বাদশা, যাদুকর এবং একটি ছেলের কাহিনী

হযরত সুহাইব রুমী ( রা) একটি ঘটনা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন। ঘটনাটি হচ্ছে : এক বাদশার কাছে একজন যাদুকর ছিল। বৃদ্ধ বয়সে সে বাদশাকে বললো , একটি ছেলেকে আমার কাছে নিযুক্ত করো, সে আমার কাছ থেকে এ যাদু শিখে নেবে। বাদশাহ যাদু শেখার জন্য যাদুকরের কাছে একটি ছেলেকে নিযুক্ত করলো। কিন্তু সেই ছেলেটি যাদুকরের কাছে আসা যাওয়ার পথে একজন রাহেবের (যিনি সম্ভবত হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের দীনের অনুসারী একজন সাধক ছিলেন ) সাক্ষাত করতে লাগলো । তাঁর কথায় প্রভাবিত হয়ে সে ঈমান আনলো । এমন কি তাঁর শিক্ষার গুণে সে অলৌকিক শক্তির অধিকারীও হয়ে গেলো। সে অন্ধদের দৃষ্টি শক্তি ফিরিয়ে দিতে এবং কুষ্ঠরোগ নিরাময় করতে লাগলো। ছেলেটি তাওহীদের প্রতি ঈমান এনেছে , একথা জানতে পেরে বাদশাহ প্রথমে রাহেবকে হত্যা করলো তারপর ছেলেটিকে হত্যা করতে চাইলো। কিন্তু কোন অস্ত্র দিয়েই এবং কোনভাবেই তাকে হত্যা করতে পারলো না ।

শেষে ছেলেটি বললো , যদি তুমি আমাকে হত্যা করতে চাও তাহলে প্রকাশ্য জনসমাবেশে ” বিসমি রব্বিল গুলাম ” ( অর্থাৎ এই ছেলেটির রবের নামে ) বাক্য উচ্চারণ করে আমাকে তীর মারো , তাতেই আমি মারা যাবো। বাদশাহ তাই করলো । ফলে ছেলেটি মারা গেলো । এ ঘটনা প্রত্যক্ষ করে লোকেরা চীৎকার করে উঠলো , আমরা এই ছেলেটির রবের প্রতি ঈমান আনলাম। বাদশাহর সভাসদরা তাকে বললো , এখন তো তাই হয়ে গেলো যা থেকে আপনি বাঁচতে চাচ্ছিলেন। লোকেরা আপনার ধর্ম ত্যাগ করে এ ছেলেটির ধর্মগ্রহণ করেছে। এ অবস্থা দেখে বাদশাহ অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হলো। সে রাস্তার পাশে গর্ত খনন করালো। তাতে আগুন জ্বালালো । যারা ঈমান ত্যাগ করতে রাজী হলো না তাদের সবাইকে তার মধ্যে নিক্ষেপ করলো । ( মুসনাদে আহমাদ , মুসলিম , নাসায়ী , তিরমিযী , ইবনে জারীর , আবদুস রাজ্জাক , ইবনে আবী শাইবা , তাবারানী , আবদ ইবনে হুমাইদ )

দ্বিতীয় ঘটনাটি বর্ণনা করেছেন হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু। তিনি বলেন , ইমানের এক বাদশাহ শরাব পান করে নিজের বোনের সাথে ব্যভিচার করে এবং উভয়ের মধ্যে অবৈধ সম্পর্ক স্থাপিত হয়ে যায়। কথাটি প্রকাশ হয়ে গেলে বাদশাহ জনসমক্ষে ঘোষণা করে দেয় যে , আল্লাহ বোনের সাথে বিয়ে হালাল করে দিয়েছেন। লোকেরা তার একথা মানতে প্রস্তুত হয় না। ফলে সে নানান ধরনের শাস্তি দিয়ে লোকদের একথা মানতে বাধ্য করতে থাকে। এমনকি সে অগ্নিকুণ্ড জ্বালিয়ে যে ব্যক্তি তার একথা মানতে প্রস্তুত হয়নি তাকে তার মধ্যে নিক্ষেপ করতে থাকে। হযরত আলী ( রা) বলেন , সে সময় থেকেই অগ্নি উপাসকদের মধ্যে রক্ত সম্পর্কের আত্মীয়কে বিয়ে করার পদ্ধতি প্রচলিত হয়। ( ইবনে জারীর)

তৃতীয় ঘটনাটি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস ( রা ) সম্ভবত ইসরাঈলী বর্ণনা থেকে উদ্ধৃত করেছেন। তিনি বলেন : বেবিলনের অধিবাসীরা বনী ইসরাঈলকে হযরত মূসা আলাইহিস সালামের দীন থেকে বিচ্যূত করতে বাধ্য করেছিল। এমন কি যারা তাদের কথা মানতে অস্বীকার করতো তাদেরকে জ্বলন্ত ভরা গর্তে নিক্ষেপ করতো। ( ইবনে জারীর , আবদ ইবনে হুমাইদ )

নাজরানের ঘটনাটিই সবচেয়ে বেশী প্রসিদ্ধ লাভ করেছে। ইবনে হিশাম , তাবারী , ইবনে খালদূন , মু’জামুল বুলদান গ্রন্থ প্রণেতা ইত্যাদি মুসলিম ঐতিহাসিকগণ এ ঘটনাটি বর্ণনা করেছেন। এর সংক্ষিপ্তসার হচেছ : হিময়ারের ( ইয়ামন ) বাদমাহ তুবান আসয়াদ আবু কারিবা একবার ইয়াসরিবে যায়। সেখানে ইহুদিদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ইহুদি ধর্ম গ্রহণ করে এবং বনি কুরাইযার দু’জন ইহুদি আলেমকে সংগে করে ইয়ামনে নিয়ে যায়। সেখানে সে ব্যাপকভাবে ইহুদি ধর্মের প্রচার চালায়। তারপর তার ছেলে যু – নুওয়াস তার উত্তরাধিকারী হয়। সে দক্ষিণ আরবে ইসায়ীদের কেন্দ্রস্থল নাজরান আক্রমণ করে। সেখানে থেকে ঈসায়ী ধর্মকে উৎখাত করা এবং সেখানকার অধিবাসীদেরকে জোরপূর্বক ইহুদি ধর্মে দীক্ষিত করাই ছিল তার লক্ষ। ( ইবনে হিশাম বলেন , নাজরানবাসীরা হযরত ঈসার আসল দীনের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল।) নাজরান পৌঁছে সে লোকদেরকে ইহুদি ধর্ম গ্রহণ করার আহবান জানায়। লোকেরা অস্বীকার করে। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে সে বিপুল সংখ্যক লোককে দাউ দাউ করে জ্বলা আগুনের কুয়ায় নিক্ষেপ করে জ্বালিয়ে দেয় এবং অনেককে হত্যা করে । এভাবে মোট বিশ হাজার লোক নিহত হয়। নাজরানবাসীদের মধ্য থেকে দাউস যু সা’লাবান নামক এক ব্যক্তি কোনক্রমে প্রাণরক্ষা করে পালিয়ে যায়। এক বর্ণনা মতে , সে রোমের কায়সারের দরবারে চলে যায় এবং অন্য একটি বর্ণনা মতে সে চলে যায় হাবশার ( ইথিওপিয়া ) বাদশাহ নাজ্জাসীর দরবারে। সেখানে সে এই জুলুমের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে। প্রথম বর্ণনা অনুযায়ী রোমের কায়সার হাবশার বাদশাকে লেখেন এবং দ্বিতীয় বর্ণনা অনুযায়ী নাজ্জাশী কায়সারে কাছে নৌবাহিনীর জাহাজ সরবরাহের আবেদন জানান। যাহোক সবশেষে হাবশার সত্তর হাজার সৈন্য আরইয়াত নামক একজন সেনাপতির পরিচালনাধীনে ইয়ামন আক্রমণ করে। যু নুওয়াস নিহত হয়। ইহুদি রাষ্ট্রের পতন ঘটে। ইয়ামন হাবশার ঈসায়ী রাষ্ট্রের অন্তরভুক্ত হয়।

অন্যান্য ঐতিহাসিক তথ্য প্রমাণাদি থেকে মুসলিম ঐতিহাসিকদের এ বর্ণনার কেবল সত্যতাই প্রমাণিত হয় না বরং এ সম্পর্কিত আরো বিস্তারিত তথ্যাদিও জানা যায়। সর্বপ্রথম ৩৪০ খৃষ্টাব্দে ইয়ামন হাবশার ঈসায়ীদের দখলে আসে। ৩৭৮ খৃঃ পর্যন্ত সেখানে তাদের রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত থাকে । এ সময় ঈসায়ী মিশনারীরা ইয়ামনে প্রবেশ করতে শুরু করে । এরি নিকটবর্তী সময়ে ফেমিউন( Faymiyun) নামক একজন সংসার ত্যাগী সাধক পুরুষ , কাশফ ও কারামতের অধিকারী ঈসায়ী পর্যটক নাজরানে আসেন । তিনি স্থানীয় লোকদেরকে মূর্তি পূজার গলদ বুঝাতে থাকেন। তার প্রচার গুণে নাজরানবাসীরা ঈসায়ী ধর্মের দীক্ষিত হয়। সে সময় তিনজন সরদার তাদের শাসন ব্যবস্থা পরিচালনা করতেন। তাদের একজনকে বলা হতো সাইয়েদ । তিনি উপজাতীয় সরদারদের মতো একজন বড় সরদার ছিলেন। বিদেশ সংক্রান্ত বিষয়াবলী , সন্ধি চুক্তি এবং সেনাবহিনী পরিচালনা তার দায়িত্বের অন্তরভুক্ত ছিল। দ্বিতীয় জনকে বলা হতো আকেব। তিনি আভ্যন্তরীণ বিষয়াবলী দেখাশুনা করতেন। তৃতীয় জনকে বলা হতো উসকুফ ( বিশপ ) । তিনি ছিলেন ধর্মীয় নেতা । দক্ষিণ আরবে নাজরান ছিল একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এলাকা । এটি ছিল একটি বৃহত্তম বানিজ্য ও শিল্প কেন্দ্র। এখানে তসর , চামড়া ও অস্ত্র নির্মাণ শিল্প উন্নতি লাভ করেছিল। প্রসিদ্ধ ইয়ামনী বর্মও এখানে নির্মিত হতো । এ কারণে নিছক ধর্মীয় কারণেই নয় বরং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণেও যু-নুওয়াস এ গুরুত্বপূর্ণ স্থানটি আক্রমণ করে। নাজরানের সাইয়েদ হারেশাকে , সুরিয়ানী ঐতিহাসিকগণ যাকে Arethas বলেছেন , হত্যা করে । তার স্ত্রী রুমার সামনে তার দুই কন্যাকে হত্যা করে এবং তাদের রক্ত পান করতে তাকে বাধ্য করে । তারপর তাকেও হত্যা করে । উসকুফ বিশপ পলের (Paul) শুকনো হাড় কবর থেকে বের করে এনে জ্বালিয়ে দেয়। আগুন ভরা গর্তসমূহে নারী, পুরুষ , শিশু, যুবা , বৃদ্ধ , পাদরী , রাহেব সবাইকে নিক্ষেপ করে । সামগ্রিকভাবে ত্রিশ থেকে চল্লিশ হাজার লোক নিহত হয়েছিল বলা হয়। ৫২৩ খৃষ্টাব্দে এ ঘটনা ঘটে। অবশেষে ৫২৫ খৃষ্টাব্দে হাবশীরা ইয়ামন আক্রমণ করে যু – নুওয়াস ও তার হিমইয়ারী রাজত্বের পতন ঘটায়। প্রত্নতাত্বিক গবেষকগণ ইয়ামন হিসনে গুরাবের যে শিলালিপি উদ্ধার করেছেন তা থেকেও এর সত্যতা প্রমাণিত হয়।

খৃষ্টীয় ষষ্ঠ শতকে ঈসায়ী লেখকদের বিভিন্ন লেখায় গর্তওয়ালাদের এই ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়। এর মধ্যে মূল ঘটনার সময় এবং এ ঘটনা যারা প্রত্যক্ষ করেছিল তাদের বিবরণ সহকারে লিখিত বেশ কিছু গ্রন্থ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে তিনটি গ্রন্থের রচয়িতারা এই ঘটনার সমসাময়িক । তাদের একজন হচ্ছেন : প্রকোপিউস দ্বিতীয় জন কসমস ইনডিকোপ্লিউসটিস ( cosmos Indicopleustis) তিনি নাজ্জাশী এলিস বুয়ানের( Elesboan) নির্দেশে সে সময় বাতলিমুসের গ্রীক ভাষায় লিখিত বইগুলোর অনুবাদ করছিলেন। এ সময় তিনি হাবশার সমুদ্রোপকূলবর্তী এডোলিশ ( Adolis) শহরে অবস্থান করছিলেন। তৃতীয়জন হচ্ছেন জোহান্নাস মালালা ( Johnnes Malala)। পরবর্তী বহু ঐতিহাসিক তাঁর রচনা থেকে ঘটনাটি উদ্ধৃতি করেছেন। এদের পর এফেসুসের জোহান্নাসের ( Johannes of Ephesus ) নাম করা যায়। তিনি ৫৮৫ খৃষ্টাব্দে মারা যান। তাঁর গীর্জার ইতিহাস গ্রন্থে নাজরানের ঈসায়ী সম্প্রদায়ের ওপর এই নিপীড়নের কাহিনী এ ঘটনার সমসাময়িক বর্ণনাকারী বিশপ শিমউনের (Simeon) একটি পত্র থেকে উদ্ধৃত করেছেন। এ পত্রটি লিখিত হয় জাবলা ধর্ম মন্দিরের প্রধানের( Abbot Von Gabula) নামে। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী বিভিন্ন ইয়ামনবাসীর বর্ণনার মাধ্যমে শিমউন তাঁর এই পত্রটি তৈরি করেন। এ পত্রটি ১৮৮১ খৃষ্টাব্দে রোম থেকে এবং ১৮৮০ খৃষ্টাব্দে ঈসায়ী শহীদানের অবস্থা বর্ণনা প্রসংগে প্রকাশিত হয়।

ইয়াকূবী পত্রিয়ার্ক ডিউনিসিউস ( Patriarch Dionysius ) ও জাকারিয়া সিদলিনি (Zacharia of Mitylene) তাদের সুরিয়ানী ইতিহাসেও এ ঘটনাটি উদ্ধৃত করেছেন। নাজরানের ঈসায়ী সমাজ সম্পর্কিত ইয়াকূব সুরুজীর গ্রন্থেও এর উল্লেখ রয়ে‌ছে। আর রাহা এর বিশপ পোলাস (PULUS) নাজরানের নিহতদের উদ্দেশ্যে শোকগীতি লিখেছেন ।এটি এখনো পাওয়া যায়। সুরিয়ানী ভাষার বই ” আল হিময়ারীন ” এর ইংরেজী অনুবাদ ( Book of the Himyarites ) ১৯২৪ সালে লণ্ডন থেকে প্রকাশিত হয়েছে। এ বইটি মুসলিম ঐতিহাসিকদের বর্ণনার সত্যতা প্রমাণ করে। বৃটিশ মিউজিয়ামে সেই আমলের এবং তার নিকটবর্তী আমলের কিছু ইথিয়োপীয় শিলালিপি সংরক্ষিত রয়েছে। এগুলো থেকেও এই ঘটনার সমর্থন পাওয়া যায়। কিলবি তাঁর Arabian Highlands নামক সফরনামায় লিখেছেন : গর্তওয়ালাদের ঘটনা যেখানে সংঘটিত হয়েছিল সে জায়গাটি আজো নাজরানবাসীদের কাছে সুস্পষ্ট। ‘উম্মু খারাক’ এর কাছে এক জায়গায় পাথরের গায়ে খোদিত কিছু চিত্রও পাওয়া যায়। আর নাজরানের কাবা যেখানে প্রতিষ্ঠিত ছিল বর্তমান নাজরানবাসীরা সে জায়গাটিও জানে।



মন্তব্য চালু নেই