বিএনপি এখন যা করতে পারে
বাংলাদেশের রাজনীতিতে ক্রমশ এক বিরক্তকর দলে পরিণত হচ্ছে বিএনপি৷ তারা আন্দোলনের ডাক দিয়ে পিছু হটা একটা দল, যারা কিনা আপাতদৃষ্টিতে জনগণের কাছ থেকে একেবারেই বিচ্ছিন্ন৷ অথচ এই দলের রয়েছে একটি বিরাট ‘ভোটব্যাংক’৷
২০১৪ সালে বাংলাদেশে সংসদীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়৷ যদিও নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে না হওয়ায়, সেই নির্বাচন ঠেকানোর চেষ্টা করেছিল বিএনপি এবং তাদের সমর্থনকারী বিভিন্ন রাজনৈতিক দল৷ বিএনপি অবশ্য নির্বাচনটি বর্জন করলেও ঠেকাতে পারেনি৷ তবে সেসময় ক্ষমতাসীনদের সবচেয়ে বিপাকে ফেলেছিল জাতীয় পার্টি৷ দলটির সিদ্ধান্ত গ্রহণে গড়িমসি, নির্বাচনে অংশ নেয়া, না নেয়ার নাটকের ফলে, অর্থাৎ প্রার্থী সংখ্যার অপ্রতুলতার কারণে নির্বাচনে ১৫৩টি আসনে ভোট গ্রহণের প্রয়োজন হয়নি৷
মোট ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৩ আসনে ভোটাভুটি না হওয়ায় স্বাভাবিকভাবে নির্বাচনটি গুরুত্ব হারায়৷ কেননা দৃশ্যত অর্ধেকের বেশি ভোটার ভোট দেয়ার সুযোগই পায়নি৷ তাই ইউরোপীয় ইউনিয়ন এটাকে একটি ‘একতরফা নির্বাচন’ বলেই চিহ্নিত করে৷
নির্বাচিত প্রতিবেদন
নির্বাচনের পর আমি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলেছি৷ তাঁদের মধ্যে আওয়ামী লীগের সমর্থক যেমন ছিলেন, ছিলেন বিএনপি এবং অন্যান্য দলের সমর্থকরাও৷ যাঁরা নিজেদের দলকে নিরপেক্ষ বলে দাবি করেন, তাঁদের সঙ্গেও কথা হয়েছে৷ সবাই একটি জায়গায় একমত৷ আর তা হচ্ছে, ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনে জনগণ ভোট দেয়ার সুযোগ পায়নি৷ যদিও সংবিধানের নিয়মনীতি মেনেই নির্বাচনটি করা হয়েছে৷
বিএনপি-র যা বোঝা উচিত
জানুয়ারির ঐ নির্বাচন থেকে দু’টি বিষয় পরিষ্কার হয়েছে৷ প্রথমত, বিএনপি-র পক্ষে জোটে যেই থাকুক না কেন, আন্দোলন করে আওয়ামী লীগের কাছ থেকে কিছু আদায় করা কিংবা সরকারের পতন ঘটানো সম্ভব নয়৷ দ্বিতীয়ত, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে অনঢ় থেকে বিএনপি আসলে তার অনুগত ভোটারদের প্রতি অবজ্ঞা করেছে, যেটা তাদের উচিত হয়নি৷
তবে এটাও ঠিক যে, বিএনপি ঠেকাতে না পারলেও জাতীয় পার্টির কারণে নির্বাচনটি গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে৷ এছাড়া ভারতসহ কিছু দেশ নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে আওয়ামী লীগকে সমর্থন করায় দলটির পক্ষে ক্ষমতায় টিকে থাকা সহজ হয়েছে৷ কিন্তু একতরফা নির্বাচন জয়ের ‘খোঁটা’ আওয়ামী লীগকে হজম করতে হচ্ছে৷ আর এটাই ৫ই জানুয়ারি থেকে বিএনপি এবং তার মিত্রদের একমাত্র অর্জন৷
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই অর্জন বিএনপি কি কাজে লাগাতে পেরেছে? গত এক বছরে দৃশ্যত দলটি এই অর্জন দিয়ে নতুন কোনো কিছু গড়তে পারেনি৷ পারেনি এই বিষয়টিকে বড় করে জনগণের কাছে, আন্তর্জাতিক সমাজের কাছে তুলে ধরতে৷ বরং লন্ডনে অবস্থানরত দলটির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান বিভিন্ন সময় জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করে নেতাকর্মীদের মনোযোগ অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিয়েছেন৷
বিএনপি-র আচরণ এখন অনেকটা নাবিক ছাড়া নৌকার মতো মনে হচ্ছে৷ নেতাদের মুখে বার বার সরকারের পতন ঘটনোর হুংকার থাকলেও, সুনির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা নেই৷ দলটি কারা পরিচালনা করছে তা স্পষ্ট নয়৷ স্পষ্ট নয় যুদ্ধাপরাধীদর বিচার, জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্কের প্রশ্নে বিএনপি-র অবস্থান৷ ফলে দলটি ক্রমশ জনগণের কাছ থেকে, নিজেদের সমর্থকদের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে৷
বিএনপির শক্তি কারা?
বিএনপি-র ভবিষ্যত তাহলে কী? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে হলে দেখতে হবে বিএনপি-র শক্তি কোথায়৷ দলটির শক্তি হচ্ছে নিরব ভোটাররা৷ এই ভোটাররা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মতো রাজপথ কাঁপাতে পারে না৷ তবে ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার সুযোগ পেলে ভোটটা ‘ধানের শীষে’ ঠিকই দিতে পারে৷ এমন ভোটার অনেক৷ বিএনপি অতীতে যেসব নির্বাচনে অংশ নিয়েছে, সেগুলোর পরিসংখ্যান ঘাটলেই বিএনপি-র এই শক্তি সম্পর্কে আন্দাজ করা যেতে পারে৷
এই শক্তি কাজে লাগাতে চাইলে বিএনপি-র তাই এখন প্রয়োজন আরেকটি নির্বাচন৷ আর সেটা পেতে গেলে জনগণের সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততা বাড়াতে হবে৷ জ্বালাও, পোড়াও ছাড়া যে সব কর্মসূচিতে দলটির সমর্থকদের সম্পৃক্ত করা যায়, সেগুলো করতে হবে৷ অনলাইনে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিএনপি-র কোনো অস্তিত্ব নেই৷ অথচ বাংলাদেশের চার কোটি মানুষ, যাঁদের মধ্যে অধিকাংশই তরুণ, এখন ইন্টারনেটের সঙ্গে সম্পৃক্ত৷ তাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দলটির শক্ত অবস্থান গড়তে হবে৷ যেসব ইস্যুতে জনগণের আগ্রহ রয়েছে, সেসব ইস্যু নিয়ে কাজ করতে হবে৷ মোট কথা, বিএনপি যে সক্রিয় আছে, সেটা হরতাল ছাড়াও জনগণকে বোঝানোর উপায় বের করতে হবে৷
একইসঙ্গে আওয়ামী লীগের সঙ্গে অনেকক্ষেত্রে ছাড় দিয়ে হলেও রাজনৈতিক সংলাপের পথ প্রশস্ত করতে হবে৷ রাজপথে হানাহানি না করে সত্যিকারের সংলাপের সদিচ্ছা নিয়ে এগিয়ে গেলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনের, কূটনীতিকদের সহায়তা পাবে বিএনপি৷ আর সেটা করতে হবে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে, জনগণকে পাশে রেখে৷ একমাত্র তবেই তো ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব!
মন্তব্য চালু নেই