বন্যায় ভাসছে রাজশাহীর চরাঞ্চল, ১১ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ

সরকার দুলাল মাহবুব, রাজশাহী থেকে : রাজশাহীতে পদ্মায় বিপদসীমা ১৮ দশমিক ৫০ মিটার। রোববার সকাল থেকে ১৮ দশমিক ৪৬ মিটার লেবেলে রাজশাহীতে পদ্মার পানি প্রবাহিত হচ্ছে। বিপদসীমার মাত্র ৪ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে। পানি বাড়লেও এবং বাড়ি-ঘর ক্ষেত খামার তলিয়ে গেলেও পবার হরিপুরে বন্যা দুর্গতদের দেয়া হয়নি ত্রাণ সামগ্রী।

এদিকে, রাজশাহীর বেশ কয়েকটি উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়েছে। বাঘা উপজেলায় ক্রমাগত পানি বৃদ্ধির ফলে ডুবে গেছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং জমির ফসলসহ প্রায় দেড় হাজার ঘরবাড়ি। অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে ১১টি বিদ্যালয়ের তিন হাজার শিক্ষার্থীর পড়া-লেখা। আবার অনেকের রাতের ঘুম হারাম হচ্ছে সাপের ভয়ে। বিশুদ্ধ পানি ও খাবার অভাবে অনেকেই অনাহারে-অধ্যহারে দিন কাটাচ্ছেন।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের ওয়েবসাইট ফ্লাড ফোরকাস্টিং অ্যান্ড ওয়ারনিং সেন্টার বন্যা পূর্বাভাসে বলছে, সোমবার বিপদসীমা ছাড়িয়ে পদ্মায় পানি প্রবাহিত হতে পারে। ওই দিন পদ্মা প্রবাহিত হবে ১৮ দশমিক ৫৪ মিটারের কাছাকাছি।

তবে রাজশাহী পানি উন্নয়ন বোর্ডের গেজ পাঠক শহিদুল ইসলাম জানান, পদ্মায় পানি আগে দ্রুত বাড়লেও এখন বাড়ছে ধীরে। শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে শনিবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ২৪ ঘন্টায় মাত্র ৯ সেন্টিমিটার পানি বেড়েছে। শনিবার সন্ধ্যা ৬টায় পদ্মায় প্রবাহ রেকর্ড করা হয়েছে ১৮ দশমিক ৪০ মিটার। রোববার সকালে পদ্মার পানি প্রবাহিত হচ্ছে ১৮ দশমিক ৪৬ মিটার লেভেলে।

রাজশাহী পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, উজানে ফারাক্কার গেট খুলে দেয়ায় কয়েকদিন ধরে রাজশাহীতে পদ্মায় তরতরিয়ে পানি বাড়ছে। বিপজ্জনকভাবে পানি বাড়ায় রাজশাহী শহর রক্ষা বাঁধের কয়েকটি পয়েন্টে দেখা দিয়েছে ঝুঁকি। এর মধ্যে পুলিশ লাইন পয়েন্ট সবচেয়ে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।

নির্বাহী প্রকৌশলী মোখলেসুর রহমান জানিয়েছেন, তারা এনিয়ে সতর্ক দৃষ্টি রাখছেন।

এদিকে, এরই মধ্যে পানিতে তলিয়ে গেছে রাজশাহী শহরের পদ্মা সংলগ্ন নিঁচু এলাকাগুলো। বন্যা দেখা দিয়েছে জেলার পবা, চারঘাট, বাঘা ও গোদাগাড়ীর বিস্তৃীর্ণ চরাঞ্চলে। প্রায় প্রতি দিনই নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। ঘরবাড়ি হারিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ছুটছে মানুষ।

নগরীর কোলে পবার হরিপুর ইউনিয়নের নবগঙ্গা, বশরি, সোনাইকান্দি, গোহমাবোনার পদ্মার তীরবর্তী এলাকার বাড়ি-ঘর, ক্ষেত খামার তলিয়ে গেছে। বিশেষ করে বশরিতে একবাড়ি থেকে অন্যবাড়িতে পৌছাতে একমাত্র বাহন কলাগাছের ভেলা। বিকেলে সরজমিনে ওই এলাকার সোহাগী বেগম ভেলায় চড়ে বাড়ি থেকে ডাঙ্গায় আসতে দেখা যায়।

হরিপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বজলে রেজবি আল হাসান মুঞ্জিল বলেন, বন্যা দূর্গতদের জন্য ত্রাণ সামগ্রী হিসেবে ১৬ টন চাল পেয়েছি। ওই এলাকার ৬০২টি পরিবার খুবই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের কোন কর্মকর্তায় দেখভালের জন্য আসছেন না।

জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ত্রাণ সহায়তা থাকলেও তা রয়েছে প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই অল্প। পরিস্থিতি মোকাবেলায় বিত্তবানদের এগিয়ে আসার আহবান জানিয়েছে জেলা প্রশাসন।

রাজশাজীর বাঘায় গত দুই সপ্তাহের ব্যবধানে বন্যা পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়েছে। ক্রমাগত পানি বৃদ্ধির ফলে ডুবে গেছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং জমির ফসলসহ প্রায় দেড় হাজার ঘরবাড়ি। অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে ১১টি বিদ্যালয়ের তিন হাজার শিক্ষার্থীর পড়া-লেখা। আবার অনেকের রাতের ঘুম হারাম হচ্ছে সাপের ভয়ে। বিশুদ্ধ পানি ও খাবার অভাবে অনেকেই অনাহারে-অধ্যহারে দিন কাটাচ্ছেন। শনিবার সকালে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সাথে ত্রাণ বিতরণ করতে গিয়ে ভুক্তভুগীদের মুখ থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

সরেজমিন পদ্মার চরাঞ্চলে গিয়ে দেখা গেছে, এই মুহুর্তে যাতাযাতের জন্য তাদের একমাত্র বাহন টিনের তৈরী ডুংগা। নদীতে পানি বাড়ার পর থেকে চরাঞ্চলের চকরাজাপুর, চৌমাদিয়া, আতারপাড়া, দিয়ার কাদিরপুর, লক্ষ্মীনগর, মানিকের চর এবং টিকটিকি পাড়াসহ ১৫টি গ্রামের প্রায় ১০ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। তারা বাড়ি থেকে ঠিকমত বের হতে পারছে না। এসব কারণে বন্ধ হয়ে গেছে ওই অঞ্চলের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। আবার অনেকের হালের বলদ দাঁড়িয়ে আছে খড়ের উপরে।

ক্রমাগত পানি বাড়ার ফলে সেখানে অসংখ জমির আখ, পাট ও চলতি আমন ধান পানিতে তলিয়ে গেছে। একই সাথে পদ্মার স্রোতে ব¬কসহ বাঁধ ভেঙ্গে যাওয়ার উপক্রম হতে যাচ্ছে। আবার কোন কোন স্থানে বিশাল ফাটলের সৃষ্টি হয়েছে। প্রতিদিন বাঁধ ভাঙ্গার ফলে এলাকায় এক প্রকার আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। এমনিতেই ফসল পানিতে তলিয়ে যাওয়ার ফলে লোকজন দিশেহারা অন্যদিকে বাঁধের ভাঙ্গনের কারণে তারা নিজেদের বাড়ি-ঘর রক্ষা করতে পারবে কিনা এ নিয়েও দুঃশ্চিন্তায় রাত কাটাচ্ছেন।

চরাঞ্চলের বাসিন্দা আলিম মোল্লা জানান, পদ্মার পানি বাড়ার সাথে সাথে তলিয়ে গেছে তার নয় বিঘা জমির ফসল। এ ছাড়াও ক্রমাগত স্রোতে ভেঙ্গে পড়েছে ১০টি আমগাছ। অপর একজন আব্দুর রহমান জানান, নদীতে পানি বাড়ার পর তারা গত প্রায় ৮-১০ দিন ধরে পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। ফলে তাদের গরু-ছাগলসহ অন্যান্য জিনিষপত্র ঘরে রাখা দায় হয়ে পড়েছে। অনেকের ঘরে খাবার নেই।

উপজেলার চকরাজাপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আজিযুল আযম জানান, নদীতে পানি বাড়ার পর ফসল তলিয়ে যাওয়াতে লোকজনের যে ক্ষতি হয়েছে তা অপূরনীয়। কিন্তু যাদের বাড়ি ভেঙ্গে অন্যত্র সরাতে হচ্ছে তারা অর্থিক ভাবে চরম সংকটে রয়েছে।

বাঘা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হামিদুল ইসলাম জানান, বাঘার পদ্মার চরাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি আগের চেয়ে ভয়াবহ। তিনি গত দু’সপ্তাহে স্থানীয় এমপি বর্তমান সরকারের মাননীয় পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মহদয় সহ উপজেলা প্রশাসন এবং গুঠি কয়েক এনজিও কর্মীদের সহায়তায় সর্বশেষ শনিবার পর্যন্ত নগদ ৯০ হাজার টাকাসহ চারবার ত্রান বিতরণ করেছেন। তিনি ওই অঞ্চলের মানুষের দু:খ-দুরদশার কথা স্থানীয় জেলা প্রশাসক মহদয়কেও অবহিত করেছেন বলে জানান।



মন্তব্য চালু নেই