বাফুফে নির্বাচন নিয়ে যা হলো এবার
সীমাহীন মিথ্যাচার, নানামুখী অশুভ তৎপরতা, তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে ভোটার ডেলিগেটদের প্রভাবিত করার চেষ্টা, সর্বোপরি নজিরবিহীন ‘নন স্পোর্টিং’ পারিপার্শ্বিকতার মধ্যে শনিবার রাজধানীর র্যাডিসন হোটেলে অনুষ্ঠিত হলো বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের ২০১৬ সালের নির্বাচন।
বাংলাদেশের ফুটবলের কিংবদন্তী কাজী সালাউদ্দিন টানা তৃতীয়বারের মতো বাফুফে সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন। সিনিয়র সহ-সভাপতি পদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন সালাহউদ্দিন প্যানেলের সালাম মুর্শেদী। সহ-সভাপতি পদে নির্বাচিত হয়েছেন কাজী নাবিল আহমেদ, বাদল রায়, মহিউদ্দিন আহমেদ মহি ও তাবিথ আওয়াল।
এর মধ্যে একমাত্র তাবিথ আওয়াল স্বতন্ত্র প্রার্থী। বাকি তিনজন সালাহউদ্দিন প্যানেলের। এছাড়া, ১৫টি সদস্য পদের মধ্যে ১২টিতে জয়ী হয়ে ‘বাঁচাও ফুটবল প্যানেল’র বিপক্ষে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় সালাউদ্দিনের সম্মিলিত পরিষদ।
শেখ জামাল ধানমণ্ডি ক্লাবের সভাপতি মঞ্জুর কাদের ও ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের ডাইরেক্টর ইনচার্জ লোকমান হোসেন ভূঁইয়ার নির্দেশনা ও পরিচালনায় ‘বাঁচাও ফুটবল পরিষদ’র বিভিন্ন নোংরা নির্বাচনি কর্মকাণ্ডে এবারের বাফুফে নির্বাচন বিশেষ বৈশিষ্ট্যে বিশেষায়িত।
একমাস আগে থেকে এজিএম ও নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে যায় নানা অশুভ তৎপরতা। বাঁচাও ফুটবলের নেতারা নরসিংদী-২ আসনের স্বতস্ত্র সংসদ সদস্য কামরুল আশরাফ খান পোটনকে কাজী সালাউদ্দিনের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দাঁড় করান। জাতীয় পর্যায়ে ফুটবল বা অন্য কোনও খেলার সঙ্গে সম্পৃক্ততা না থাকলেও পোটনকে প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করানোটা ছিল বাচাঁও ফুটবলের বিস্ময়কর উদ্যোগ।
এর সঙ্গে যোগ হয় উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মিথ্যাচার। বলা হয় পোটন নাকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আশীর্বাদপুষ্ট প্রার্থী! টানা দুই মেয়াদে আট বছর বাফুফে সভাপতি পদে থাকা সালাউদ্দিনকে নাকি আর চাইছেন না প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এ মিথ্যাচার শনিবার বেলা ১১টায় র্যাডিসন হোটেলে এজিএম শুরুর আগ পর্যন্ত চালু ছিল। এ সময় প্রচার করা হয়, জেলা ও বিভাগীয় ক্রীড়া সংগঠক পরিষদের সভাপতি, চট্টগ্রামের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন তার সমর্থন পরিবর্তন করেছেন। তিনি যোগ দিয়েছেন বাঁচাও ফুটবল পরিষদে। এখানে উল্লেখ্য, জেলা ও বিভাগীয় ক্রীড়া সংগঠক পরিষদে কোনও প্রতিনিধিত্ব ছিল না বাঁচাও ফুটবল পরিষদে। এ কারণেই আ জ ম নাছিরের অন্তর্ভুক্তিতে জেলা ও বিভাগীয় ক্রীড়া সংগঠক পরিষদের সমর্থন পাচ্ছে বাঁচাও ফুটবল পরিষদ, মূলত এটি প্রতিষ্ঠিত করাই ছিল বাঁচাও ফুটবলের মিথ্যা প্রচারণার মূল উদ্দেশ্য। নাছির পরে এ সংবাদকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও মিথ্যাচার বলে আখ্যায়িত করেন।
বাফুফের এ নির্বাচনে ‘মিডিয়া ক্যু’র ব্যাপক চেষ্টা চালানো হয়। আর এ কাজে সবচেয়ে এগিয়ে ছিল একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেল। পুরোপুরি মঞ্জুর কাদেরের নির্দেশনায় চলে চ্যানেলটির ক্রীড়া বিভাগের বিভিন্ন সংবাদ। নিয়মিত ভিত্তিহীন স্ক্রল দিয়ে চ্যানেলটি ক্রীড়াঙ্গনকে বিভ্রান্ত করে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশে বাফুফেতে আসছে সমঝোতার প্যানেল, বাঁচাও ফুটবলকে সরকারের আস্থাভাজন প্যানেল হিসেবে প্রমাণিত করার চেষ্টা, নির্বাচনের আগের রাতে পুরোপুরি সালাউদ্দিনের বিপক্ষে যায় এমন সংবাদ পরিবেশন করে একের পর এক বিতর্কের জন্ম দেয় চ্যানেলটি।
বাফুফের এবারের নির্বাচনে যেভাবে তৃতীয় পক্ষকে ব্যবহার করা হয়েছে, তা নজিরবিহীন ঘটনা। বাঁচাও ফুটবলের নেতারা প্রথমত দ্বারস্থ হন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি নাজমুল হাসান পাপনের। তাকে ক্রীড়াঙ্গনের অভিভাবক আখ্যা দেন তারা। বাফুফে থেকে সালাউদ্দিনকে সরিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নিতে আহ্বান জানান। পাপনের সংশ্লিষ্টতার কারণে বিসিবির অন্য পরিচালকরাও বাঁচাও ফুটবলের সঙ্গে যুক্ত হন।
নির্বাচনের দিন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত র্যাডিসনের লবিতে বাঁচাও ফুটবলের নেতাদের সঙ্গে অত্যন্ত কর্মব্যস্ত ছিলেন বিসিবি পরিচালক ঈসমাইল হায়দার মল্লিক। লোকমান ভূঁইয়া, মঞ্জুর কাদের বাফুফের ডেলিগেট ও ভোটার। আরেক পরিচলাক নজিব আহমেদ নির্বাচনে সহ-সভাপতি প্রার্থী। যদিও তিনি নির্বাচত হননি, তবে তাদের নির্বাচনি বিভিন্ন কাজ ছিল। কিন্তু ঈসমাইল হায়দার মল্লিকের কী কাজ ছিল, তা বোঝা যায়নি।
আরেক বিসিবি পরিচালক শেখ সোহেলও ছিলেন লবিতে। তবে তিনি খুব একটা সক্রিয় ছিলেন না। দুপুরের দিকে হোটেলে আসেন বিসিবির সিনিয়র সহ-সভাপতি মাহবুব আনাম। প্রচার মাধ্যম তার উপস্থিতির কারণ জানতে চাইলে তিনি বাঁচাও ফুটবল নেতাদের সঙ্গে বেশিক্ষণ থাকেননি। একটি টিভি চ্যানেল তার প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি প্রতিক্রিয়া জানাতে অস্বীকার করে বলেন, নির্বাচন শেষে বলব।
এছাড়া, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি ঈসমাইল হোসেন সম্রাটকেও নিজেদের কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করে বাঁচাও ফুটবলের নেতারা। ভোটের আগের দিন সন্ধ্যা থেকেই সম্রাট তার ১৫/২০ অনুসারী নিয়ে র্যাডিসন হোটেলে অবস্থান নেন। ডেলিগটদের ওপর প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করেন। নির্বাচনের সময় একাধিকবার বাঁচাও ফুটবলের নেতাদের সঙ্গে আলোচনায় লিপ্ত হন। পরাজয় ঘোষণা আসার পরপরই পোটন ও সম্রাট একসঙ্গে হোটেল ছেড়ে চলে যান।
মন্তব্য চালু নেই