বিএনপির দাপট হাইকোর্টেই !

সরকারবিরোধী আন্দোলনে মাঠের রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করতে না পারলেও উচ্চ আদালত অঙ্গনে বেশ দাপট বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের। হাইকোর্ট এলাকায় তারা সভা সমাবেশসহ সরকারবিরোধী নানা কর্মসূচি পালন করছেন প্রতিনিয়ত। এমনকি দলটির বিভিন্ন ঘোষণা ও বিবৃতি গোপনে থেকে দেয়া হলেও সুপ্রিমকোর্ট এলাকার রাজনীতিতে তারা প্রকাশ্য।

অপরদিকে সুপ্রিমকোর্ট অঙ্গনে মাঝে-মধ্যে সরকার সমর্থিত আইনজীবীদেরকে দুই একটি আলোচনা সভা ও মিছিল মিটিং করতে দেখা গেলেও বড় ধরনের কোনো কর্মসূচি তারা পালন করেন না। তবে গত ৫ জানুয়ারির পর বিএনপি-জামায়াতসহ ২০ দলীয় জোটের হরতাল-অবরোধের বিরুদ্ধে কিছুদিনের জন্য মানববন্ধন করতে দেখা গেছে আওয়ামীপন্থি আইনজীবীদের।

মূলত গত নির্বাচনের আগে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার ডাকা ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’ কর্মসূচি পালনের মধ্য দিয়ে উচ্চ আদালতে বিএনপি ঘরানার আইনজীবীরা সুপ্রিমকোর্ট এলাকায় আন্দোলন কর্মসূচিতে শক্ত অবস্থান নিয়েছেন। সেই থেকে এখনো আদালতপাড়ায় তাদের দাপট বলবৎ। এখানকার বাড়তি সুবিধা হলো- আদালত এলাকা থেকে পুলিশ কোনো ব্যক্তিকে ধর-পাকড় করতে পারে না। এ নিয়মের পুরোমাত্রায় সুযোগ নিচ্ছেন বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা। ফলে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিএনপিপন্থিদের গণহারে আটক করলেও সুপ্রিমকোর্ট এলাকা থেকে পুলিশ কাউকে আটক করতে পারছে না। তার উপর সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতি ও বার কাউন্সিলের নেতৃত্ব বিএনপিপন্থিদের হাতে থাকায় তারা এ জায়গাটিকে স্বাচ্ছন্দে ব্যবহার করছেন।

শুধু বিএনপিই নয়, বিএনপির ছত্রছায়ায় থেকে এ সুযোগকে কাজে লাগাতে ভুল করছেন না জামায়াতপন্থি আইনজীবীরাও। তারা সরকারবিরোধী আন্দোলন কর্মসূচি পালন করছেন বিএনপির সঙ্গেই। সুপ্রিমকোর্টের বেশ কয়েকজন সিনিয়র আইনজীবী দলটির গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকায় এই এলাকার আন্দোলনকে তারা শক্ত করতে পেরেছেন বলে ধারণা অনেকের।

দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা, যুগ্ম-মহাসচিবসহ বড় বড় পদের কয়েকজন সিনিয়র আইনজীবী সুপ্রিমকোর্টে নিয়মিত প্র্যাকটিস করেন। দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য জাতীয় সংসদের সাবেক স্পিকার সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার; সাবেক মন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ; দলটির আইনজীবীদের সংগঠন জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাবেক মন্ত্রী ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া; বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান, সাবেক মন্ত্রী ও অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি টিএইচ খান; অ্যাডভোকেট মীর নাসির আহমেদ; চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির চারবারের সভাপতি অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন; উপদেষ্টা ও সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল ও সুপ্রিমকোর্ট বারের সাবেক সভাপতি এজে মোহাম্মাদ আলী; উপদেষ্টা ও সুপ্রিমকোর্ট বারের সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন; দলটির যুগ্ম-মহাসচিব ও সুপ্রিমকোর্ট বারের তিনবারের সম্পাদক ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন; বিএনপির কেন্দ্রীয় মানবাধিকার বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার নাসির উদ্দিন আহমেদ ওয়াসিম; সহ-আইন বিষয়ক সম্পাদক সাবেক মন্ত্রী অ্যাডভোকেট নিতাই রায় চৌধুরী; সুপ্রিমকোর্ট বারের সাবেক সম্পাদক ও জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের সুপ্রিমকোর্ট শাখার সেক্রেটারি ব্যারিস্টার বদরুদ্দোজা বাদল; জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের কেন্দ্রীয় দপ্তর সম্পাদক ব্যারস্টার রাগিব রউফ চৌধুরীসহ অনেক বড় বড় আইনজীবী এখানকার আন্দোলন সংগ্রামে ভূমিকা রাখছেন।

মূলত জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম, সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতি, বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ব্যানারে বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা কর্মসূচি পালন করে থাকেন। চেয়ারপারসন ও দলের পক্ষে কোনো ইস্যু থাকলে তারা জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের ব্যানারে কর্মসূচি পালন করেন। এছাড়া দেশের বিভিন্ন ক্রান্তিকাল, আপদকালীন তারা সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতি ও বার কাউন্সিলের ব্যানারে অরাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করে থাকেন। সাধারণত এসব কর্মসূচির নেতৃত্বে থাকেন সুপ্রিমকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ও দলের বড় পদে থাকা নেতারা।

তবে বিএনপির অনেক সিনিয়র আইনজীবী সুপ্রিমকোর্টে প্র্যাকটিস করলেও অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া, অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন, ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকনকে এসব কর্মসূচির মুখপাত্র হিসেবে দেখা যায়।

এবারের সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে বিএনপির বড় বড় নেতা ও সাবেক মন্ত্রী-এমপিরা মাঠে ছিলেন সরব। অন্যদিকে সরকার সমর্থিত আইনজীবী ও প্রভাবশালী মন্ত্রীদেরকেও নির্বাচনী মাঠে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে দেখা গেছে। তবে বিএনপিপন্থিদের দাপটে কিছুই করতে পারেননি তারা।

চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, ‘আমরা দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিমকোর্টে গণতন্ত্র রক্ষার জন্য আজীবন চেষ্টা চালিয়ে যাবো। দেশের মানবাধিকার ও আইনের শাসনের জন্য আমরা আন্দোলন করছি। জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও এই অঙ্গনে আইনের শাসন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা অব্যাহত রাখবো।’

আইনজীবীদের আন্দোলনেই স্বৈরাচার সরকারের পতন হয়েছিল মন্তব্য করে এ আইনজীবী নেতা বলেন, ‘আইনজীবীরা কালো কোট পরে মাঠে নামলে এ সরকারের অবশ্যই পতন হবে।’

বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব ও সুপ্রিমকোর্ট বারের সম্পাদক ব্যারিস্টার এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, ‘আইনের শাসন, মানবাধিকার আজ ভুলুণ্ঠিত। এ সরকার ক্ষমতায় এসেছে জোর জবরদস্তি করে। তারা অন্যায়ভাবে ক্ষমতায় থেকে সাধারণ মানুষ ও বিরোধী নেতাকর্মীদের ওপর অত্যাচার নির্যাতনের স্টিমরোলার চালাচ্ছে। নির্যাতনকারী সরকারের হাত থেকে দেশবাসীকে রক্ষা করতেই আমারা (আইনজীবীরা) অবিরাম আন্দোলন কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছি। আমরা শপথ করেছি সরকার পতন না হওয়া পর্যন্ত আমরা ঘরে ফিরে যাবো না।’

তবে বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন সুপ্রিমকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ও আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলির সদস্য অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন। তিনি বলেন, ‘আমরা সুপ্রিমকোর্ট অঙ্গনকে রাজনীতির মাঠ হিসেবে ব্যাবহার করতে দেবো না। এখানে সাধারণ মানুষ আসে ন্যায় বিচার পেতে। কাজেই এখানে রাজনীতি করলে বিচারপ্রার্থীরা বঞ্চিত হবেন।’

তিনি বলেন, ‘আইনের শাসনের জন্য আমাদের সরকার কাজ করে যাচ্ছে। আমরা সাংবিধানিকভাবেই ক্ষমতায় এসেছি। মানুষের মৌলিক অধিকার ও আইনের শাসনের জন্য কাজ করে যাবো।’



মন্তব্য চালু নেই