বন্দী যখন কারাগারের সম্পদ
কারাগার মানেই অপরাধ আর অপরাধীদের সংশোধন কেন্দ্র। যদিও দার্শনিক জ্যা পল সার্ত্রে কারাগারকে অপরাধের সূতিকাগার বলে চিহ্নিত করেছিলেন অনেক আগেই। এমনও দেখা গেছে যে, ডিম চুরি করে গুরুতর শাস্তি পাওয়া অপরাধী কারাগার থেকে বের হওয়ার পর মানুষ হত্যার মতো ঘটনা ঘটাচ্ছে। কিন্তু ভারতের গুরগাঁওয়ের ভূন্দসী কারাগারের বন্দী অমিত মিশ্রের ঘটনাটি কারাগারের অন্য সব ঘটনা থেকে ভিন্ন। তাই পাঠকদের জন্য ভিন্নতাটুকু তুলে ধরা হলো।
২০১৩ সালে অমিতকে যখন এই কারাগারে প্রেরণ করা হয় তখন তিনি আর দশজন স্বাভাবিক কয়েদিদের মতোই একজন। গরাদের ভেতর থাকা সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার অমিত ক্রমশ বিলীন হতে থাকে অন্যান্য কয়েদিদের সঙ্গে। কিন্তু মাত্র দুবছরের ব্যবধানে গোটা হরিয়ানা রাজ্যে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাক্তি হয়ে গেছেন বন্দী অমিত মিশ্র।
অমিতের বাড়ি মূলত উত্তরপ্রদেশের গোর্খাপুরে। যদিও তিনি ভূন্দসীতে থাকতেন। কারাগারে থাকতে থাকতেই তিনি কারাগারের জন্য একটি সফটওয়্যার তৈরি করেন। ফনিক্স নামের এই সফটওয়্যার দিয়ে কারাগারের বন্দীদের মনিটর করা, এবং বিভিন্ন কাজের সময় নির্ধারণ করতে এর জুরি নেই। বর্তমানে সফটওয়্যারটি শুধুমাত্র কারাগারের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। হরিয়ানা রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে।
যৌতুকের কারণে স্ত্রীকে হত্যার দায়ে অমিতকে কারাদণ্ড দেয়া হয়েছিল ২০১৩ সালের এপ্রিল মাসে। সেসময় তিনি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে সফটওয়্যার প্রকৌশলী হিসেবে কাজ করতেন। কারাগারের দিনগুলো নিয়ে অমিত জানান, ‘প্রথম তিনমাস আমি খুব হতাশ ছিলাম। তখন কারা কর্তৃপক্ষের প্রধান হরিন্দর সিং আমার অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে কিছু ভালো করার জন্য বলেন। এই কথা ধরেই মূলত আমার যাত্রা শুরু হয়। প্রাথমিক কাজ হিসেবে সকল বন্দীর আঙ্গুলের ছাপ নেয়া হয়। এরফলে কর্তৃপক্ষের জন্য খুব সহজ হয় বন্দীদের যাবতীয় তথ্য সংরক্ষন করা এবং অর্থিক লেনদেনেও সুবিধা হয়। এতে করে প্রত্যেক বন্দীর যাবতীয় তথ্য বিস্তারিত থাকে।’
সবচেয়ে মজার বিষয় হলো এই গোটা কাজটি করতে কেন্দ্রিয় সরকার কোনো সাহায্য করেনি। মোট চার-পাঁচ লাখ টাকার যে যন্ত্রাংশ কিনতে হয়েছিল তা সম্ভব হয়েছিল ক্যান্টিনের আয় থেকে। কয়েদিদের যে খাবার সরবরাহ করা হয় কারা কর্তৃপক্ষ থেকে, সেই খাবারের থেকেই টাকা বাঁচিয়ে এই প্রযুক্তি স্থাপন করা হয় কারাগারে। বর্তমানে এই প্রযুক্তির পেছনে আরও দশজন সাবেক বন্দী কাজ করছেন। তারা এই সফটওয়্যারটির খুটিনাটি পরিবর্তন এবং বাস্তবের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বিভিন্ন অনুষঙ্গ হালনাগাদ করার কাজ করেন। শুধু তাই নয়, পেছনের তাবৎ তথ্যাদি রেকর্ডের জন্য ৩৫০জন কয়েদিতে তথ্য সংরক্ষণের উপর দেয়া হয়েছে বিশেষ প্রশিক্ষন।
মানবসভ্যতার সবচেয়ে সেকেলে এবং অকার্যকর বন্দোবস্ত হলো বর্তমান কারাগার ব্যবস্থা। একটি রাষ্ট্রে কারাগার থাকা মানে সেই রাষ্ট্রে অপরাধ এবং অপরাধীকে স্বীকার করে নেয়া। এবং এই বন্দোবস্ত এটাও স্বীকার করে যে রাষ্ট্রে অপরাধ সংঘটনের মতো যথেষ্ট কার্যকারণ মজুদ আছে। সরকারগুলো সেই কারণ চিহ্নিত করে সংশোধনের পরিবর্তে নতুন নতুন কারাগার বানাতে উদ্যোগি হয়। মানুষ যে কতটা ক্রিয়াশীল এবং উদ্যোগী তার প্রমাণ অমিত মিশ্র। সুযোগ এবং শ্রমের সঠিক মূল্য পেলে যৌতুকের মতো অনেক সামাজিক ব্যাধি এমনিতেই চলে যাবে। তখন আর অমিত মিশ্রের মতো গুনী মানুষকে কারাগারে বন্দী হতে হবে না স্ত্রী হত্যার দায়ে।
মন্তব্য চালু নেই