বিপর্যস্ত জামায়াত দিশেহারা
দিশেহারা হয়ে পড়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। ১৯৭৫ সালের পর ইতিহাসের সবচেয়ে সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে পড়েছে দলটি। একের পর এক শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সর্বোচ্চ শাস্তি ঘোষণায় শঙ্কিত দলটির নেতারা। যুদ্ধাপরাধের মামলায় দলের আমিরসহ শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে রায়ে সপ্তাহজুড়ে হরতাল দিয়েও মাঠে সক্রিয় হতে পারছে না দলটি। একদিকে সরকারের চাপ ওপর দিকে বিএনপির সঙ্গে দূরত্ব ভাবিয়ে তুলছে দলের নীতিনির্ধারকদের। আত্মগোপনে থাকা শীর্ষ নেতারা ভুগছেন সিদ্ধান্তহীনতায়।
যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত নেতাদের দণ্ডের প্রতিবাদে সহিংসতায় করতে গিয়ে জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীদের কেউ কারাগারে, কেউ ফেরারি। ইতিপূর্বেই দলের নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করেছেন হাইকোর্ট। স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী দল হিসেবে তাদের রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবিও উঠছে জোরেশোরে। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট সরকার দ্রুত জামায়াত নিষিদ্ধে বিল আকারে মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের পর সংসদে উত্থাপনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে বিপর্যস্ত জামায়াতে ইসলাম। ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণে দিশেহারা দলের নেতারা।
জামায়াতের একধিক কেন্দ্রীয় নেতা ও কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নানা কারণে দলের এই বিপর্যয়। তবে একের পর এক জামায়াতের শীর্ষ নেতার ফাঁসির আদেশ ও রায় কার্যকরের ফলে বেশি বিপর্যস্ত দলটি। এছাড়াও দলটির সাবেক আমির গোলাম আযমের মৃত্যু, দলের রাজনীতি নিষিদ্ধ, অজস্র নেতাকর্মী আটক, জোটের শরিক ও বিদেশি বন্ধু রাষ্ট্রের প্রভাব হ্রাস পাওয়া। এসব কারণে সুবিধা করতে পারছে না দলটি।
তরিকত ফেডারেশনের মামলায় দলের নিবন্ধনের বৈধতা হারায় জামায়াতে ইসলামী। একই সঙ্গে জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবিতেও সোচ্চার ১৪ দলীয় জোটের শরিক তরিকত ফেডারেশন। এ প্রসঙ্গে দলটির মহাসিচব মহাসচিব এম এ আউয়াল এমপি বলেন, ‘জামায়াত বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল, মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে। এই দল বাংলাদেশে রাজনীতি করার কোন অধিকার রাখে না। আমরা আশাবাদি খুব দ্রুত মন্ত্রিসভায় জামায়াতকে দল হিসেবে নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত হবে। এরপর সংসদে পাস হবে। সরকার আন্তরিক স্বাধীনতারবিরোধী দলকে রাজনীতি থেকে নিষিদ্ধ করতে। আমরাও এই দাবিতে সক্রিয় আন্দোলন চালিয়ে যাবো।’
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ, ২০০১ সালে বিএনপির জোট সঙ্গী হলেও এখন একঘরে জামায়াত। নিবন্ধন অবৈধ হওয়ার পর জোট শরিক বিএনপি পাশে থাকলেও সক্রিয় থাকতে পারতো জামায়াত। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল নেতাদের অভিযুক্ত করার পাশাপাশি দলকেও অভিযুক্ত করেছেন। এখন সরকার বিরোধী হয়ে সহিংসতা চালালে রোষানলে পড়ে রাজনীতি নিষিদ্ধ হতে পারে এমন শংকা দলটির কেন্দ্রীয় নেতাদের।
একের পর এক প্রত্যেক যুদ্ধাপরাধীর রায় কার্যকর করার ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়েছে, বিচারের রায়ও আমরা কার্যকর করতে শুরু করেছি। একের পর এক রায় হবে, ইনশাল্লাহ প্রত্যেকটা রায় আমরা এ মাটিতে কার্যকর করবোই।’ সোমবার বিকেলে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনসভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ কথা বলেন।
ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি ও জামায়াতের কেন্দ্রীয় মজলিশে শুরা সদস্য ড. মুহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, ‘সরকার জামায়াত নির্মূলের ষড়যন্ত্র করছে। এজন্য একেরপর এক জামায়াত নেতা হত্যার রায় দেয়া হচ্ছে। কিন্তু ষড়যন্ত্র ও প্রহসনের মাধ্যমে সরকারের চাপিয়ে প্রাণদণ্ডাদেশ জনগণ কখনোই মেনে নেবে না। বরং যেকোনো মূল্যে সরকারের যেকোনো ষড়যন্ত্র সার্থকভাবে প্রতিহত করবে। আর কামারুজ্জামানকে হত্যার ষড়যন্ত্র করা হলে সরকারের পতন ঘণ্টা বাজবে। অন্যথায় এজন্য সরকারকে চরম মূল্য দিতে হবে।’
জামায়াতের মধ্যমসারির নেতারা মনে করেন জোটের শরিক বিএনপি জামায়াতের এই সঙ্কটময় মুহূর্তে নীরব থাকায় চলমান সঙ্কটে আরও একা পড়েছে। এসব কারণে সম্ভাব্য পরিস্থিতি মোকাবেলায় শক্তিশালী অবস্থান নিতে ব্যর্থ হয়ে জামায়াত গ্রহণ করেছে পুরনো পদ্ধতি। সিদ্ধান্ত হয়েছে সরকারপতনে চূড়ান্ত আন্দোলনে না গিয়ে মাঝারি মানের সহিংসতামূলক প্রতিক্রিয়া দেখানোর। বাকিটা পরিস্থিতির ওপরে ছেড়ে দিয়ে সুসময়ের অপেক্ষা করা। এতে করে নেতাকর্মীদের চাঙা রাখা যেমন সম্ভব হবে, তেমনি দল হিসেবে একটি উপস্থিতি থাকবে রাজনীতির মাঠে। পাশাপাশি বিএনপি সরকারপতনে তেমন আন্দোলন গড়ে তুলতে না পারায় সরকারের বিরুদ্ধে এখন বড় ধরনের সংঘর্ষে না যাওয়ার প্রাথমিক সিদ্ধান্ত রয়েছে জামায়াতের।
জামায়াত সূত্র এবং অনুসন্ধানে দেখা গেছে, অতিদ্রুততার সঙ্গে জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী, নির্বাহী পরিষদ সদস্য মীর কাসেম আলী, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কামারুজ্জামানের ফাঁসির রায় হওয়ার পর সীমাবদ্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে জামায়াত। গত রোববার মীর কাসেম আলীর রায়ের পর সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে সহিংস প্রতিক্রিয়া দেখালেও সেটি ২০১৩ সালের নাশকতার মতো ছিল না। দলের সকল স্তরের নেতাকর্মীদের মধ্যে মাঝারি মানের প্রতিক্রিয়া দেখানোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি ইসলামি আন্দোলন সফলের জন্য ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে বলা হয়েছে। জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষার সময় সহিংসতা চালালে দলের ভাবমূর্তি বিনষ্ট হবে বলেও ভাবছেন নেতারা।
যদিও ছাত্রশিবিরের নেতারা বলেছেন, সরকার একের পর এক জামায়াত নেতাকে ফাঁসি দিলে কোনও কিছুই বিনা চ্যালেঞ্জে ছেড়ে দিবেন না তারা। জবাব দেয়া হবে কঠোরভাবে।
আন্দোলন প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম জেলা শিবিরের সভাপতি মুহাম্মদ তারেক হোছাঈন বলেন, ‘মুসলিমদের ওপর নির্যাতন নিষ্পেষণ ইসলামের আদিযুগ থেকে চালু হয়েছে। নব্য নমরুদ ও ফেরাআউন ইসলামের মর্দে মুজাহিদকে হত্যা করে উল্লসিত হবে, এটাই স্বাভাবিক। তাই জামায়াত নেতারা মৃত্যুদণ্ডকে হাসিমুখে বরণ করে নিচ্ছেন জান্নাতের বিনিময়ে। কিন্তু তাদের উত্তরসূরীরা এ অন্যায় তো কখনও মেনে নিতে পারি না। গণমানুষের কাছে জামায়াত-শিবিরের জনপ্রিয়তা ক্ষুণ্ণ করতে জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষার সময় বেছে নিয়েছে নেতৃবৃন্দের রায় দেয়ার জন্য। জনগণ তা বুঝতে পেরেছে। তারা সরকারের অশুভ রায়কে কখনো কার্যকর করতে দিবে না। নিজেদের জীবন দিয়ে হলেও নেতৃবৃন্দের মুক্তি নিয়েই ছাড়বে। এ ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী নয়, অবশ্যই জনগণ সরকারের বিপক্ষে সমুচিত জবাব দেবে।’
জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবিতে দীর্ঘ সময় ধরেই সোচ্চার বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি ( সিপিবি)। দলটির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘একের পর এক যুদ্ধাপরাধীর সর্বোচ্চ দণ্ড দেয়ায় সমগ্র দেশবাসীর সাথে আমরাও সন্তোষ প্রকাশ করছি। একাত্তরে যারা জঘন্য অপরাধ করেছিল, তাদের সকলের বিচারের রায় মৃত্যুদণ্ড হবে এটাই স্বাভাবিক ও ন্যায়বিচার। এই রায় যাতে রাষ্ট্রপতি লাঘব বা মওকুফ করতে না পারেন, তার জন্য সংবিধান সংশোধনের গণদাবি দ্রুতই সরকারকে মেনে নিতে হবে। ব্যক্তির পাশাপাশি রাজনৈতিক দল ও শক্তি যুদ্ধাপরাধের সাথে জড়িত ছিল তাদের বিচারের ব্যবস্থা করতে দ্রুতই উচ্চ পর্যায়ের কমিশন গঠন করতে হবে। সবচেয়ে বড় দাবি আদালতের ঘোষিত যুদ্ধাপরাধী সংগঠন হিসেবে জামায়াত-শিবিরকে অবিলম্বে নিষিদ্ধ করতে হবে সরকারকে।’
তবে সহিংসতা করার কোনো সুযোগই জামায়াত-শিবির পাবে না বলে কঠোরভাবে জানিয়ে দিয়েছেন স্বরাষ্ট্রপ্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। তিনি বলেন, ‘আদালত রায় দিয়েছে এ নিয়ে সহিংসতা মেনে নেয়া হবে না। আইন শৃঙ্খলা বাহিনী প্রস্তুত আছে যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবেলায়। কঠোরভাবেই দমন করে জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে।’
পশ্চিমা বিশ্বের কয়েকটি দেশছাড়াও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো বিপদে-আপদে জামায়াতের পাশে দাঁড়িয়েছে বরাবর। পাশে আছে তুরস্ক, পাকিস্তানসহ কয়েকটি দেশ। যুদ্ধাপরাধের বিচার বন্ধে এসব দেশের ক্রমাগত চাপের পরও আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারকার্য চালিয়ে যাচ্ছেন। অব্যাহতভাবে হচ্ছে জামায়াতের অভিযুক্ত নেতাদের শাস্তিও। বিদেশি রাষ্ট্রগুলোর চাপের মুখেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনড় অবস্থানের কারণে জামায়াতের বিদেশি-চাপ কৌশল কাজে লাগেনি। সর্বোপরি, সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আরব আমিরাত সফরের পর সরকারের অবস্থান আরও কঠোর হয়ে উঠেছে। সব মিলিয়ে বিদেশিবন্ধু রাষ্ট্রগুলোর সহায়তায় কাজ না হওয়ায় ভেঙে পড়েছে জামায়াত। চলমান সঙ্কট আরও বাড়িয়ে দিয়েছে জামায়াতকে দল হিসেবে নিষিদ্ধ করার সরকারি তৎপরতায়। খুব শিগগিরই মন্ত্রিসভায় এ সংক্রান্ত একটি বিল অনুমোদন শেষে সংসদে তোলা হবে। এ ব্যাপারে ১৪ দলীয় জোটের পক্ষ থেকে সরকারকে চাপও দেয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে।
সোমবার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনসভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করে যুদ্ধাপরাধের রায় কার্যকর করা হবে। আমাদের ওয়াদা ছিল জনগণের কাছে- যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আমরা করব। অনেক হুমকি ধমকি অনেক কিছু এসেছে। কিন্তু আপনারা জানেন, বিচার হয়েছে এবং আল্লাহর রহমতে বিচারের রায় আমরা কার্যকর করতেও সক্ষম হবো।’
জানা গেছে, প্রকাশ্যে হুঙ্কার দিয়ে নেতাকর্মীদের চাঙা রাখার কৌশল জারি রাখার চেষ্টা করা হলেও আদতে কোনও অবস্থাতেই সহিংতার পথ বেছে নেবে না জামায়াত-শিবির। সর্বশেষ তথ্যমতে, গত রোববার পর্যন্ত সারা দেশে প্রায় ৬ হাজার নেতাকর্মী আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর হাতে আটক হয়েছে। আটকৃকতদের মুক্তি, জামিন, মামলা লড়া এবং তাদের পরিবারকে অর্থনৈতিক সহায়তা ছাড়াও আনুষঙ্গিক কাজের ভার বইতে বইতে প্রায় অসহায় অবস্থায় নিপতিত জামায়াত-শিবির।
সোমবার এক বিবৃতিতে জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল ডা. শফিকুর রহমান বলেন, ‘রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মাধ্যমে দেশকে নেতৃত্বশূন্য ও বিরোধী দল মুক্ত করার যে চক্রান্ত সরকার করছে দেশের জনগণ তা কখনো বাস্তবায়ন করতে দেবে না। সরকারের অগণতান্ত্রিক, স্বৈরাচারী ও ফ্যাসিবাদী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে জনগণ আজ ঐক্যবদ্ধ। রাষ্ট্রের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে দলীয় ক্যাডারের মতো ব্যবহার করে জামায়াতে ইসলামীকে নিশ্চিহ্ন করার যে পরিকল্পনা সরকার গ্রহণ করেছে তা কখনো বাস্তবায়ন করতে পারবে না। দেশের জনগণ সরকারের চক্রান্ত গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় প্রতিরোধ করবে।’
মন্তব্য চালু নেই