বিংশ শতাব্দীর মহানায়ক ‘ফিদেল কাস্ত্রো’

সাফাত জামিল শুভ, (চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়) : শক্তিধর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাকের ডগায় সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে বিশ্ব জুড়ে নজির স্থাপন করার গৌরব বোধহয় একজনেরই প্রাপ্য, তিনি ফিদেল আলেসান্দ্রো কাস্ত্রো। যিনি ব্যক্তিজীবনে অসম্ভব সাহসী ও দৃঢ়চেতা জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক নেতা ও সমাজতন্ত্রী বিপ্লবী হিসাবে কিংবদন্তী মর্যাদায় আসীন। স্নায়ুযুদ্ধ এবং বিশ্বব্যাপী মার্কিন নেতৃত্বাধীন পুঁজিবাদের জয়জয়কারের মধ্যেও সমাজতান্ত্রিক কিউবাকে টিকিয়ে রেখে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রবাদ পুরুষ হিসেবে পরিচিতি পান তিনি।

১৯২৬ সালের ১৩ আগস্ট কিউবার পূর্বাঞ্চলে বিরান জেলায় স্পেনীয় বংশোদ্ভূত এক অসচ্ছল অভিবাসী পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন তিনি। বিংশ শতাব্দির এ মহানায়ক, বিশ্বব্যাপী মার্কিন নেতৃত্বাধীন পুঁজিবাদের জয়জয়কারের মধ্যেও সমাজতান্ত্রিক কিউবাকে টিকিয়ে রেখে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রবাদ পুরুষ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছেন।

আপাদমস্তক মার্কসবাদী বিপ্লবী চে গুয়েভারার সংষ্পর্শে এসেই ফিদেল কাস্ত্রো ক্রমান্বয়ে বিপ্লবী হয়ে উঠেন। বিখ্যাত টাইম ম্যাগাজিন কিউবা জয়ের তিন বছর পর অত্যন্ত যথার্থ ভাবেই চে গুয়েভারাকে “কেস্ত্রোর মস্তিস্ক” বলে আখ্যায়িত করেছিল।

হাভানা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে পড়ার সময় প্রেসিডেন্ট ফালজেন্সিও বাতিস্তা এবং কিউবার উপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক প্রভাবের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী সমালোচনা নিবন্ধ লিখে তাঁর রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়। একপর্যায়ে ১৯৪৭ সালে নবগঠিত কিউবান পিপলস পার্টিতে যোগ দেন ফিদেল কাস্ত্রো। রাজনীতিতে যোগ দিয়েই তুখোড় বক্তা কাস্ত্রো মার্কিন ব্যবসায়ী শ্রেণী ও সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অবিচার, দারিদ্র, বেকারত্ব ও নিম্ন মজুরীর অভিযোগ নিয়ে লড়াইয়ের আহ্বান জানিয়ে দলের তরুণ
সদস্যদের মধ্যে দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করেন।

কিউবা বিপ্লব ও বিপ্লবের পরিকল্পনায় কাস্ত্রের প্রথম পদক্ষেপ ছিল মেক্সিকো হতে কিউবায় আক্রমণ চালানো। সে লক্ষ্যেকে সামনে রেখেই চে গুয়েভারারকে সঙ্গে নিয়েই গেরিলা দল গড়ে তোলার জন্যে মেক্সিকোয় পাড়ি জমান ফিদেল। সেখানে একটি গেরিলা দল গঠন এবং পর্যাপ্ত অস্ত্রশস্ত্র জোগাড়ের পর চে গুয়েভারা, জুয়ান আলমেইডাসহ প্রায় ৮০ জনের একটি বিপ্লবী দল নিয়ে ১৯৫৬ সালে কিউবায় ফিরে আসেন ফিদেল।

১৯৫৩ সালের ২৬ জুলাই মনকাডার সেই হামলার নামানুসারে ফিদেল কাস্ত্রো নেতৃত্বাধীন গেরিলা দল ‘জুলাই টুয়েন্টি সিক্স মুভমেন্ট’ হিসেবে গোটা কিউবা জুড়ে ব্যপক পরিচিতি ও জনপ্রিয়তা লাভ করে।

১৯৫৮ সালের মাঝামাঝি বাতিস্তার প্রায় হাজার খানেক সেনা গেরিলাদের হাতে প্রাণ হারালে যুক্তরাষ্ট্র বিমান, বোমা, জাহাজ ও ট্যাংক পাঠিয়ে গেরিলাদের দমানোর চেষ্টা করে। কিন্তু তৎকালীন নাপাম বোমার মতো সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করেও গেরিলাদের সঙ্গে বাতিস্তা ব্যার্থ হওয়ায় বাতিস্তাকে নির্বাচন দেওয়ার পরামর্শ দেয় যুক্তরাষ্ট্র।

১৯৫৮ সালের মার্চে বাতিস্তা কিউবাতে নির্বাচন দিলেও সে দেশের জনগণ ঐ নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করেন। ফিদেলের সেনারা চারদিক দিয়ে রাজধানী হাভানাকে ঘিরে ফেলা শুরু করলে ১৯৫৯ সালের পহেলা জানুয়ারি কিউবা ছেড়ে পালিয়ে যান জেনারেল বাতিস্তা।
পরে ৯ জানুয়ারি রাজধানী হাভানায় ঢুকে দেশের নিয়ন্ত্রণভার গ্রহন বরেন ফিদেল কাস্ত্রোর গেরিলারা। আর এরই মধ্যো দিয়ে কিউবার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন ফিদেল।

এই আজীবন বিপ্লবী ১৯৬৫ সালে কমিউনিস্ট পার্টি অফ কিউবার সাধারণ স¤পাদক নির্বাচিত হন এবং কিউবাকে একটি সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রে রূপান্তরের কাজ শুরু করেন। ১৯৭৬ সালে কিউবার প্রেসিডেন্ট অফ দ্য কাউন্সিল অফ স্টেটস এবং কাউন্সিল অফ দ্য মিনিস্টারস নির্বাচিত হন তিনি। একইসঙ্গে সশস্ত্র বাহিনীর কমান্ডার ইন চিফ হিসেবেও দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

৪৯ বছর ধরে কিউবা শাসন করেছেন কাস্ত্রো। যে কিউবা একসময় যুক্তরাষ্ট্রের প্লেগ্রাউন্ড বলে বিবেচিত হতো, যেখানকার দরিদ্ররা সামাজিকভাবে অসমতায় বাস করতো-সেই কিউবাকে রেকর্ড মানবাধিকারের দেশে পরিণত করেছিলেন কাস্ত্রো। কারও কারও কাছে তিনি নায়ক বলে বিবেচিত হতেন। সমর্থকদের চোখে কাস্ত্রো ছিলেন এমন এক নেতা যিনি জনগণের কাছে দেশকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। তবে তার বিরোধীরা বলতো, কাস্ত্রো বিরোধীদের দমন-পীড়নের ক্ষেত্রে নৃশংসতা দেখিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র এবং এর কয়েকটি মিত্র দেশের কাছে হুমকিজনক বলে বিবেচিত ফিদেল কাস্ত্রো লাতিন আমেরিকা ও আফ্রিকাসহ বিভিন্ন দেশের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবীদের কাছে সমাদৃত ছিলেন।

কিউবা-বিপ্লবের পরবর্তি অর্ধশত বছর ধরে পরপর ১০ জন মার্কিন প্রেসিডেন্ট কমরেড ফিদেল কাস্ত্রোকে হত্যা কিংবা উৎখাতের লাগাতার চেষ্টাকে ব্যার্থ করে দিয়ে কিউবার শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন তিনি। অবশেষে স্বাস্থ্যগত কারণে ৮১ বছর বয়সে স্বেচ্ছায় কিউবার প্রেসিডেন্টের পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়ে ২০০৬ সালের ৩১ জুলাই সাময়িকভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন রাউল কাস্ত্রোর নিকট।

কেবল সমাজতন্ত্রের অনুসারী নয়, বিশ্বব্যাপী নানা মত ও পথের কোটি কোটি মানুষের কাছে পৌরাণিক এক চরিত্রের অধিকারী কমরেড ফিদেল কাস্ত্রোর আজ জীবনাবসান হল। স্থানীয় সময় শুক্রবার কিউবার রাজধানী হাভানায় ৯০ বছর বয়সে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের এ আইকন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

এই মহান বিপ্লবীর প্রতি লাল সালাম।



মন্তব্য চালু নেই