বিএনপি কার্যালয়ে বাতি জ্বালানোর কেউ নেই
পুলিশ প্রহরায় ৭১ দিন বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে নেতা-কর্মীদের পদচারণা না থাকায় ভেতরে এক ধরনের ভুতুড়ে পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। গত ৩ জানুয়ারি দিবাগত রাতে দলের যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীকে পুলিশ নিয়ে যাওয়ার পর এই কার্যালয়ের কর্মচারীদের বের করে দিয়ে তা তালাবদ্ধ করে রাখা হয়। সেই থেকে জনমানবহীন কার্যালয়টি ধু-ধু অন্ধকার, প্রবেশপথে জমেছে ধুলার আস্তরণ। তবে কার্যালয়ের সামনে সতর্ক দায়িত্ব পালন করছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
রোববার কার্যালয়ের সামনে গিয়ে দেখা গেছে, যে কার্যালয় ঘিরে সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত নেতা-কর্মী ও গণমাধ্যম কর্মীদের ভিড় থাকত, সেখানে এখন সুনসান নীরবতা। কার্যালয়ের প্রধান ফটকটিতে বড় ধরনের তালা ঝুলছে। তার ভেতরে হকারদের দেওয়া প্রতিদিনের বিভিন্ন ধরনের অসংখ্য পত্রিকা জমেছে। এর ওপরে ধুলার আস্তরণ সাক্ষী দিচ্ছে, অনেক দিন সেখানে প্রবেশ করেননি কেউ। এই সুযোগে মাকড়সারা জাল ফেলেছে পরম নিরাপত্তায়!
নেতা-কর্মীদের পদচারণায় মুখর কার্যালয়টিতে এখন শুধুই নীরব নিস্তব্ধতা। ফটকের পাশে দেয়ালে দলটির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের ম্যুরালের ওপরও ধুলোর স্তর। মেঝেতে ডাকযোগে আসা কিছু নথিও পড়ে থাকতে দেখা গেছে। কার্যালয়ের ঠিক নিচতলায় বিএনপির প্রকাশনা বিভাগের শোরুমটিও বন্ধ।
কার্যালয়ে সামনে অনেকটা বিশৃঙ্খলভাবে ঝুলছে বিদ্যুৎ, টেলিফোন, স্যাটেলাইটের ক্যাবল। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান, বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জানিয়ে টানানো ব্যানারেরও করুণ দশা। কোনোটা ছিঁড়ে পড়েছে, কোনোটা বা ছিঁড়ে পড়ার অপেক্ষায়। কার্যালয়ে আশপাশের দেয়াল কদিন পরপর নতুন পোস্টারের ছেয়ে যাওয়ার রীতি থাকলেও এখন এখানে সেই সুযোগ নেই। ধুলার আবরণে কার পোস্টার তা যেন চেনা দায়!
রাজধানী ঢাকার ব্যস্ততম এলাকা নয়াপল্টনে অবস্থিত বিএনপির এই কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে দিয়ে এখন সাধারণ মানুষের চলাচলও সীমিত। চারতলা ভবনটির ভেতরে-বাইরের পরিবেশ অনেকটাই ভুতুড়ে। রাতে ভেতরে বা বাইরে আলো জ্বালানোর কেউ নেই।
গত ৩ জানুয়ারি রাতে দলের যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে দেখতে আসার সিদ্ধান্ত নেন গুলশানে নিজের রাজনৈতিক কার্যালয়ে অবস্থান করা দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। ওই রাতেই গুলশান কার্যালয় ঘিরে রাখেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। ‘অবরুদ্ধ’ হয়ে পড়েন বিএনপির চেয়ারপারসন।
অন্যদিকে অসুস্থ রিজভীকে কার্যালয় থেকে নিয়ে যায় ডিবি পুলিশ। পরে তাকে হাপসাতালে ভর্তি করা হয়। এ সময় কার্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও বের করে দেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। পরে পুলিশ মূল ফটকে দুটি তালা ঝুলিয়ে দেয়। তখন থেকে কার্যালয়টি পুলিশি প্রহরায় রয়েছে। ওই দিন থেকে কার্যালয়ের নিচে পালাক্রমে দায়িত্ব পালন করছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। তবে কার্যালয় থেকে কর্মচারীদের বের করে দেওয়ার আগে মূল গেটে লাগানো তালার চাবি বয়স্ক কর্মচারী রুস্তম আলীর কাছে বুঝিয়ে দেওয়া হয়। এরপর কিছুদিন কার্যালয়ে গেছেন রুস্তম। কিন্তু তাকে ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। কার্যালয় বন্ধ থাকায় কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন-ভাতাও বন্ধ।
জানা গেছে, ওই কার্যালয়ে বিএনপির ১৪ জন এবং অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের ২৫ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী কাজ করতেন। কার্যালয়ে তালা লাগানোর পর অনেকে গ্রামের বাড়ি চলে গেছেন। কেউ কেউ রাজধানীতেই আত্মীয়স্বজনের বাসায় থাকছেন। কখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে, আর কবে কার্যালয়ে যেতে পারবেন, সেই আশায় দিন গুনছেন তারা।
কার্যালয়ের কর্মচারীদের একজন আবু সাঈদ আজাদ। বিভিন্ন সংবাদ সম্মেলনে যিনি সাংবাদিকদের আপ্যায়ন করতেন। কার্যালয় দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর এখন নিজ জেলা নোয়াখালীতে চলে গেছেন তিনি। রোববার তিনি বলেন, ‘কার্যালয়ের জন্য মায়া লাগে। কত দিন সেখানে নেই। অনেক লোক আসত, জমজমাট থাকত, অনেক ভালো লাগত।’ কবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে, তাও জানতে চান দীর্ঘদিন কার্যালয়ে চাকরি করা এই কর্মচারী।
আজাদ জানান, গত জানুয়ারি থেকে তিনিসহ অন্য কর্মচারীরা বেতন পাচ্ছেন না। দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জেলে। তাই চেক পাওয়া যাচ্ছে না। বেতনও হচ্ছে না। ফলে মানবেতর জীবন যাপন করছেন তারা।
একটি গণতান্ত্রিক দেশে প্রধান বিরোধী দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়টি ‘তালাবদ্ধ’ করে রাখার বিষয়টি ‘সভ্য সমাজে বিরল’ ঘটনা মন্তব্য করে বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরামের সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান। তিনি বলেন, ‘শুধু কেন্দ্রীয় কার্যালয় নয়, গুলশানের চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ও অবরুদ্ধ। এটিকে কোনোভাবে ব্যাখ্যা করা যায় না। গণতান্ত্রিক দেশে এই ধরনের ঘটনা মেনে নেওয়া যায় না।’ কার্যালয়ের স্বাভাবিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য এটিকে খুলে দেওয়ার দাবি জানান বিএনপির এই নেতা।
মন্তব্য চালু নেই