বলিউড ছেড়ে এখন ইসলাম প্রচার করছেন ভারতের এই ‘মহীয়সী’ নারী

মেয়েটি চেয়েছিল বলিউডের নায়িকা হতে। ছোটবেলা থেকে স্বপ্ন দেখত সিনেমায় অভিনয় করার। মুরসিলিন পীরজাদা নামের এই মেয়েটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষে এসে অনেক পরিচালকের কাছ থেকে সিনেমায় অভিনয় করার প্রস্তাব পায়। কিন্তু তার কাশ্মীরি মুসলিম পরিবার জানায়, যশ রাজ ফিল্মের পরিচালিত সিনেমা ব্যতীত অন্য কোনও সিনেমায় অভিনয় করা যাবে না।

দুই বছর পর, সেই ২৩ বছরের মেয়েটি এখন আর বলিউড অভিনেত্রী হতে চান না। তিনি এখন চান একজন ধর্মপ্রচারক হতে। ইয়াসমিন মুজাহিদ নামের এক মিসরীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন ধর্মপ্রচারক, যিনি ইসলাম নিয়ে লিখেন ও বক্তৃতা দেন তার মতো হতে।

পীরজাদার জীবনে এমন আরও অনেক পরিবর্তন এসেছে। তিনি তার পশ্চিমা জৌলুসপূর্ণ জীবনযাপন পরিত্যাগ করেছে। একসময় যিনি দামী পোশাক ও জিনস খুব আগ্রহের সাথে পরতেন, এখন একখানা কালো বোরখা পরিধান করেন।

সামাজিক গণমাধ্যমে তার প্রোফাইল পিকচারে এখন তাকে একখানা বোরখা দ্বারা আবৃত অবস্থায় দেখা যায়। ভারতের মুম্বাইতে তিনি জনসাধারণের উদ্দেশে ইসলাম সম্বন্ধে বক্তৃতা দিয়ে থাকেন। তার শেষ বক্তৃতা শ্রীনগরে একটি মহিলা কনফারেন্সে ছিল।

কিন্তু কি এমন ঘটল যে পীরজাদার জীবনযাপনে এমন পরিবর্তন? এর উত্তরে পীরজাদা বলল, ‘এই পরিবর্তনটা শুরু হয়েছিল বলিউডের মাধ্যমে। আমার বাবা ফিরোজ পীরজাদা ধনাঢ্য ব্যবসায়ী যিনি যশ চোপড়াকে বিগত তিন দশক ধরে চিনেন। ২০১২ সালে বাবা আমাকে যশ চোপড়ার সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। যশ চোপড়া আমাকে তার সিনেমায় সহকারী পরিচালক পদে কাজ করার প্রস্তাব দেন।

পীরজাদার ভাষায় ঐটাই তার অভিনেত্রী হওয়ার পথে প্রথম পদক্ষেপ ছিল। সে বরাবরই অভিনয়ের প্রতি দুর্বল ছিল। তারপর তিনি যশ রাজ চলচ্চিত্রের অন্য একটি সিনেমার কস্টিউম সহকারী পরিচালক পদে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলেন। যেহেতু তারা নতুন মুখদের সিনেমায় নিতে আগ্রহী সেহেতু পীরজাদাকে স্ক্রিন টেস্ট দিতে বলে।

পীরজাদা বলল, আমি সালোয়ার কামিজ পরে ক্যামেরার সামনে দাঁড়ালাম। হঠাৎ আমি কেমন যেন শারীরিক ও মানসিকভাবে অরক্ষিত বোধ করলাম। সাথে সাথে তিনি বলেন যে এসব তাকে দিয়ে সম্ভব না।

কিছুদিন চিন্তা করার পর তিনি ভাবলেন, অভিনয়শিল্পীরা সবসময় খুবই খোলামেলা পোশাক পরে। তারপর তিনি যশ চোপড়ার ছেলে আদিত্য চোপড়াকে টেক্সট করে জানিয়ে দিল যে, তিনি আর অভিনয় করবেন না এবং সহকারী পরিচালক পদেও কাজ করবেন না। এটা খুবই কঠিন কাজ তার জন্য।

তারপর পীরজাদা এক কস্টিউম ডিজাইনার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবার সিদ্ধান্ত নিলেন এবং মানিশ মালহোত্রা’র সাথে কাজ করা শুরু করলে। অক্টোবর ২০১২ এর দিকে যশ চোপড়া মারা যান।

পীরজাদা বলেন, আমার নিকট তিনি একজন শিক্ষকের মতো ছিলেন। তার মৃত্যুতে আমি যেন একটি বিরাট অবলম্বন হারিয়ে ফেললাম। মৃত্যুর চিন্তায় আমি যেন কেমন কেঁপে উঠলাম। নাচ, গান, বিনোদনের ঊর্ধ্বে জীবনে আসলে কি আছে এই সম্পর্কে আমি ভাবতে থাকলাম।

পীরজাদা মালহোত্রার সাথে কাজ করা বন্ধ করে দিল। তিন চার মাস ধরে শুধু বাসায়ই ছিল। ঐ সময় তিনি খুবই বিষাদগ্রস্ত ছিল। তার সব বন্ধু ঐ সময়ে সিনেমা জগতে পাড়ি জমাচ্ছিল। আর সেখানে তিনি সকল প্রকার সুযোগ ছেড়ে দিলেন।

এরপর পীরজাদা অনলাইনে ইসলাম নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করেন এবং নুমান আলি খান ও ইয়াসমিন মুজাহিদের ইউটিউব ভিডিওগুলো দেখেন। তিনি এসব দেখে খুবই আলোকিত বোধ করেন এবং তাদের মতো হওয়ার ইচ্ছে পোষণ করেন। তিনি সে সময়ে ইসলাম সম্পর্কে জানার তাগিদ অনুভব করেন।

বিগত আগস্ট মাসের ১০ তারিখে পীরজাদা তার বাবার সাহায্যে শ্রীনগরে একটি ইসলামিক পিস কনফারেন্স আয়োজন করেন। তার জীবনের এই আমূল পরিবর্তনের পিছনে তার বাবার অনুপ্রেরণা ও সহায়তা রয়েছে বলে তিনি জানান।

পীরজাদার টুইটার একাউন্টের টুইটগুলো মূলত বিভিন্ন ইসলামিক স্কলারদের উক্তি। এর মধ্যে বেশিরভাগই আধ্যাত্মিক; মানুষকে আল্লাহর দিকে ফিরে আসার মাধ্যমে জীবনের সকল সমস্যা সমাধানের আহবান জানানো হয়। পীরজাদা ধর্মের ব্যাপারে খুবই উদার দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেন। তার ভাষায় রাগান্বিত বক্তব্য যুব সমাজকে কখনোই ইসলামের প্রতি আকর্ষণ করবে না। সুন্দর ও প্রজ্ঞা পূর্ণ বক্তব্যই যুব সমাজকে ইসলামের দিকে আকর্ষণ করতে পারে।

তিনি আরও বলেন, মিডিয়া নেতিবাচক ভাবে ইসলামকে পৃথিবীর সামনে উপস্থাপন করে এবং আমাদের মতো তরুণরাই পারে ইসলামের বার্তাকে যুব সমাজের নিকট সুন্দরভাবে উপস্থাপন করতে।

পীরজাদার বক্তৃতাগুলো ইন্সটাগ্রামে পাওয়া যায়, তার একাউন্টে ১৯০০০ ফলোয়ার রয়েছে। তিনি কথার এক পর্যায়ে বলেন, আমার উপর কেউ জোরজবরদস্তি করেনি, আমি নিজের ইচ্ছেতেই হিজাব পরিধান করেছি। হিজাব পরিধানের পর আমি আমার জীবনে এক অন্যরকম স্বাধীনতা অনুভব করেছি যা এর আগে আমি কখনই করিনি।

তিনি আরও বলেন, আমি মানুষকে কুকর্মে প্ররোচিত করতে চাই না। যার কারণে আমি সিনেমা জগত ছেড়ে চলে এসেছি এবং এটি আমি একটি ভালো সিদ্ধান্ত নিয়েছি বলে মনে করি। পীরজাদা তার একটি ভিডিওতে মানুষকে ধর্মনিষ্ঠ সাহচর্য গ্রহণের আহ্বান জানান যাতে মানুষ ভালো পথে চলতে পারে। তিনি এখন আর পার্টি ও নাইটক্লাবে যান না।

বর্তমানে তিনি কাতার ভিত্তিক ইসলামিক অনলাইন ইউনিভার্সিটিতে ইসলামিক স্টাডিজে মাস্টার্স করছে। তিনি মনে করেন মুসলিম যুব সমাজ পশ্চিমা সংস্কৃতির দ্বারা ভীষণভাবে প্রভাবিত। তার ভাষায় যেসব গান যুব সমাজ শুনে থাকে তার অর্ধেকই উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাত্রার সমর্থন করে থাকে। উদাহরণস্বরূপ তিনি ওয়েস্টের গানকে তুলে ধরল যেখানে এমন কথাও থাকে– আমি হলাম প্রভু। তিনি যুব সমাজের আরেকটি সমস্যার কথা বললেন আর তা হল আরবি ভাষা না জানার কারণে কুরআনুল কারিমের অর্থ না বুঝা।

সর্বশেষ, এখানে তার ইন্সটাগ্রাম একাউন্টের একটি পোস্ট তুলে ধরা হল- গতকাল কাশ্মীরে একটি মিউজিক্যাল কনসার্ট ছিল যেখানে বলিউড তারকা সুনীল শেঠী ও সোহেল খান উপস্থিত ছিল। সেখান থেকে প্রায় ১৫ মিনিট পথের দূরত্বে একটি স্থানে আমাদের কনফারেন্স হচ্ছিল। কাশ্মীরে এটি খুব দুর্লভ বিষয় ছিল।

আমাদেরকে বলা হয়েছিল যে আমরা যেন আমাদের কনফারেন্সটা ঐ স্থান থেকে আরেকটু দূরে করি। কিন্তু আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এর কি পরিকল্পনা দেখ, আমরা কনফারেন্সে ৪ হাজার লোকের জমায়েত করতে পেরেছিলাম যেখানে কনসার্টে মাত্র ২০০ লোকের জমায়েত হয়েছিল।-নয়াদিগন্ত



মন্তব্য চালু নেই