বাঙালির স্বপ্নদ্রষ্টা `বঙ্গবন্ধু`

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান । তিনি বাংলার এক প্রান্ত থেকে অন্য আরেক প্রান্ত ছুটে বেড়িয়ে বাঙালির কাছে পৌঁছে দেন পরাধীনতার শিকল ভাঙার মন্ত্র। সে মন্ত্রে বলীয়ান হয়ে স্বাধীন দেশে পরিণত হওয়ার পাশাপাশি আজ বাংলাদেশ পরিণত হয়েছে অন্যতম সম্ভাবনাময় দেশে।

পাকিস্তানের সুদীর্ঘ তেইশ বছরের শাসনের নাগপাশ ছিন্ন করে আমাদের স্বাধীনতার যে মহান কবি ডাক দিয়েছিলেন, তিনি হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেই উত্তাল ডাকে আমাদের জাতির সমস্ত নাগশিশুরা উত্তাল হয়ে একাত্তরে একটা হিংস্র বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে বিজয়ের জয়মাল্য ছিনিয়ে এনেছিল, যা ছিল জগতের বুকে অভূতপূর্ব এক ঘটনা। স্বাধীনতার এই মহান নেতা শেখ মুজিবুর রহমান।

শেখ মুজিবুর রহমান জন্মগ্রহণ করেন তখনকার ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে ১৯২০ সালের ১৭ই মার্চ এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে। পিতা শেখ লুৎফর রহমান, মাতা মোসাম্মৎ সায়রা বেগম। ছেলে বেলায় মা-বাবা মুজিবুর রহমানকে খোকা বলেই ডাকতেন। খোকার শৈশব কাটে ছবির মতো সাজানো সুন্দর গ্রাম টুঙ্গিপাড়ায়। মধুমতি নদী এই গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে। নদীর দুপাশে তাল, তমাল, জারুল, হিজলের সবুজ সমারোহ।

ছেলেবেলায় আমাদের জাতির জনকের শরীর ছিল বেশ রোগা ছিপছিপে পাতলা। এর জন্য দাদীর আফসোসের অন্ত ছিল না। কিন্তু কে জানত যে এই রোগা ছিপছিপে ছেলেই হবে একদা জাতির কর্ণধার!

সাত বছর বয়সে গিমাডাঙ্গা টিঙ্গুপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করা হয় খোকাকে। এরপর নয় বছর বয়সে গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুলে তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হন। বারো বছর বয়সে ১৯৩৭ সাল থেকে ১৯৪১ সাল পর্যন্ত ৪ বছর তার শিক্ষা জীবনে সাময়িক বিরতি ঘটে চক্ষু রোগে আক্রান্ত হয়ে।

এ সময় অর্থাৎ ১৯৩৮ সালে শেখ মুজিবের অভিভাবকেরা তার বিয়ের উদ্যোগ নেন। শেখ মুজিবের জীবনে নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা হয়। সেই সময় শেখ মুজিবের বয়স ছিল ১১ বছর। সঙ্গিনী ফজিলাতুন্নেসার বয়স ছিল মাত্র ৩ বছর। পরে এই দম্পতিই আমাদের দেন ২ কন্যা – শেখ হাসিনা, শেখ রেহেনা ও ৩ পুত্র শেখ কামাল, শেখ জামাল ও সবার ছোট্ট শেখ রাসেল।

বিয়ের পর পুনরায় ১৯৪২ সালে তিনি আবার গোপালগঞ্জ মিশন হাই স্কুলে ভর্তি হন এবং প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাস হন। ১৯৪৭ সালে কলিকাতা ইসলামিয়া কলেজ থেকে বি,এ ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি আইন বিভাগে কিছুকাল অধ্যায়ন করেন।

ছাত্রজীবন থেকেই শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনীতির প্রতি অনুরক্ত ছিলেন। রাজনীতির ক্ষেত্রে তার প্রবেশ ঘটে সোহরাওয়ার্দীর ভাবশিষ্য হিসেবে। কলকাতা ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র থাকাকালীন সোহরাওয়ার্দীর সাহচার্যে পাকিস্তান আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন তিনি। কলকাতা বিহারের দাঙ্গায় বিপন্ন মুসলমানদের রক্ষাকাজে এবং ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের নির্বাচনে সোহরাওয়ার্দীর আত্ম নিবেদিত কর্মী হিসেবে শেখ মুজিব দেশ ও জাতির সেবা করেন।

১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে শেখ মুজিব কলিকাতা ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র পরিষদের সাধারণ সম্পাদক হন। ১৯৪৭ সালে গঠিত পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক লীগ এবং পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন শেখ মুজিব। তিনি বিভিন্ন সময়ে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করেন।

১৯৪৯ সালে শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামীলিগের যুগ্ন সম্পাদক, ১৯৫৩ সালে সাধারণ সম্পাদক এবং ১৯৬৬ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৫৩ সালে পূর্ব বাংলা সরকারের সমবায় ও কৃষি ঋণ বিষয়ক মন্ত্রী নিযুক্ত হন, ১৯৫৫ সালে পাকিস্তান গণ পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন এবং ১৯৫৬ সালে পূর্ব পাকিস্তানের বাণিজ্য-শ্রম, শিল্প ও দুর্নীতি দমন বিভাগে মন্ত্রী নিযুক্ত হন।

বঙ্গবন্ধু তার দল আওয়ামী লীগকে ১৯৭০ সালের জাতীয় ও প্রাদেশিক নির্বাচনে নিরস্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী করেন। তার এই অর্জন স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের অন্যতম প্রেক্ষাপট রচনা করে। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তিনি এক ঐতিহাসিক ভাষণে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়ে ঘোষণা করেন, “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।” ঐ সংগ্রামের জন্য তিনি জনগণকে “যা কিছু আছে তাই নিয়ে” প্রস্তুত থাকতে বলেন।

তিনি ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা দেন ও পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর হাতে গ্রেফতার হন। নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিরা ১০ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ গঠন করেন। ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জন হলে শেখ মুজিব পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ১০ জানুয়ারি বীরের দেশে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন।

১২ জানুয়ারী দেশে রাষ্ট্রপতি শাসনের পরিবর্তে সংসদীয় কাঠামো প্রবর্তন করে নতুন মন্ত্রী পরিষদ গঠন করে এবং জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। ১৯৭২ সালের ১২ মার্চ স্বাধীনতার মাত্র ৫০ দিনের মধ্যে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার শুরু হয়। ২৬ মার্চ শোষণহীন সমাজ গঠনের অঙ্গিকাকের মধ্য দিয়ে প্রথম স্বাধীনতা দিবস উদযাপিত হয়।

বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগে বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর ১৪২টি দেশের স্বীকৃতি আদায় করে। জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন, জাতিসংঘ, কমনওয়েলথ এবং ওআইসির সদস্য লাভ করে বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু প্রথম বাঙালি যিনি একটি দেশের সরকার প্রধান হিসেবে জাতিসংঘে বাংলা ভাষায় ভাষণ দেন।

সন্দেহাতীতভাবেই বঙ্গবন্ধুর উদ্দেশ্য ছিল দেশ ও দেশের মানুষের উন্নয়ন ঘটানো। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত শেখ মুজিব একটা ‘সোনার বাংলা’ গড়তে চেয়েছিলেন, যে ‘সোনার বাংলা’র উপমা তিনি পেয়েছিলেন কবি রবিন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছ থেকে। ভালবেসে মুজিব সেই ‘সোনার বাংলা’র সপ্নকে তার দেশের জাতীয় সংগীত নির্বাচন করেছিলেন।

বঙ্গবন্ধুর ব্যাক্তিত্ব ও চারিত্রিক মহিমা ছিল বিশাল হিমালয়ের মত। তার বজ্রকণ্ঠ ছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে চির আপোষহীন। তার জীবনগাঁথা আমাদের জাতির প্রজন্মের জানা সত্যিই অতিব জরুরী। বঙ্গবন্ধুর বিশাল ব্যাক্তিত্ব নিয়ে বাংলা সাহিত্যের অনেক কবি সুন্দর কবিতা লিখেছেন। জনসাধারণের কাছে তিনি “শেখ মুজিব” এবং “শেখ সাহেব” হিসেবে বেশি পরিচিত এবং তার উপাধি ‘বঙ্গবন্ধু’।



মন্তব্য চালু নেই