বাঘে ধরলেও ছাড়ে, কিন্তু শেখ হাসিনা ধরলে ছাড়েন না
‘বাঘে ধরলেও ছাড়ে, কিন্তু শেখ হাসিনা ধরলে ছাড়েন না’ আমার যতদূর মনে পড়ে এই প্রবাদটি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে তোষামোদ করতে সর্বপ্রথম ব্যবহার করেছিলেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। সম্ভবত সেদিন ছিল ২০১১ সালের ৩ নভেম্বর। বিকেলে জেলহত্য দিবস উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আওয়ামী লীগের আলোচনা সভা। সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর সভাপতিত্বে আলোচনা সভার প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
ওই সভায় সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত সভানেত্রী শেখ হাসিনার সামনেই প্রবাদটি উচ্চারণ করেন। সুরঞ্জিতের এই কথা শুনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হাসছিলেন। মঞ্চে বসে থাকা দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং সংসদ উপনেতা সাজেদা চৌধুরীও হাসিনার সাথে একচোট হেসে নিলেন উপস্থিত হাজারো নেতাকর্মী ও সাংবাদিকদের সামনে।
আমার যদি স্মৃতিভ্রম না হয়ে থাকি তবে সুরঞ্জিত এই প্রবাদটি উচ্চারণের উদ্দেশ্য যতটা না ছিল খালেদা জিয়াকে হুশিয়ার করতে তার চেয়েও বেশি শেখ হাসিনাকে খুশি করার জন্য।সেটা অবশ্য কাজেও লেগেছিল। এর মাত্র ২৬দিনের ব্যবধানেই সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত রেলমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিতে সক্ষম হয়েছিলেন।পরে অবশ্য রেলওয়েতে নিয়োগ কেলেঙ্কারীর ঘটনায় ‘কালো বিড়াল’ খেতাব নিয়ে স্বল্প সময়ের ব্যবধানেই তাকে বিদায় নিতে হয়েছিল।
এরপর এই প্রবাদটি উচ্চারণ করে একুশে পদক লাভ করেন প্রবীণ অভিনেতা এবং বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোটের নেতা এটিএম শামসুজ্জামান। যদিও তার বিরুদ্ধে রাজাকারের খাতায় নাম থাকার অভিযোগ উঠেছিল।এছাড়াও আরো অনেকে এই প্রবাদটি উচ্চারণ করে বেশ লাভবান হয়েছেন।
সেদিন সুরেনজিত সেন গুপ্ত যে উদ্দেশ্যেই প্রবাদটি নেত্রীর সামনে বলুক না কেন, সেটা যে হাসিনার ক্ষেত্রে কতটা বাস্তব ও সত্য তা অবশ্য ড. মোহাম্মদ ইউনুসসহ আরো অনেকেই হাড়েহাড়ে টের পাচ্ছেন। এক্ষেত্রে আজ বাদ যাননি নিজ দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফও।
অনেকেই হয়তো মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই সীমাহীন একক ক্ষমতার সমালোচনা করছেন, অনেকে হয়তো ইহাকে একনায়কতন্ত্র কিংবা স্বৈরতন্ত্রের সাথে তুলনা করেছেন। আবার অনেকে তাকেঁ হিটলার মুসোলিনীর সঙ্গেও তুলনা করে আত্মতৃপ্তি লাভ করার চেষ্টা করছেন। এখানে আমার কথা হলো- শেখ হাসিনাকে যে যেভাবেই সমালোচনা করুন না কেন, আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তাবিদ ম্যাকিয়াভেলির থিওরিতে তিনি যে একজন সফল রাষ্ট্রনায়ক এতে অন্তত কারো আপত্তি থাকার কথা নয়।
জীবনের এই পড়ন্ত বেলা বেলায় বঙ্গবন্ধুর জেষ্ঠ্য কন্যা রাজনীতিতে এতোটা প্রাজ্ঞ ও বিচক্ষণ হয়ে শক্তহাতে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে পারবেন তা তিনি নিজে তো নয়ই, দলের নেতাকর্মিরাও কী কখনো এমনটি ভেবেছিলো! এরপরও আজ বাস্তবেই তা করছেন আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তিন তিনবার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন, শান্তি, গণতন্ত্র ও মানবতার জন্য কাজ করায় দেশ-বিদেশ থেকে অসংখ্য পুরষ্কারে ভুষিত হয়েছেন। বাবার মৃত্যুর পর ভঙ্গুর দলকেও পরিণত করেছেন দেশের সর্ববৃহৎ শক্তিশালী দলে। দেশকে গড়েছেন নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে। নিজেও হয়েছেন বিশ্বের শক্তিশালী রাষ্ট্রনায়কদের একজন। নিজেকে গঠন করেছেন এক প্রাজ্ঞ রাজনৈতিক হিসেবে। সুনাম-সুখ্যাতি ছড়িয়েছে দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও । এই কৃতীত্বকে অনেকে ‘গণতন্ত্রের মানসকণ্যা’ আবার অনকে বাঙালী জাতির ‘শান্তির প্রতীক’ বলেও তাঁকে উপাধিতে ভুষিত করেছেন। আবার অনেকে বলছেন, অমর কীর্তিতে বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পেয়েছেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালীর উপাধি, এবার তারই কণ্যা শেখ হাসিনা হতে যাচ্ছেন হাজার বছরের ‘শ্রেষ্ঠ বাঙালী নারী’।
‘৭৫ এর মহাসুনামির তরঙ্গমালা থেকে বেঁচে থেকে জিয়া, এরশাদ, খালেদা, হান্নান, উদ্দিন সরকার, বিডিআর বিদ্রোহ, হেফাজত, ৫ জানুয়ারিসহ বিংশ ও একাবিংশ শতাব্দির আরও অনেক ঝড়-ঝাপটা ও ঢেউ পেরিয়ে প্রশান্ত প্রশস্ত নদীর মাঝ দিয়ে স্রোতের প্রতিকূলে পড়ন্ত বিকালে বয়ে চলা একটি পালতোলা নৌকার মতো বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য, রাজনীতি, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার আজ কেন্দ্রবিন্দুর সৌন্দর্য্য হয়ে দাঁড়িয়েছেন শেখ হাসিনা। যার আত্মমর্যাদা, স্বপ্ন, বিশ্বাস, সাহস আর প্রত্যয় হিমালয়সম উঁচু। উন্নয়নের এই ধারায় ২০২১ সালে উচ্চমধ্যম আয়ের এবং ২০৪১ সালে উন্নত বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখছেন।
সবমিলেই শেখ হাসিনার পরম সুদিন। এই সুদিনে তাঁর বন্ধু-বান্ধব, শুভাকাঙ্খী ও গুণকীর্তনকারী লোকের অভাব নেই। তাই তোষামোদকারীরা বেশ সক্রিয়।
আমার কেন জানি মনে হয়, রাষ্ট্র-প্রশাসন কিংবা সমাজপ্রতিরা প্রায় সবাই কমবেশী তোষামোদকে পছন্দ করেন। এক্ষেত্রে আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে তোষামোদের প্রতি একটু বেশী দুর্বল বলেই মনে হচ্ছে। অন্যথা এই একবিংশ শতাব্দীর এই যুগে বঙ্গবন্ধুর কণ্যার মতো প্রভাবশালী রাষ্ট্রনায়কের মন্ত্রীসভায় মোফাজ্জল হোসেন মায়া ও অ্যাড. কামরুল ইসলামের মতো অসৎ, দুর্নীতিবাজ ও মহসীন আলীর মতো কাণ্ডজ্ঞানহীন ব্যক্তিরা কি জায়গা করে নিতে পারেন!থাক এসব কথা।
অনেক ব্যর্থতা সমালোচনা থাকা সত্ত্বেও শেখ হাসিনা যে একজন প্রাজ্ঞ ও বিচক্ষণ রাজনীতিবিদ তা আবারো প্রমাণ করলেন। কোনো ধরনের জুটঝামেলা ছাড়াই বৃহস্পতিবার নিজের মন্ত্রীসভার সবচেয়ে প্রভাবশালী মন্ত্রী ও দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রনালয় থেকে সরিয়ে দপ্তরবিহীন মন্ত্রী করে দিলেন। এ নিয়ে দলের ভেতরে–বাহিরে নেই কোনো প্রতিক্রিয়া। এমন কি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিও প্রকাশ্যে কিংবা গোপনে প্রক্রিয়া দেখাতে সাহস করেননি। বরং সৈয়দ আশরাফুল দপ্তরবিহীন মন্ত্রী করার কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে নিজেকে দলের নেতাকর্মীদের মাঝে সক্রিয় নেতা হিসেবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছেন।ফলে এ থেকেই সহজেই অনুমেয় বর্তমানে বাংলাদেশের রাজনীতি ও সরকার ব্যবস্থায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কতটা একক ক্ষমতাধর ব্যক্তি।
এবার সরকারের মন্ত্রীসভায় রদবদলের চিন্তাভাবনা চলছে । দীর্ঘদিন থেকেই মন্ত্রীসভায় রদবদল ও নতুন কিছু মুখ যুক্ত হবার গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিল। কিন্তু এতদিন দেশের রাজনীতিতে অস্থিতিশীলতা থাকায় সেটা করা সম্ভব হয়নি বলেই মনে করা হয়। বর্তমানে সবক্ষেত্রে একটা স্থিতিশীল অবস্থা ফিরে আসায় ফের সচিবালয় ও দলীয় কার্যালয়সহ বিভিন্ন স্থানে এ নিয়ে নতুন করে গুঞ্জন শুরু হয়েছে। বিশেষ করে বৃহস্পতিবার সৈয়দ আশরাফকে দপ্তরবিহীন মন্ত্রী করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ প্রজ্ঞাপন জারির পর থেকে মন্ত্রীসভায় রদবদলের বিষয়টি নিয়ে গুঞ্জন আরো জোরালো হয়ে উঠেছে। দলের একাধিক সিনিয়র নেতার সাথে কথা বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর দাবি ঈদের পরপরই মন্ত্রসীভায় রদবদল ও কিছু নতুন মুখ যুক্ত হবার ঘটনাটি ঘটতে যাচ্ছে।
জানা যায়, ওয়ান ইলেভেন-পরবর্তী সময়ে গঠিত মন্ত্রিসভায় ত্যাগী নেতাদের সম্মানিত করেছিলেন আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সুসময়ে হাইব্রিড নেতাদের উত্থানেও টলেননি তিনি। বর্তমান সরকার গঠনকালে আলোচিত-সমালোচিত অনেক নেতাকে মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দিয়ে গঠন করেন নতুন কেবিনেট। তখন থেকেই ছিটকে পড়া নেতাদের কম পরীক্ষা নেননি প্রধানমন্ত্রী। সর্বশেষ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের মন্ত্রিসভায় নেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী, এমন কথা জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের কয়েকজন নেতা।অন্যদিকে বেশ কয়েকজন মন্ত্রীসভা থেকে বাদ পড়তে পারেন বলে জানা গেছে।
তবে এক্ষেত্রে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের অগ্রগতি ও উন্নতির ক্ষেত্রে সবচেয়ে সমস্যা হচ্ছে দুর্নীতি। এক্ষেত্রে শেখ হাসিনা সরকারের মন্ত্রী-এমপি ও নেতানেত্রীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। বলা যায়- এটা ক্রমেই বিস্তৃত হচ্ছে। সরকার সংশ্লিষ্টরাও বলছেন, দুর্নীতি রোধ ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা সরকারের সামনে অন্যতম চ্যালেঞ্জ। এইতো বৃহস্পতির অর্থমন্ত্রী আবুল মাল মহিত বললেন, দুর্ণীতি কারণে আশানুরূপ উন্নয়ন হচ্ছে না।
সরকারের বিগত পাঁচ বছরে দুর্নীতির অভিযোগ ছিল বিভিন্ন মন্ত্রী ও এমপিদের বিরুদ্ধে। হয়ে যাওয়া নির্বাচনে জমা দেয়া হলফনামায় দেয়া তাদের সম্পদ বিবরণী থেকে অস্বাভাবিক সম্পদ অর্জনের বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে। এ নিয়ে সরকারি দলের নীতিনির্ধারকদের অস্বস্তিতে পড়তে হয়েছে। সমালোচনা হয়েছে বাইরেও। পাঁচ বছরে বহু গুণ সম্পদের মালিক হওয়া মন্ত্রী-এমপিদের কেউ কেউ নয়া মন্ত্রিসভায় স্থান পাননি।
সামনে দুর্নীতি রোধ ও সরকারের মন্ত্রী-এমপিদের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। ফলে আগামী দিনে দেশকে উন্নয়নে পথে এগিয়ে নিতে হলে শেখ হাসিনাকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণার কোনো বিকল্প নেই। ফলে এক্ষেত্রে তিনি কতটা সাহসী ভুমিকা নিতে পারেন সেটাই এখন দেখার বিষয়। এক্ষেত্রে জনগণের প্রত্যাশা নতুনভাবে মন্ত্রীসভার রদবদলে তিনি দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্তদের অন্তত: মন্ত্রীসভা থেকে বাদ দিয়ে এবং সৎ ত্যাগী ও দেশপ্রেমিক নেতাদের মন্ত্রীসভায় জায়গা দিয়ে আরেকবার সাহসিকতার পরিচয় দিবেন।
ফলে দল নয়, রাষ্ট্রীয় পদে থেকে দেশের বৃহত্তর স্বার্থেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে এখন বুদ্ধিদীপ্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে এগুতে হবে। সব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে আগামী দিনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোন পথে হাটেঁন সেটাই এখন দেখার বিষয়। তবে প্রচলিত রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সামনের পথ যে একেবারেই মসৃণ হবে সেটা বলার উপায় নেই।
ড. সরদার আনিছুর রহমান
কলামলেখক ও গবেষক,
ই-মেইল: [email protected]
মন্তব্য চালু নেই