বন্ধকী জমি গোপনে বিক্রি করে দিল অগ্রণী ব্যাংক!
আদালতে মামলার সুরাহা হওয়ার আগেই বন্ধকী জমি অন্যের কাছে বিক্রি করে দেয়ার অভিযোগ উঠেছে রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংক কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। খেলাপি ঋণের টাকা পরিশোধে গ্রাহক বার বার আগ্রহ দেখালেও তা আমলে নিচ্ছে না ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। জালিয়াতি করে প্রায় ২০০ কোটি টাকার সম্পত্তি মাত্র ১৭ কোটি টাকায় প্রভাবশালী ব্যক্তির কাছে বিক্রি করে দেয়া হয়েছে বলেও অভিযোগ করেছেন জমির মালিকরা।
রাজধানীর গুলশানের ১ বিঘা ২ ছটাক জমি বন্ধক রেখে অগ্রণী ব্যাংকের নারায়ণগঞ্জের কোর্ট রোড শাখা থেকে ১৯৯০ সালের ১ আগস্ট ঋণ নেয় এআরএ জুট ট্রেডিং করপোরেশন লিমিটেড। অর্থ ফেরত না দেয়ায় ১৯৯৭ সালে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ক্যাশ ক্রেডিট (সিসি) ঋণ হিসেবে খেলাপি ঘোষণা করে।
ঋণগ্রহিতা এআরএ জুট ট্রেডিং করপোরেশন লিমিটেডের কাছে সুদে-আসলে মিলে ব্যাংকের পাওনা ১৭ কোটি ৬১ লাখ ৫৩ হাজার টাকা। তবে ওই প্রতিষ্ঠান বলছে, দাবি অনুয়ায়ী টাকা ফেরৎ দিতে চেয়ে অগ্রণী ব্যাংক বরাবর দফায় দফায় চিঠিও দেয়া হয়েছে।
গ্রহিতার আবেদনের পর ব্যাংকের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের পর্যবেক্ষণসহ আলোচিত ঋণের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে তা ব্যাংকের বোর্ড সভায় তোলা হয়। পর্যবেক্ষণে বলা বলা হয়, ঋণগ্রহিতা মৃত, বর্তমানে ঋণগ্রহিতার ব্যবসা বন্ধ, ঋণ হিসাবটি দীর্ঘদিন ধরে শ্রেণিকৃত, মামলাকৃত ও অবলোপনকৃত, বন্ধকী সম্পত্তি বিক্রির জন্য নিলাম ডাকা হলেও কোন বিডার পাওয়া যায়নি এবং আদালতের মাধ্যমে ঋণ আদায় সময় সাপেক্ষ।
এসব পর্যবেক্ষণের ওপর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, এ অবস্থায় পরিচালনা পর্ষদ এনপিএল কমিটির মতামত/সুপারিশের প্রেক্ষিতে খেলাপী ঋণগ্রহিতা প্রতিষ্ঠান এআরএ জুট ট্রেডিং করপোরেশন লিমিটেডের ঋণ আদায়ে কস্ট অব ফান্ডের আওতায় মওকুফ অবশিষ্ট ১৭ কোটি ৬১ লাখ ৫৩ হাজার টাকা ২০১৫ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে পরিশোধের বিষয়টি অনুমোদন করা হলো। অর্থাৎ খেলাপি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকেই ঋণের টাকা নেয়া হবে।
প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মারা যাওয়ার পর তার ছেলে শামসুল আরেফিন খান উত্তরসূরী হিসেবে ঋণের টাকা পরিশোধও করতে চান। তিনি বলেন, ‘অগ্রণী ব্যাংকের বোর্ড সভায় খেলাপি ঋণের টাকা পরিশোধে ৯০ দিনের সময় দেয়া হলেও ব্যাংকের কাছ থেকে কোনো চিঠি বা নোটিশ ঋণগ্রহিতা প্রতিষ্ঠানকে দেয়া হয়নি। ব্যাংকের বোর্ডের এ সিদ্ধান্তটি গোপন রাখা হয়েছে।’
আরেফিন বলেন, ‘নিজে থেকে বারবার যোগাযোগ করা হলেও ব্যাংক কর্তৃপক্ষ কোনো বিষয় আমাকে জানায়নি। যে কারণে আমি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে টাকা জমা দিতে পারিনি। তবে জানতে পেরেছি কোনো একটি পক্ষ জালিয়াতির মাধ্যমে আমাদের সম্পত্তি হাতিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে।’
তিনি বলেন, ‘ঋণের টাকা পরিশোধ করে জমিটি অবমুক্ত করতে চাইলেও ব্যাংক টাকা নিচ্ছে না। শুনেছি জমিটি আবার এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যনের কাছে বিক্রি করা হয়েছে। আমরা যতবার তাদের কাছে ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলছি ততবারই তারা দেখছি, হচ্ছে, হবে এভাবেই সময় পার করে দিচ্ছে।’
শামসুল আরেফিন খানের অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায় অগ্রণী ব্যাংকের ৪৫২তম বোর্ড সভার সিদ্ধান্তের নথিপত্রে। এতে বলা হয়েছে, ‘সম্পত্তির বন্ধকীদাতাগণ যেহেতু ব্যাংকের অগোচরে রাগীব আলীর নিকট বিক্রি করেছেন, সেহেতু এ সম্পত্তির ওপর তার উত্তরাধীকারীগণের কোনো অধিকার থাকে না। তাই এক আইনজীবীর পরামর্শে সিদ্ধান্ত দেয়া হয়, নজরুল ইসলাম মজুমদারের কাছ থেকে টাকা গ্রহণ করায় তাকে জমিটি রেজিস্ট্রি করে দেয়ার।’
জানা যায়, ইতিমধ্যে নজরুল ইসলাম মজুমদার খেলাপি ঋণের পুরো টাকাটাই এক্সিম ব্যাংকের একটি পে-অর্ডারের মাধ্যমে অগ্রণীকে পরিশোধ করেছেন।
ব্যাংকের দাবি ছিল, এআরএ জুট ট্রেডিংয়ের মালিক রাগীব আলী নামক এক ব্যক্তির কাছে জমিটি ২০০৪ সালের ৭ জুলাই বিক্রি করে দেয়। পরে আবার রাগীব আলী সেই সম্পত্তি ২০১২ সালের মে মাসে বিক্রি করেন এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদারের কাছে।
তবে ব্যাংকের এ দাবি সত্য নয় বলে জানিয়েছেন ঋণগ্রহিতা প্রতিষ্ঠানের বর্তমান চেয়ারম্যান শামসুল আরেফিন খান। তিনি বলেছেন, ‘কথিত ক্রেতা রাগীব আলীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। জমি কেনা-বেচায় রাগীব আলী নামের এক ব্যক্তিকে দেখানো হলেও সেটা সাজানো গল্প এবং দলিলাপত্র ছিল ভুয়া। জজকোর্ট, হাইকোর্ট ও সর্বশেষ ২০১৩ সালের জানুয়ারি মাসে সুপ্রিমকোর্টেও রাগীব আলীর সম্পত্তি কেনার দলিলটি ভুয়া প্রমাণিত হয়।’
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে লিখিত অভিযোগ করেন ঋণগ্রহিতা শামসুল আরেফিন। বাংলাদেশ ব্যাংক এটি আমলে নিয়ে অগ্রণী ব্যাংকের কাছে ব্যাখ্যা তলব করে। অভিযোগপত্রের উল্লেখিত বিষয়ে তাদের বক্তব্য ০৫/০৪/২০১৬ তারিখের মধ্যে ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি অ্যান্ড কাস্টমার সার্ভিসেস ডিপার্টমেন্টে প্রদান করতে বলা হয় অন্য একটি চিঠিতে। যার জবাব দেন অগ্রণীর সার্কেল সচিবালয়ের উপ-মহাব্যবস্থাপক মো. সিরাজুল ইসলাম। তবে ওই ব্যাখ্যায় অসন্তোষ প্রকাশ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আবারও অগ্রণী ব্যাংকের এমডিকে চিঠি দিয়ে জানতে চাওয়া হয় এ বিষয়ে।
তাছাড়া প্রধান কার্যালয়ের পরিবর্তে সার্কেল সচিবালয় থেকে পাঠানো চিঠি গ্রহণও করেনি কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পুনরায় এর জবাব দিতে বলা হয়েছে। এ বিষয়ে অগ্রণী ব্যাংকের এমডি সৈয়দ আবদুল হামিদের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি অনেক বড় ও জটিল হয়ে গেছে। আমি এটি নিয়ে কথা বলতে চাই না।’
অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান জায়েদ বখত বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানটির মালিক যেহেতু অন্য একজনের কাছে জমিটি বিক্রি করেছেন তার ওপর আর ওই মালিকের কোনো অধিকার থাকতে পারে না। আমরা ঋণ সমন্বয় করার জন্যই নজরুল ইসলাম মজুমদারের কাছ থেকে টাকা নিয়েছি এবং বোর্ডে সিদ্ধান্ত হয়েছে তাকেই জমিটি রেজিস্ট্রেশন করে দেয়া হবে। আমাদের আইনজীবীও একই পরামর্শ দিয়েছেন।’
ঋণগ্রহিতা এআরএ জুট ট্রেডিংয়ের স্বত্বাধিকারী কথিত রাগীব আলীর কাছে জমিটি বিক্রির যে কথা অগ্রণী ব্যাংক বলছে তা সত্য নয় বলে আদালত রায় দিয়েছেন। তারপরও কেন কর্তৃপক্ষ সম্পত্তি বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা জানতে চাওয়া হলে চেয়ারম্যান বিষয়টি এড়িয়ে যান। বলেন, ‘আমাদের ঋণের সমন্বয় করাটাই আসল কাজ।’
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কয়েকজন কর্মকর্তার কাছে জানতে চাইলে তারাও এ বিষয়ে কথা বলতে অপারগতা জানান।
উল্লেখ্য, ঋণে অনিয়মের কারণে অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ আবদুল হামিদকে কেন অপসারণ করা হবে না, তা জানতে চেয়ে গত ১৭ ফেব্রুয়ারি নোটিশ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। তাকে ৩ মার্চের মধ্যে জবাব দিতে বলা হয়েছিল। অপসারণের আগে ব্যাংক কোম্পানি আইনের ৪৬ ধারা অনুযায়ী কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়ার নিয়ম রয়েছে। চিঠি পেয়ে হামিদ জবাব দিতে এক মাসের সময় চেয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে আবেদন করেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাকে ১৩ দিন সময় বাড়িয়ে ১৬ মার্চের মধ্যে জবাব দেয়ার নির্দেশনা দেয়। সময় পার হয়ে যাওয়ার পর তিনি চিঠির জবাব দেন।
অপসারণের নোটিশের জবাব দেয়ার প্রায় দেড়/দুই মাস পার হয়ে গেলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। মূলত সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান তাকে অপসারণের যে প্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন তা নতুন গভর্নর ফজলে কবির আসার পর স্থবির হয়ে গেছে। বাংলামেইল
মন্তব্য চালু নেই