এখন প্রতিমাসে ১ লাখ টাকা করে কিস্তি দেন।
তবে এসব তথ্য অস্বীকার করেছেন ফখরুল আলম মানিক। বিপুল সম্পত্তি, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ও দামি গাড়ি-বাড়ি থাকার বিষয়টি অস্বীকার করে তিনি ঔদ্ধত্যের সঙ্গে বলেন, ‘আমার সম্পর্কে নিউজ করার কিছুই নেই। যা শুনেছেন সবই মিথ্যা। আপনি পারলে নিউজ করেন।’
এ দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাকে ২০০৭ সালের ১ জুলাই যৌথবাহিনী খাগড়াছড়ির মানিকছড়ি খাদ্য গুদাম থেকে ঘুষের ৩০ হাজার টাকাসহ গ্রেপ্তার করেছিল। এ ঘটনায় তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। পরে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে আবার চাকরিতে বহাল হন। আবারও শুরু করেন ঘুষ দুর্নীতির মহাযজ্ঞ।
দুর্নীতিবাজ এ কর্মকর্তার ১০ একর জায়গা রয়েছে খাগড়াছড়ির মানিকছড়িতে। তিনি কয়েক বছর আগে আয়াত আলী নামে একজনের কাছ থেকে ৫০ লাখ টাকা দিয়ে জায়গাটি কিনেছেন।
এ ব্যাপারে জানতে চট্টগ্রাম বিভাগের আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক আবদুল আজিজ মোল্লার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘খাদ্য বিভাগে কর্মরত থাকলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান থাকার কথা নয়। বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখব। যদি সত্য হয়ে থাকে তাহলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।’ তথ্য : বাংলামেইল
মন্তব্য চালু নেই