বাঁশের লাঠি, টিনের বাঁশি এবং মন্ত্রীর হাসি

বাঙালির সর্বনাশা প্রেমপিরিতি এবং রঙ্গরসের আদি কাহিনি বলে শেষ করা যাবে না। মানুষের সর্বনাশ নিয়ে ক্রীড়াকৌতুক করা কিংবা একজনের মৃতদেহের ওপর দাঁড়িয়ে স্বপ্ন বাসর রচনা করার হাজারো উদাহরণ খোঁজার জন্য খুব বেশি অতীতে যাওয়ার দরকার নেই। মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের রাজদরবারের কৌতুকাভিনেতা গোপাল ভাঁড়ের নানাকাহিনি আজও বাংলার লাখো কোটি মানুষকে সমানতালে বিনোদন দিয়ে যাচ্ছে। একজনের আলুর গুদাম পুড়ে গেল তাতে মালিকের যতই ক্ষতি হোক না কেন গোপাল ভাঁড়ের কী আসে যায়! তিনি যে বিনামূল্যে সেই পোড়া আলুর ২-৪টি লবণ মাখিয়ে খেতে পারবেন তাতেই বেজায় খুশি। শত শত বছর ধরে বাঙালি গোপাল ভাঁড়ের আলু পোড়ার গল্প পড়ে আসছে এবং সমান তালে আনন্দ লাভ করছে।

আজ অনেক দিন পর গোপাল ভাঁড়ের কথা মনে পড়ে গেল সাম্প্রতিককালে ডিজিটাল সরকারের কয়েক মন্ত্রীর লাঠি-বাঁশির মহড়ার হাস্যোজ্জ্বল ছবি দেখার পর। আমার আরও মনে পড়ল কুখ্যাত রোমান সন্ত্রাসী নিরোর কথা। ৬৪ খ্রিস্টাব্দের ১৮ থেকে ১৯ জুলাই পর্যন্ত পুরো রোম নগরী যখন জ্বলে-পুড়ে ছারখার হচ্ছিল তখন সম্রাট নাকি বাঁশি বাজাচ্ছিলেন। নিরো মারা গিয়েছেন প্রায় দুই হাজার বছর আগে। কিন্তু আজ অবধি ইতিহাস তাকে ক্ষমা করেনি। আধুনিক রোম নগরী বিনির্মাণ তার অসামান্য অবদান। তাবৎ দুনিয়ার স্থাপত্য ও শিল্পকলার একজন শ্রেষ্ঠ প্রবর্তক হওয়া সত্ত্বেও পৃথিবীবাসী তার বাঁশি বাজানোর ঘটনাকে কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি।

সাম্প্রতিককালের আগুন এবং মন্ত্রীদের বংশীবাদন আগামীর ইতিহাস কীভাবে মূল্যায়ন করে তা হয়তো সময়ই বলে দেবে। কিন্তু বর্তমান ঘটনার প্রেক্ষাপটে বাঁশিতে ফুঁ দিয়ে লোক জড়ো করা এবং লাঠিসোঁটা নিয়ে প্রতিপক্ষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া যে একটি হাস্যকর ব্যাপার তা বোঝার জন্য খুব বেশি জ্ঞানগরিমার দরকার নেই। এই ঘটনার মাধ্যমে দেশের বিরাজমান হিংসাত্মক ঘটনা, হরতাল, অবরোধ এবং রাজনৈতিক সহিংসতাকে যে নেহাত চুরি-ডাকাতির সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে তাও প্রতিভাত হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে বাঁশি বাজিয়ে যদি সাধারণ জনগণকে ডাকতে হয় এবং লাঠিসোঁটা নিয়ে যদি সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে আমজনতাকে লড়তে হয় তাহলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী করছেটা কী এবং করবেই বা কী?

সন্ত্রাসী কর্মকা- যে বা যারাই করুক না কেনÑ অপরাধীদের শনাক্ত করে বিচারের আওতায় আনাই রাষ্ট্রের কাজ। রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যদি সেটা না করতে পারে তবে কিছুতেই তারা দায় এড়াতে পারবে না। আমাদের বিশাল জনগোষ্ঠীর এই হতদরিদ্র দেশে এমনিতেই জনসংখ্যার অনুপাতে সবকিছু অপ্রতুল। তার ওপর আবার অভাব রয়েছে আধুনিক প্রযুক্তি, অস্ত্র-বল এবং প্রশিক্ষণের। এ অবস্থায় সমাজে যদি বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় তাহলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী স্বাভাবিকভাবেই ব্যর্থ হয়ে পড়বে। সেই ব্যর্থতার দায় নিতে হবে আমাদের সবারÑ বিশেষ করে রাজনৈতিক নেতৃত্বের।

বিএনপি তথা ২০ দলীয় জোটের ডাকা হরতাল-অবরোধকে কেন্দ্র করে সারা বাংলার আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়েছে সন্ত্রাস, গুম, হত্যা, আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণ। দেশীয় রাজনৈতিক ঐতিহ্য অনুযায়ী সরকারবিরোধী বিরাট এক জনগোষ্ঠী এসব কিছু পছন্দ না করলেও সরব হয়ে সরকারের পক্ষে দাঁড়াচ্ছে না। উল্টো প্রচ- নীরবতা নিয়ে সন্ত্রাসীকর্মে মৌন সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে এবং অপ্রিয় হলেও সত্যি যে, ওইসব সন্ত্রাসী নিরাপদে আমাদের জনারণ্যে মিশে যাচ্ছে। গত এক মাসে দেশের অর্থনীতি, শিক্ষাব্যবস্থা, সামাজিক স্থিতি এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যতটা বিনষ্ট হয়েছে তা স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে আর কোনোদিন হয়নি।

দেশে এখন তিন ধরনের চিত্র দেখা যাচ্ছে। ঢাকা শহরের ২-৩টি ব্যস্ত সড়কের দিনের বেলার চিত্র এবং রাতের চিত্র। বিভাগীয় ও জেলা শহরগুলোর দিনের বেলার চিত্র এবং রাত্রিকালীন অবস্থা। অন্যদিকে উপজেলা ও গ্রাম্য হাটবাজারের দিনরাতের চিত্র। কেউ যদি অনুসন্ধানী মন এবং চোখ নিয়ে এসব দেখেন তবে সর্বত্রই দেখতে পাবেনÑ কোনো কিছুই স্বাভাবিকভাবে চলছে না। যেসব এলাকায় সরকারদলীয় লোকদের প্রভাব রয়েছে সেখানে এক ধরনের অবস্থা। অন্যদিকে বিএনপি-জামায়াত প্রভাবিত অঞ্চলের চিত্র সম্পূর্ণ বিপরীত। তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত সব দলের সব স্তরের রাজনৈতিক নেতারা সীমাহীন নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। কেউই একাকী নির্ভয়ে রাতবিরাতে চলতে পারছেন না।

২-৩ দিন আগে আমার সঙ্গে সিলেট অঞ্চলের বয়োজ্যেষ্ঠ এবং সিনিয়র একজন আওয়ামী লীগ নেতার কথা হলো। তিনি আমাকে অবাক করে দিয়ে একটি তথ্য জানালেন। দলীয় সভানেত্রীর হুকুমে পাড়া-মহল্লায়, গ্রামগঞ্জে সন্ত্রাসবিরোধী কমিটি করার জন্য পরিচিত ছাত্রলীগ-যুবলীগসহ অন্যান্য অঙ্গসংগঠনের তৃণমূল পর্যায়ের অনেক নেতাকর্মীকে ফোন দিলেন। সবাই জানালÑ তারা এখন এলাকায় যেতে পারছেন না বিএনপি-জামায়াত-শিবিরের লোকদের ভয়ে। তিনি পাল্টা প্রশ্ন করলেনÑ তাহলে ওরা কোথায়? নেতাকর্মীরা জানালÑ ওরাও পলাতক। পুলিশের ভয়ে তারা সারাদিন গা ঢাকা দিয়ে থাকে, রাত হলে বের হয় এবং খুঁজে খুঁজে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের প্রতি আক্রমণ চালায়।

এ তো গেল গ্রামের কথা। খোদ সিলেট মহানগরীর অবস্থাও ভালো নয়। দিনের বেলায় সরকারদলীয় লোকজন বড় বড় রাস্তায় চলাফেরা করলেও একাকী কোনো গলির মধ্যে ঢোকে না। আর রাত হলে তো কথাই নেইÑ ধপাস করে কপাট বন্ধ করে আবেগ ও উৎকণ্ঠা নিয়ে সকালের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। দেশের যেসব স্থানে বিএনপি-জামায়াতের প্রভাব তুলনামূলক বেশি সেসব স্থানের সরকারদলীয় লোক যে কীরূপ দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন তা যদি মন্ত্রীরা একটু অন্তর দিয়ে অনুধাবন করতে পারতেন তবে আখেরে তাদেরই লাভ হতো।

ঐতিহাসিকভাবে ঢাকা মহানগরীতে বিএনপি-জামায়াতের ভোট বেশি। কেবল প্রশাসনিক ক্ষমতা এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শক্তিমত্তাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে রাজধানীর সরকারদলীয় লোকরা তুলনামূলকভাবে সুবিধাজনক অবস্থানে আছেন। কিন্তু আশঙ্কার কথা হলোÑ রাজনৈতিক পরিস্থিতি যদি তাদের প্রতিকূলে চলে যায় তবে ঢাকার আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থায় মানবিক বিপর্যয় দেখা দেবে। এই বাস্তব এবং রূঢ় সত্যটি মাথায় রেখে ক্ষমতাসীনরা যদি সতর্ক অবস্থানে থেকে উ™ূ¢ত সমস্যা সমাধানে উদ্যোগী হতেন তবে বাঁশের লাঠি কিংবা টিনের বাঁশির কথা তাদের মাথায় আসত না।

টেলিভিশনে দেখলাম মন্ত্রীরা বাঁশিতে ফুঁ দেওয়ার আগে মুখে বাঁশি ঢুকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছেন। সম্ভবত তারা অনেকের তরে নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত হয়ে শৈশবে ফিরে গিয়েছিলেন। মেলায় গিয়ে ঝুনঝুনি কিনে আর টিনের বাঁশি কিনে বাড়ি ফেরার পথে সেগুলো বাজায়নি এমন বালক-বালিকা এই বাংলায় ষাট বা সত্তরের দশকে একজনও ছিল না। অন্যদিকে লাঠি-বাঁশির সংস্কৃতিও রয়েছে আমাদের গ্রামবাংলার অপরাধপ্রবণ এলাকাগুলোয়। যেসব এলাকা থানা পুলিশ থেকে বহু দূরে অবস্থিত সেসব এলাকার গ্রামবাসীরা সন্ত্রাসী এবং ডাকাতদের বিরুদ্ধে লাঠি-বাঁশি থেরাপি প্রয়োগ করে বেশ সুফল পেয়ে থাকে। কিন্তু চলমান হরতাল-অবরোধের ডিজিটাল সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সনাতন পদ্ধতির এনালগ লাঠি-বাঁশি থেরাপিÑ শুধু অকার্যকরই নয়, হাস্যকরও বটে। আর সেই কারণেই হয়তো মন্ত্রীরা হাসি চেপে রাখতে পারেননি। সরকারি দলের কোনো নেতা হয়তো আগপাছ চিন্তা না করেই লাঠি-বাঁশির কথা বলে ফেলেছেন আর তা বাস্তবায়নে রাস্তায় নেমে মন্ত্রীরা না পেরেছেন ফিরতে কিংবা না পেরেছেন কোনো কিছু করতে। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছেÑ লাঠি-বাঁশি প্রজেক্ট ব্যর্থ। আমরা আজ অবধি একটি ঘটনাও দেখিনি যেখানে কোনো মন্ত্রীকে পেট্রলবোমা কিংবা ককটেল মারতে দেখে কেউ ফড়–ৎ ফুড়–ৎ শব্দে বাঁশিতে সুর তুলতে পেরেছে আর আবেগী জনতা হালুম-হুলুম বলে বাঁশির লাঠি উঁচিয়ে সন্ত্রাসীদের পাকড়াও করতে পেরেছে!

বাস্তব অবস্থা হলো পুরো দেশ এখন সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। আগে সন্ত্রাসীরা থানা পুলিশকে ভয় পেত। এখন উল্টো থানা পুলিশ সন্ত্রাসীদের ভয়ে তটস্থ থাকে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে আমাদের গত ৪৩ বছরের অর্জন মাটি হতে ৪৩ দিনের বেশি সময় লাগে না। কারণ মন্দ কাজের বিস্তার হয় জ্যামিতিক হারে। দেশের লাখ লাখ আলেম-ওলামা দিনরাত ওয়াজ-নসিহত-তাবলিগ করে মানুষকে মসজিদমুখী করতে পারে না। অথচ কোনো প্রচার ছাড়াই দেশে ইয়াবা ও ফেনসিডিলসেবীর সংখ্যা কয়েক কোটি। সন্ত্রাস হলো পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মরণ নেশা। এই নেশায় কোনো ব্যক্তি, সমাজ বা রাষ্ট্র একবার আক্রান্ত হলে আর রক্ষা নেইÑ ধ্বংস বা মৃত্যুই হলো সন্ত্রাসের অবধারিত পরিণতি।

সন্ত্রাসের সঙ্গে সম্পর্ক থাকে লুটের বা তথাকথিত গণিমতের মালের। ইসলামের ধর্মযুদ্ধের যুদ্ধলব্ধ সম্পদকে সন্ত্রাসীরা তাদের নিজেদের স্বার্থে জায়েজ করার জন্য যুগে যুগে গণিমত শব্দটি বিকৃত আকারে ব্যবহার করে আসছে। সন্ত্রাসের মাধ্যমে সৃষ্টি হয় ধর্ষণের ক্ষেত্র। অন্যের উপার্জিত সম্পদ, স্ত্রী, কন্যা, ভগ্নি যখন সন্ত্রাসীরা অনায়াসে ভোগ করার সুযোগ পায় তখন দুনিয়া বা আখিরাতের কোনো শাস্তির ভয়ই তাদের রুখতে পারে না। তারা অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে যায়। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক লক্ষণগুলো দেখে মনে হচ্ছে, সন্ত্রাসীরা ধীরে ধীরে নিজেদের জায়গা পাকাপোক্ত করে নিচ্ছে। সাধারণ মানুষ সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে রুখে না দাঁড়িয়ে তাদের তোয়াজ করে চলছে। সরকারদলীয় লোকজনই বলছে, এতকিছু করার পরও যদি বেগম জিয়াকে কেন্দ্র করে রাজনীতি, অর্থনীতি, কূটনীতি, আলোচনা-সমালোচনা এবং সন্ত্রাসী কর্মকা- আবর্তিত হয় তাহলে প্রশ্নÑ ক্ষমতা কোথায়? সচিবালয় নাকি গুলশানের বিএনপি কার্যালয়ে।

ক্ষমতাসীনরা বুঝে কিংবা না বুঝে অথবা গায়ের জোরে পরিস্থিতি এড়িয়ে যেতে চাইছে। তারা বর্তমানের গোলযোগকে নেহাত বিচ্ছিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকা- আখ্যা দিতে চাচ্ছে। আবার অবচেতন মনে সবকিছুর জন্য জামায়াত-বিএনপিকে দায়ী করছে। যখনই বর্তমান ঘটনার সঙ্গে কোনো সুপ্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলের ইন্ধন বলে প্রচার করা হয় তখন এটি যে রাজনৈতিক সন্ত্রাস এবং সহিংসতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়ে যায় এ কথা সাধারণ মোটা মাথার রাজনীতিবিদরাও ভালো করে জানেন। কাজেই বিচ্ছিন্ন সন্ত্রাসীরা যদি সারা দেশের অব্যাহত পেট্রলবোমা, খুন, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ইত্যাদির সঙ্গে যুক্ত হয় তবে রাষ্ট্রশক্তির মেশিনারি দিয়ে তা নির্মূল করা সম্ভব। কিন্তু সন্ত্রাসের সঙ্গে যদি প্রতিষ্ঠিত এবং জনপ্রিয় রাজনৈতিক দলের ইন্ধন কিংবা সমর্থন থাকে তবে কোনো রাষ্ট্রশক্তিই তা নির্মূল করতে পারবে না। বিষয়টি রাজনৈতিকভাবেই নিষ্পত্তি করতে হবে।

লেখক : সাংবাদিক, কলামনিস্ট



মন্তব্য চালু নেই