‘ফের অনিশ্চিত গন্তব্যে বাংলাদেশ’
মঙ্গলবার সকালে ‘আজ গণতন্ত্রের অগ্নিপরীক্ষার দিন’ এবং এর আগের দিন ‘নির্বাচন সুষ্ঠু না হলে কি করবে বিএনপি?’ পৃথক শিরোনামে দুটি নিবন্ধ লিখেছিলাম। এতে তিন সিটি নির্বাচন নিয়ে সরকার ও বিরোধী জোটের নির্বাচনী কর্মযজ্ঞ, প্রার্থীদের তৎপরতা, নির্বাচন কমিশনের ভুমিকার বিষয়ে জনগণের প্রত্যাশা ও আশঙ্কা নিয়ে নিজের ভাবনা দেশবাসীর সামনে তুলে ধরেছিলাম।
প্রথম নিবন্ধের শুরুতেই উল্লেখ করেছিলাম- দিন শেষে মঙ্গলবার রাতেই জানা যাবে এই ‘বাংলাদেশীয় গণতন্ত্র’ এর স্বরূপ এবং সামনের পথ কতটা মসৃণ কিংবা পিচ্ছিল। আমার ধারণা, দেশবাসী ইতোমধ্যেই বিষয়টি পরিস্কার হয়ে গেছেন। ফলে তা আর নতুন করে এখানে আলোচনা করে বিরুক্তি বাড়াতে চাই না।
অগ্নি পরীক্ষায় তো গণতন্ত্র ফেল করেছে, তাহলে এবার কী হবে বাংলাদেশী গণতন্ত্রের? অধিকাংশ নাগরিকের মনে এমন প্রশ্নই হয়তো ঘুরপাক খাচ্ছে, তাই না। এর একটা সহজ ও প্রচলিত জবাব হলো, পরীক্ষায় ফেল করলে যা হয় তাই হবে। আবার নতুন করে পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে অন্যথা লেখাপড়া বন্ধ করে দিতে হবে। অর্থাৎ এই নির্বাচনে পরীক্ষার মধ্য দিয়েই আজ থেকে বাংলাদেশে গণতন্ত্র শেষ হয়ে গেল এমনটি ভাববার কোনো সুযোগ নেই, যেনতেন হলেও তো একটা পরীক্ষার মধ্য দিয়ে ফেল করেছে! ফলে আজ থেকে আবার তার নতুন প্রস্তুতির যাত্রা শুরু হলো। তবে এ যাত্রায় অবশ্যই দীর্ঘ পথ পারি দিতে হবে এতে কোনো সন্দেহ নেই ।
কেননা, দীর্ঘ ৪৪ বছরে যে ‘গণতন্ত্র’ নামক শাসন-শোষনের মন্ত্রটি অনেকখানি এগিয়েছিল তা গতকাল মঙ্গলবার তিন সিটি নির্বাচনী নাটক মঞ্চাস্থায়নের মাধ্যমে আমরা সবাই মিলে অনেক দূর পেছনে নিক্ষেপ করেছি। এরপর হয়তো অনেক প্রতিকূলতায় বিভিন্ন পরীক্ষা দিয়ে পাস করে আবার নতুন করে ঘুরে দাঁড়াতে পারে এই গণতন্ত্র। অন্যথা যা হবার তাই হবে। যারা এই বাস্তবতায় বিশ্বাস করে না, তারা হয়তো রাজনীতি থেকে ছিটকে পড়বে, আর যারা বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে সামনে এগুবে তারাই হয়তো পুনরায় ঘুরে দাঁড়ানোর প্রত্যাশা রাখবে। এটাই স্বাভাবিক
২৮ এপ্রিল, ২০১৫ (মঙ্গলবার) যা ঘটেছে, এতে আমার পরিচিতজনদের অনেকেই বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছেন- ‘এর আগে দেশবাসী নির্বাচনের নামে এমন নাটক আর কখনো দেখেনি’ । এটা বাংলাদেশর ইতিহাসে আরেকটি কলঙ্ক বলে আখ্যায়িত করেন তারা। তবে আমার কাছে তা মোটেও বিস্ময়কর মনে হয়নি। কেননা, মঙ্গলবার সারাদিন তিন সিটি নির্বাচন নিয়ে যা ঘটেছে তা জনগণের প্রত্যাশার বাইরে কিছু ঘটেছে বলে আমার কাছে মোটেও মনে হয়নি । হয়তো পেশি শক্তির রাজনীতিতে দূর্বল অদূরদর্শি বিরোধী জোট বিএনপি ও তাদের শরীক দলের নেতারা এমনটি প্রত্যাশা করেনি । তারা হয়তো ভেবেছিল আমাদের পক্ষে এতো গণজোয়ার কে ঠেকাবে এই বিজয়। ‘ক্ষেতে ফসলের ভাল ফলন হয়েছে তা আপনার দুর্বলতায় ঘরে উঠাতে না পারলে ক্ষেত বা ফসলের কী দোষ!
তবে এর আগে যেদিন দেখলাম অরাজনৈতিকরাই রাজনৈতিক ভুমিকায় রাতারাতি হিরু সেদিনই কিছুটা অনুমান করতে পেরেছিলাম দলটির দৈন্যতার বিষয়টি। ফলে মঙ্গলবার যা ঘটেছে তা মোটেও অপ্রত্যাশিত ছিল না। সার্বিক পরিস্থিতির আলোকে দেশের প্রায় সিংহভাগ জনগণ এমনটিই ধারণা পোষণ করে আসছিল বেশ ক’দিন থেকেই। বরং নিজেদের দূর্বলতায় পেশি শক্তির কাছে অসহায়ত্ব প্রকাশ করে নির্বাচনী মাঠ থেকে ঠিক দুপুরে সরে দাঁড়ানোর ঘটনায় হয়তো অনেকের কাছে বিস্ময়ের বিষয় ছিল। এ নিয়ে ক্ষুব্ধও হয়েছে তাদের অনেক কর্মসমর্থকরা এমনিই লক্ষ্য করা গেছে সোস্যাল মিডিয়াগুলোতে। তবে শক্তিতে দুর্বল এই বিশাল রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে থেকে নির্বাচন বর্জন না করে এর চেয়ে বিকল্প কিবা করার ছিল বিএনপি ও অন্যান্যদের!
ফলে এই নির্বাচনে জনপ্রত্যাশিত ফলাফল হয়েছে এটাই সত্য ও বাস্তব। এক্ষেত্রে কোনো ব্যত্যয় হয়নি কিংবা ব্যত্যয় ঘটায়নি সরকার ও নির্বাচন কমিশন। সবচেয়ে বড় কথা হলো-এই নির্বাচনকে ঘিরে দেশের প্রধান দুই শক্তির মধ্যে যে ব্যাপক সহিংসতা ও হানাহানির যে আশঙ্কা ছিল জনগণের মাঝে অন্তত সেটা থেকে রক্ষা । নির্বাচনের আগের দিন থেকে যে উত্তজনাকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল তাতে অনেক রক্তপাতেরও সমূহ আশঙ্কা ছিল ভোটারদের মাঝে । কিন্তু তা এড়ানো সম্ভব হয়েছে এটা কম কৃতিত্বের বিষয় নয় । অবশ্য এ জন্য সরকার, আইন-শৃঙ্খলাবাহিনী ও নির্বাচন কমিশন ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য । তাই দেশবাসীর পক্ষ থেকে আমি তাদেরকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। সেই সাথে বিজয়ী মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীদেরও অভিনন্দন জানাচ্ছি ।
আগের নিবন্ধেই উল্লেখ করেছি স্বাধীনতার ৪৪ বছরে বাংলার রাজনীতির মাঠে প্রত্যাশিত গণতন্ত্র বারবার হোচোট খেয়েছে। সংবিধান নিয়ে বির্তকের সৃষ্টি যেন কালো মেঘে ঢাকা। উৎকন্ঠায় দিন কাটছে সাধারণ মানুষের। কিন্তু আমার মতে, গণতন্ত্র নিয়ে এই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার একেবারেই মূল্যহীন। কেননা, ইতোপূর্বে দেশবাসীর অনেকের প্রত্যক্ষ করার সৌর্ভাগ্য হয়েছে সেই ৭২-৭৫’র শেখ মুজিবের গণতন্ত্র, এরপর আশির দশকে সাত্তার, জিয়াউর রহমান, এরশাদের রকমফের গণতন্ত্র। এরপর আমরা প্রত্যক্ষ করেছি- বেগম জিয়া ও শেখ হাসিনার গণতন্ত্রের স্বরূপ। এবার না হয়, একটু বেশী রোমাঞ্চকর হয়ে গেল! দেশবাসী এর আগে যা দেখেছে আর বর্তমানে আমরা যা দেখছি তাতে, কেউ কোনো দিন প্রকৃত অর্থে গণতন্ত্র চর্চা কিংবা একে প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তির উপর দাঁড় করাতে চেষ্টা করেছে বলে প্রতীয়মান হয়নি। দেশ ও জনগণ গোল্লায় যাক, তাতে কী! নিজেদের মতো করেই যে ক্ষমতার স্বাদটা ভোগ করতে হবে। এ স্বাদ কেউ একবার আস্বাদন করতে পারলে সেটা আর কে ছাড়তে চায়!
ফলে আব্রাহাম লিংকনের ‘Democracy is of the people by the people and for the people’ গণতন্ত্রের সেই বিখ্যাত উক্তির দিকে তাকিয়ে বিস্ময়-উৎকণ্ঠা প্রকাশে কোনো লাভ নেই। সময়কাল ভেদে বিশ্বের প্রায় সব দেশেই সাধারণ জনতাকে শাসন-শোষনে এই ‘গণতন্ত্র’ নামক মন্ত্রটির রকমফের হয়েছে।
বর্তমান বিশ্বে রাষ্ট্র পরিচালনায় গণতন্ত্র সবচেয়ে জনপ্রিয় পদ্ধতি হলেও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে তা কতটা কার্যকরি ও অর্থবহ সেটা নিয়ে অবশ্য বারবার প্রশ্ন উঠেছে খোদ গণতন্ত্রের প্রবক্তাদের মাঝেই। আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মধ্যেও এ বিষয়ে ব্যাপক মতপার্থক্য রয়েছে। থাক এসব তাত্ত্বিক কথা।
আমরা যদি উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর শাসন ব্যবস্থার দিকে একটু ভাল করে খেয়াল করি তবেই সহজে বুঝতে সক্ষম হবো- স্থান কাল পাত্র ভেদে গণতন্ত্র নামক শাসনের মন্ত্রটি কত বৈচিত্র্যময় ! ফলে উন্নয়নশীল দেশের সেই সব গণ্ডি থেকে আমরা মোটেও পৃথক নই। আমাদের প্রতিবেশী পাকিস্তান ও থাইল্যান্ডের কথাই যদি আসি- সেখানেও কিন্তু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এখনো প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করতে পারেনি। হানাহানি ও সহিংসতায় নানা সীমাবদ্ধতার বেড়াজালে আবদ্ধ।
আগের নিবন্ধের শুরুতেই ‘বাংলাদেশী গণতন্ত্র’ কথাটি উল্লেখ করেছিলাম। কেননা, পৃথিবীর আর কোথাও এমন বিরল গণতন্ত্র খোজেঁ পাওয়া যাবে কী না তা আমার জানা নেই। যেখানে গণতন্ত্রের মৌলিক বিষয় নির্বাচন ব্যবস্থাতেই এক অভিনভত্ব, সরকার-বিরোধী দল একাকার, আইন-শাসন ও বিচার বিভাগের অভিনবত্ব রূপ, আর আমলাদের অনাধিকার রাজনৈতিক চর্চার এক অভিনব নজির ইত্যাদি। গতকাল মঙ্গলবার সিটি নির্বাচনের পর তো আরো বিরল গণতন্ত্রের দেশে পরিণত হলো।
ফলে মঙ্গলবারের তিন সিটি নির্বাচন নিয়ে বিস্মিত হবার কিছুই নেই। কেননা, আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের গণতন্ত্রের স্বরূপই এমনটি বলা যায়। যেখানে পেশি শক্তি আর কালো টাকার দৌরাত্বের বৃত্তে আবদ্ধ গণতন্ত্র। সেই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচন কমিশনের কাছ থেকে এর চেয়ে বেশী আর কী আশা করা যেতে পারে ! তাদেরও তো একটা সীমাবদ্ধতা আছে, নিয়োগ দাতাদের হুকুম তামিল না করলে কখন আবার পদ চলে যায়!
ফলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী রকিব উদ্দীন আহমদ ঠিকই বলেছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে অবাধ, সুষ্ঠু ও উৎসবমুখর পরিবেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। তিনি নির্বাচনে জনগণের রায় বা ফলাফল মেনে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এগিয়ে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। সেই সাথে আমি বলবো, গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তব্ধ বলে খ্যাত আমাদের মিডিয়া তথা গণমাধ্যমের ভুমিকাও কত চমৎকার ও বৈচিত্রময়! থাক এ বিষয়ে আর বেশী এগুনো ঠিক হবে না, এর চেয়ে বেশী কিছু বলতে গেলে হয়তো আমার নিবন্ধটিই প্রকাশ করা সম্পাদকের পক্ষে সম্ভব হবে না।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের পরাশক্তি দেশের কূটনীতিকদের ভুমিকাও কী অভিনব! সকালে এক রকম বিকালে অন্যরকম এই রকমফের বক্তব্যে দেশবাসী তো বটেই আমিও নিজেও বিভ্রান্ত। অর্থাৎ এই নির্বাচন নিয়ে তারা কী বলতে চাচ্ছেন তা অন্তত: আমার বোধগম্য হয়নি। অবশ্য বরাবরই এদের ভুমিকা অনেকটা এমনই হয়ে আসছে। তাঁদের মতামতে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে বলে সিইসি দাবি করেছেন। বিভিন্ন গণমাধ্যমে তা প্রচারও হয়েছে। আমাদের র্যা ব-পুলিশ বাহিনীর প্রধানরাও বলেছেন নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে । ফলে এরপর আর এই নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তোলার সাধ্য আছে কার!
এরপরও কথা থেকে যায়- ব্যাপক কারচুপির অভিযোগে প্রধান শক্তি বিএনপির ভোট বর্জনের বিষয়টি ।তারা ভোটকেন্দ্র দখল ও ভোট জালিয়াতির ব্যাপক অভিযোগ তুলেছে ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে। পাশাপাশি অন্যান্য দলের মেয়র প্রার্থীরাও একই অভিযোগে দুপুরেই নির্বাচন বর্জন করেন। চট্টগ্রামের বিএনপি সমর্থিত মেয়র প্রার্থী এম মনজুর আলম তো এমন বিস্ময়কর ভোট জালিয়াতি দেখে ক্ষোভে-দু:খে রাজনীতি থেকেই অবসরে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। যদিও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বলছে, রাজনীতির জন্যে ইস্যু তৈরি করার লক্ষ্যেই বিএনপি পরিকল্পিতভাবে নির্বাচন বয়কট করেছে। নির্বাচন কমিশন বলেছে, নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে, তবে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানো এটা ব্যক্তিগত ব্যাপার।
আমরা জানি, গত বছর ৫ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচন বয়কট এবং এ বছর টানা কয়েক মাস ধরে সহিংস আন্দোলনে ক্ষ্যান্ত দিয়ে বিএনপি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নেয়। এতে দেশবাসী ধারণা করছিল যে, এই নির্বাচনের মধ্যদিয়ে হয়তো রাজনৈতিক অচলাবস্থার বরফ গলার একটা সুযোগ তৈরি হলো। কিন্তু বিরোধীদের ভোট বয়কটের মধ্যদিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতি যে নতুন একটি অনিশ্চয়তায় পড়লো, এ নিয়ে কারো সন্দেহ নেই। যদিও বিএনপির পক্ষ থেকে এখনো কোনো কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়নি। তবে সামনে দিনে বিরোধী জোট তথা বিএনপি কোন পথে হাঁটবে তা সহজেই অনুমান করা যায়।
আর সরকার ও নির্বাচন কমিশন যাই বলুক না কেন, মিডিয়ায় যে সব খবর প্রকাশিত হয়েছে তাতে এই নির্বাচন যে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ইতিহাসে আরেকটি কলঙ্ক লেপন করেছে তা অস্বীকার করার উপায় নেই। বলতে গেলে এই নির্বাচন সেই বহুল আলোচিত মাগুরার নির্বাচন থেকেও বেশী কুৎসিত, নিন্দনীয় ও দুর্গন্ধময়। কেননা, গণমাধ্যমের ভাষায়- সোয়া ৮টার মধ্যেই অর্ধশত কেন্দ্রের ভোট গ্রহণ সম্পন্ন, ক্ষমতাসীন নেতাকর্মিদের ভোটকেন্দ্র দখল করে সিল মেরে ভোটের বক্সভর্তি করার মহোৎসব, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মারধর করে বের করে দেয়া ইত্যাদি বিষয়গুলো কোনোভাবেই লুকানোর মতো নয়। ফলে অতীতে নির্বাচন নিয়ে যা হয়েছে তার চেয়েও এটা অনেক বেশী ন্যাক্কারজনক ও লজ্জ্বাস্কর।
জানিনা, জাতি এই কলঙ্ক মোছবে কীভাবে। বাংলাদেশের টাইগাররা যে সুনাম কুঁড়িয়েছিল তা কী করেই বা ধরে রাখবে জাতি। শুধু তাই নয়, এই নির্বাচন এমন একটা খারাপ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে যে, গোটা নির্বাচন ব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থাহীনতা সৃষ্টি করেছে। এতে ভবিষ্যতে যে কোনো সরকারের অধীন যে কোনো ধরনের নির্বাচনে অংশ নিতে অনাগ্রহ দেখাবে নাগরিকরা। ফলে সহজেই অনুমাণ করা যায়- কোন অনিশ্চিত গন্তব্যে এই বাংলাদেশ ও এর গণতন্ত্র।
ইতোমধ্যে তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচনের অনিয়মের সব অভিযোগ দ্রুত এবং নিরপেক্ষভাবে তদন্ত চেয়েছে ব্রিটেন। মঙ্গলবার বিকেলে ব্রিটিশ হাই কমিশনার রবার্ট গিবসন এক বিবৃতিতে বলেন, “সব রাজনৈতিক দলের আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে আজকের ঘটনায় প্রতিক্রিয়া দেখানো উচিত। অনিয়মের সকল অভিযোগ দ্রুত এবং নিরপেক্ষভাবে তদন্ত হওয়া জরুরি। সেই সাথে “সিটি করপোরেশন নির্বাচন থেকে মাঝ পথে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদি দলের (বিএনপি) সরে দাঁড়ানোর ঘটনা দুঃখজনক বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়।
অন্যদিকে ঢাকাস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট বলেছেন, আজকে বিভিন্ন ভোট কেন্দ্রে ভোট জালিয়াতি, ভয়-ভীতি প্রদর্শন, এবং সহিংসতার যে সব ঘটনা ঘটেছে তার প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে ব্যাপক ও বিশ্বাসযোগ্য প্রতিবেদন পাওয়া গেছে। এর আগে এক টুইট বার্তায় তিনি বলেন, যেকোন উপায়ে জেতা, আসলেই কোন জেতা নয়। একইসঙ্গে বিএনপি সিটি করপোরেশন নির্বাচন বয়কটের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা হতাশাজনক বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি। অন্যদিকে জাতিসংঘও নির্বাচনের অনিয়মের বিষয়গুলো তদন্তের দাবি করেছে।
ফলে অনেক হয়েছে আর নয়। এবার থামতে হবে। যথাসম্ভব দ্রুত ঘটনাগুলোর নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া এবং এব্যাপারে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া উচিত। অন্যথা, বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি খারাপ দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
শোষণ নিপীড়ন থেকে মুক্তির প্রত্যাশায় যে গণতন্ত্রের দীর্ঘ ৯ মাসের মহানযুক্ত যুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষ জীবন বিলিয়ে দিয়ে একটি স্বাধীন দেশ উপহার দিলা। কিন্তু আজ আমরা সেই চেতনা থেকে অনেক দূরে, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করার পরিবর্তে আজ গণতন্ত্রকে হত্যায় মেতে উঠেছি আমরা ।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মূল সারাংশ ছিল- শোষণ-নিপীড়ন থেকে মানুষের মুক্তি অর্থাৎ শোষণমুক্ত একটি গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠা। ৭ মার্চ ১৯ মিনিটের ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু সেই স্বপ্নই দেখিয়েছিলেন ৭ কোটি বাঙালীকে। তিনি দেখিয়েছিলেন এদেশের নিপীড়িত-শোষিত মানুষের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির স্বপ্ন। আর সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নেই বাঙালীর মনে জাগ্রত করেছিল অদম্য স্পৃহা। আর সেই ভিত্তিতেই দীর্ঘ ৯মাস যুদ্ধে ৩০ লাখ বাঙালীর রক্ত আর অগণিত মা বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত হয় সেই কাঙ্খিত মুক্তি।
কিন্তু দেশ স্বাধীনের ৪৪ বছর পর আজ ২০১৫ সালে দাঁড়িয়ে যদি মূল্যায়ন করি তাহলে কী সেই চেতনা মোতাবেক আমরা প্রকৃত অর্থে মুক্তি লাভ করতে পেরেছি? পেরেছি শোষণমুক্ত গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে? না আমাদের উপর শোষন-নিপীড়নের মাত্রা আরো বেড়েছে! তাই আজ আমাদের দেশের রাজনীতিবিদ ও হর্তাকর্তাদের কাছে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হয়- এটাই কী মুক্তিযুদ্ধের চেতনার গণতন্ত্র? আর এ জন্যই কী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সারাটি জীবন সংগ্রাম করে গেছেন? জানিনা, তাদের কাছে এর কোনো সঠিক জবাব আছে কী না। তবে দেশ যে আজ এক অনিশ্চিত গন্তব্যের দিকে যাচ্ছে এতো আমাদের কারো সন্দেহ নেই।
সবশেষে প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনে বিজয়ী মেয়র ও কাউন্সিল প্রার্থীদের অভিনন্দন জানানোর পাশাপাশি তাদের প্রতি প্রত্যাশা রাখতে চাই- তারা যেন দলমতের ভিত্তিতে নয়, একজন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হিসেবে সব নাগরিকের সেবা নিশ্চিত করতে ভুমিকা রাখেন। আল্লাহ হাফেজ।
লেখক :
ড. সরদার এম. আনিছুর রহমান
কলাম লেখক ও গবেষক, ই-মেইল: [email protected]
মন্তব্য চালু নেই