ফের বেপরোয়া ছাত্রলীগ
মোশারফ হোসেন। টাঙ্গাইলে মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরাধতত্ত্ব ও পুলিশ বিজ্ঞান বিভাগের স্নাতকোত্তর শ্রেণির শিক্ষার্থী। আর হয়তো কয়েক মাস পরেই লেখাপড়ার পাঠ চুকিয়ে চাকরির মাঠে নামতেন পরিবারের স্বপ্ন পুরণে। কিন্তু সেই স্বপ্ন অধরাই থাকলো।
ছাত্রলীগ করেও তার সহকর্মীদের হাতেই প্রাণ গেল মোশারফ হোসেনের। গতকার বুধবার আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে প্রাণ হারায় মোশারফ।
যদিও ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সংসদের এক বিবৃতিতে বলা হয়, “মওলানা ভাসানী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কোনো সাংগঠনিক কাঠামো নেই। অর্থাৎ মওলানা ভাসানী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কোনো কার্যক্রম নেই, এমনকি মাওলানা ভাসানী বিশ্ববিদ্যালয়ে এ পর্যন্ত ছাত্রলীগের কোনো কমিটি ঘোষণা করা হয়নি।”
শুধু মাওলানা ভাসানী বিশ্ববিদ্যালয়ে নয়, বর্তমান সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদে ছাত্রলীগের সংঘর্ষে এ পর্যন্ত ৮/১০ জন শিক্ষার্থী প্রাণ হারিয়েছে।
ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান সাংসদ নজরুল ইসলাম বাবু বলেন, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ব্যক্তি স্বার্থ ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ ঘটে। এগুলো ছাত্রলীগের সাংগঠনিক কারণে হয় না। তারপরেও যখন ছাত্রলীগের নাম জড়িয়ে যায় তখন সংঘঠনের উচিত তদন্ত করে এর বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া।
তিনি বলেন, ক্যাম্পাস কেন্দ্রীক সংঘর্ষের ঘটনায় সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়কেও ব্যবস্থা নিতে হবে। অন্যথায় এসব কমবে না।’
আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ঘটছে একের পর এক ঘটনা। এতে বিব্রত হয় সরকার ও দল। ম্লান হয় সরকারের সাফল্যগাথা অর্জনগুলো।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন বলেন, ‘বিষয়টি অবশ্যই বিব্রতকর। আমরা এখন এসব বিষয়ে হার্ড লাইনে আছি। কোনো অপরাধীকেই ছাড় দেয়া হবে না ।’
২০১৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট নগরী, হাজী দানেশ বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, বুয়েট, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর মেডিকেল কলেজ, কুমিল্লাসহ বিভিন্ন স্থানে গোলাগুলি, সংঘাত-সংঘর্ষ, যৌন হয়রানি, শিক্ষকদের ওপর চড়াও, খুনোখুনিসহ বিভিন্ন অপকর্মের অভিযোগের তীর খোদ সরকার সমর্থকদের বিরুদ্ধে।
ঘটনা বিশ্লেষণে দেখা যায়, এসব অপরাধ কর্মকাণ্ডে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র ও অন্যান্য সহযোগী সংগঠন জড়িয়ে পড়ছে আত্মঘাতী সিদ্ধান্তে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক জিয়া রহমান বলেন, ‘ক্ষমতাসীন দলের বেপরোয়া হয়ে ওঠার প্রবণতাটি ঐতিহাসিক। মূলত দুই ভাবে এটি সংঘটিত হয়। একদিকে দলের মধ্যে যারা সুবিধাভোগী অর্থাৎ না চাইতেই অনেক কিছু পেয়ে গেছে তারা হঠাৎ ক্ষমতা পেয়ে বেপরোয়া হয়ে ওঠে। অন্যদিকে নিজেরা রাজনীতি করতে না পেরে সরকারি দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে প্রতিপক্ষ দলের লোকজন ঢুকে যায় ক্ষমতাসীন দলে। তারপর এ ধরনের কর্মকাণ্ড ঘটায়।’
সমাধান কী হতে পারে- জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ প্রবণতা যেমন এক দিনে হয়নি তেমনি সমাধানও এক দিনে সম্ভব নয়। একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই এর সমাধান হবে। গণমাধ্যমে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ সংবাদ পরিবেশন, গণসচেতনতা, সিভিল সোসাইটির চাপ এবং সর্বোপরি গণতান্ত্রিক রাজনীতি চর্চার মধ্য দিয়েই এর সমাধান আসতে পারে বলে মনে করেন তিনি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক মাহফুজুল হক মারজান বলেন, ‘সমাজে চাওয়া-পাওয়ার ব্যবধান ঘোঁচাতেই অনেক অপরাধের জন্ম হয়। অনেকেই স্বার্থের দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন। এসব থেকেই ছোট ছোট অপরাধের জন্ম হয়ে এক সময় বড় আকার ধারণ করে।’
তবে সহনসীলতা সমাজ থেকে এ ধরনের কর্মকাণ্ড কমাতে পারে বলে মনে করেন তিনি।
জানা গেছে, সাম্প্রতিককালে তৈরি হওয়া এসব পরিস্থিতি পর্যালোচনায় সরকারও সতর্ক।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রী লাঞ্ছিত করার ঘটনায় পাঁচ ছাত্রলীগ কর্মীকে বহিষ্কার করেছে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ। অন্যদিকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে এক ছাত্রীকে উত্ত্যক্ত ও লাঞ্ছিত করায় এক ছাত্রলীগ কর্মীকে বহিষ্কার করেছে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ।
চলতি বছরের ১৬ এপ্রিল দিনাজপুরে হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ দ্বিতীয় বর্ষের মো. জাকারিয়া ও ভেটেরিনারি অনুষদের মাস্টার্সের মিল্টন নামে দুই ছাত্র নিহত হয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে এক অনুষ্ঠান চলাকালে চার মাস আগে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিতাড়িত ছাত্রলীগের সভাপতি ইফতেখারুল ইসলাম ও বহিষ্কৃত সাধারণ সম্পাদক অরুণকান্তি রায়ের নেতৃত্বে একটি সশস্ত্র দল হামলা চালায়। ছাত্রলীগের অন্য পক্ষের নেতৃত্বে ছিলেন ছাত্রলীগের কর্মী আসাদুজ্জামান ওরফে জেমী ও নাহিদ আহমেদ ওরফে নয়ন। ১৪ এপ্রিল ক্যাম্পাসের বৈশাখী অনুষ্ঠান থেকে ফেরার পথে রাজধানীর চানখাঁরপুল এলাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উত্তরণ বাসে এক ছাত্রীকে উত্ত্যক্ত করেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ কর্মী নাজমুল। এ সময় সাধারণ শিক্ষার্থীরা ওই ছাত্রলীগ কর্মীকে গণধোলাই দেন।
১৪ এপ্রিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মুহম্মদ মিজানউদ্দিনসহ অন্তত পাঁচ শিক্ষককে লাঞ্ছিত করেছেন মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকার ও তার সহযোগীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগের জন্য চাপ দিতে উপাচার্যের দফতরে গিয়ে তারা এ ঘটনা ঘটিয়েছেন।
পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় অচল করে দেওয়ার হুমকিও দিয়েছেন। শুধু লাঞ্ছিত করেই ক্ষান্ত হননি, ডাবলু সরকার উপাচার্যকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘আমাদের দেওয়া তালিকা অনুযায়ী নিয়োগ না দিলে আপনি বার বার অপমান-অপদস্থ হতেই থাকবেন। আর চাকরি দিলে শান্তিতে থাকবেন।’
১১ এপ্রিল কুমিল্লায় ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ শহর ছাত্রলীগ সভাপতি ও কুমিল্লা সার্ভে ইনস্টিটিউটের ভিপি সাইফুল ইসলাম গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা ও মহানগর কর্মী সম্মেলন শেষে টাউন হল মিলনায়তনে সম্মেলন শেষে দলীয় পদ-পদবিকে কেন্দ্র করে দুই গ্রুপের নেতা-কর্মীদের মধ্যে টাউন হল মাঠ ও কান্দিরপাড় এলাকায় ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া শুরু হয়। এক পর্যায়ে উভয় গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, ককটেল বিস্ফোরণ ও গুলিবিনিময়ের ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষ চলাকালে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহর ছাত্রলীগের সভাপতি ও নগরীর গোবিন্দপুরের এম সাইফুল ইসলামসহ উভয় গ্রুপের আরও অন্তত ১০-১২ জন আহত হন। বুকে গুলিবিদ্ধ হওয়ার কারণে সাইফুল ইসলামকে মুন হাসপাতালের আইসিইউতে রাখা হয়েছিল।
১ এপ্রিল গাজীপুরের টঙ্গী সফিউদ্দিন সরকার একাডেমি অ্যান্ড কলেজে পরীক্ষা চলাকালে নকল সরবরাহে বাধা দেওয়ায় কলেজ ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক রাশেদুল ইসলাম টিটু জোরপূর্বক প্রবেশ করতে যান। এতে বাধা দেওয়ায় ক্ষিপ্ত হয়ে ওই ছাত্রলীগ নেতার অনুসারীরা পুলিশ সদস্যকে এলোপাতাড়ি মারধর করেন।
১০ মার্চ বিশ্বকাপ ক্রিকেটে ইংল্যান্ডকে পরাজিত করে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠার আনন্দে বিশ্ববিদ্যালয় টিএসসি এলাকায় জড় হন কয়েক হাজার মানুষ। এ সময় মুহসীন হল শাখা ছাত্রলীগের কর্মীরা সেখানে উপস্থিত নারী ও বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীদের লাঞ্ছনা ও জোর করে রং মেখে দেওয়ার ঘটনা ঘটান। এক পর্যায়ে তাদের এমন কর্মকাণ্ডের শিকার হন একজন নারী সাংবাদিক। সেখানে উপস্থিত ওই ছাত্রীর বন্ধু ও বিভাগের জুনিয়ররা প্রতিবাদ জানালে তাদের ওপর চড়াও হন ছাত্রলীগের একদল কর্মী।
গত বছরের ১৪ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারায় তাপস পাল নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতি বিভাগের এক শিক্ষার্থী। শাহ জালাল হল ও শাহ আমানত হল এলাকায় এ সংঘর্ষের ঘটনায় আরও অন্তত তিনজন গুলিবিদ্ধ হয়েছে।
একই বছরের ২০ নভেম্বর শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজেদের কর্মী সুমন চন্দ্র দাসকে গুলি করে ও কুপিয়ে হত্যা করে ছাত্রলীগ।
১৪ জুলাই যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের কোন্দলকে কেন্দ্র করে খুন হন পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র নাইমুল ইসলাম রিয়াদ।
একট দিনে সিলেটে নিজ দলের প্রতিদ্বন্দ্বী গ্রুপের ছুরিকাঘাতে ছাত্রলীগের এক কর্মী খুন হয়। তার নাম মো. আবদুল্লাহ ওরফে কচি (২৫)। সে নগরীর মদিনা মার্কেটের আকিব ফার্মেসিতে কাজ করতো। ঢাকাটাইমস
মন্তব্য চালু নেই