ফের অতি উৎসাহীরা সক্রিয় আ’লীগে
আবারও অতি উৎসাহীদের ভিড় আওয়ামী লীগে। টানা দ্বিতীয়বার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর অতি উৎসাহীদের বিচরণ যেন সর্বত্র। যারা জীবনে এক মুহূর্তের জন্যও আওয়ামী লীগের আদর্শের রাজনীতি করেননি কিংবা ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে ছিল শক্ত অবস্থান তারাই এখন আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ নিয়ে বেশি চিন্তিত। আওয়ামী লীগের ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতারা এসব অতি উৎসাহীর আচরণে খুবই বিরক্ত ও রুষ্ট। অতি উৎসাহীদের আচরণে মনে হয়, দলের দুর্যোগে-সংকটে একমাত্র তারাই ছিলেন, তারাই থাকবেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পরপর দুবার ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগে এবার ব্যতিক্রম চিত্র। দলের ত্যাগী ও পরীক্ষিতরা যখন উপেক্ষিত তখন সংগঠনে ছড়ি ঘোরানোর স্পর্ধা দেখিয়ে চলেছেন এ অতি উৎসাহীরাই। দলকে বিতর্কিত করেই তারা নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত। সর্বত্রই তাদের পদচারণা। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, সচিবালয়, ব্যবসা-বাণিজ্য, প্রশাসন, মিডিয়াপাড়া থেকে শুরু করে ক্ষমতার কেন্দ্রে অতি উৎসাহীদের শক্ত অবস্থান। সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী-নেতা এবং সংসদ সদস্যদেরও কৌশলে ঘিরে রেখেছেন অতি উৎসাহীরা। দলের ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতারা যেখানে উপেক্ষিত সেখানে অতি উৎসাহী ও সুবিধাবাদীদের প্রাধান্য আওয়ামী লীগের মতো ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দলটির জন্য বড় ধরনের অশনিসংকেত বলে মন্তব্য করেছেন দেশের সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীরা। প্রবীণ এক সাংবাদিক এই শ্রেণির দরদি ও অতি উৎসাহীদের ‘মোর ক্যাথলিক দ্যান পোপ’ আখ্যা দিয়েছেন। তার মতে, ‘এদের অধিকাংশই মৌসুমি পাখি। এরা দানা খেয়ে হাওয়া হয়ে যায়।’ যারা থেকে যায় তারা আশা করে কিয়ামততক দলের যত রস আছে নিংড়ে নিংড়ে তা খাবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এক শিক্ষক ও প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীর মতে, এরা সব সুযোগসন্ধানী, এক ডাল থেকে আরেক ডালে ঘুরে বেড়ায়। নিজেদের স্বার্থ হাসিল হলে সরে পড়বে। দলে অতি উৎসাহী ও চাটুকারদের আচরণে মনে হয়, তাদের পরামর্শেই চলছে সরকার। আবার কেউ কেউ এমন ভঙ্গি করছেন যার অর্থ দাঁড়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যা করছেন সবই তার পরামর্শে করছেন। দলের নেতা-কর্মীরা অবশ্য এদের চিত্রিত করছেন ‘ভণ্ড’ হিসেবে। আওয়ামী লীগের মাঠ পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা মনে করছেন, অতি উৎসাহীদের চাটুকারিতা আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থা থেকে তারা উত্তরণ চান।
এ বিষয়ে মন্তব্য চাওয়া হলে ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটির ভিসি অধ্যাপক আবদুল মান্নান চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘যারা আজ দলে ভিড়েছেন তারা ভাসমান শেওলার মতো। সুদিনে থাকবেন, দলের দুর্দিনে পাশে পাওয়া যাবে না। ’৭৫-পরবর্তীতে আমরা সে পরিস্থিতি দেখেছি।’ তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ একটি আদর্শভিত্তিক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। এ দল যারা করেন তারা আদর্শ নিয়েই করে থাকেন। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে লীগারের নতুন আওয়ামী সংখ্যা বাড়ছে। এরা সব সুযোগসন্ধানী। তিনি বলেন, এসব নবীন আওয়ামী লীগ বা অতি উৎসাহীদের বিদায় করে যারা পরীক্ষিত তাদের দলে ও সরকারে মূল্যায়ন করতে হবে।সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, একসময় যারা আওয়ামী লীগের ঘোর বিরোধী কিংবা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমালোচনাই ছিল যাদের কাছে মুখ্য তারাই এখন দলের দরদি সেজে চাটুকারের ভূমিকায়। চাটুকার ও অতি উৎসাহীদের ভূমিকায় মনে হয় তারা না হলে ঐতিহ্যবাহী আওয়ামী লীগ রসাতলে যাবে। চাটুকারদের প্রভাব-প্রতিপত্তির কারণে নীতিনির্ধারকরাও ত্যাগীদের সরিয়ে এ মৌসুমি পাখিদের কাছে টানছেন। জড়িয়ে পড়ছেন নানান বিতর্কে। অভিযোগ রয়েছে, সরকারের সব সুবিধা নিয়েই এরা ক্ষান্ত হননি, নজর দিয়েছেন দলীয় পদ-পদবিতেও। অভিযোগ উঠেছে, দলের পদ বাগানোর মতলবে তারা অর্থ লেনদেনেও জড়িয়ে পড়ছেন। অতি উৎসাহীদের তালিকায় রয়েছেন আদর্শচ্যুত রাজনৈতিক কর্মী (যারা একসময় আওয়ামীবিরোধী রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন), উঠতি ব্যবসায়ী, অর্থলোভী প্রশাসনিক কর্মকর্তা, সুবিধাবাদী বুদ্ধিজীবী এবং বিদেশফেরত আওয়ামী লীগের নেতা ও একশ্রেণির ধান্ধাবাজ মিডিয়া কর্মী।মাঠের নেতা-কর্মীদের অভিযোগ, একসময় যারা ভিন্ন আদর্শের রাজনীতি করতেন এবং দলের সংকটকালে যাদের চেহারাও দেখা যায়নি তারাই এখন বড় আওয়ামী লীগার। সরকারের রাজনৈতিক নিয়োগ থেকে শুরু করে, ব্যবসা-বাণিজ্যে সুবিধা আদায় এমনকি ব্যাংক-বীমা, বেসরকারি টিভি চ্যানেল, বিদ্যুৎ প্ল্যান্টের মালিকানা হাতিয়ে নিচ্ছেন এসব সুবিধাবাদী। কেউ কেউ সুদূর আমেরিকা, ব্রিটেনসহ ইউরোপের উন্নত দেশ থেকে ছুটে এসেছেন টাকার কুমির হওয়ার মতলবে এবং কুমির হয়েছেনও। দলের মন্ত্রী, নেতা, এমপি সবই যেন সুবিধাবাদীদের মুঠোয়। ত্যাগী নেতা-কর্মীদের আশঙ্কা- এভাবে চলতে থাকলে চাটুকারদের প্রবল সে াত একসময় আদর্র্শিক নেতা-কর্মীদের হতাশার সাগরে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। সে ক্ষেত্রে লক্ষ্যচ্যুত হতে পারে বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া আওয়ামী লীগ।এ ব্যাপারে মন্তব্য চাওয়া হলে আওয়ামী লীগের সাবেক তথ্য ও গবেষণা বিষয়ক সম্পাদক ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক আবু সাইয়িদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, একটি শক্তিশালী গণআকাক্সক্ষার জন্য প্রয়োজনে যে রাজনৈতিক দল তার সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য, আদর্শ এবং সুশৃঙ্খল কর্মীবাহিনী থাকবে। ঐতিহ্যবাহী আওয়ামী লীগে এই আদর্শের চর্চা ছিল বলেই লাখ লাখ কর্মী দলের জন্য ত্যাগ স্বীকার করেছেন, জীবন দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর ডাকে জীবন বাজি রেখে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। কিন্তু এই দলে এখন আদর্শের চেয়ে ব্যক্তিগত স্বার্থ বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এগুলো হচ্ছে একটি রোগাক্রান্ত দলের লক্ষণ। তবে আশার কথা হলো আদর্শিক জায়গায় এখনো আওয়ামী লীগ রয়েছে অনড় অবস্থানে। আর এ কারণেই জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও বিশ্বায়নের যুগেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে নিজেদের অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের সাহস দেখাতে পারে আওয়ামী লীগ সরকার। তিনি বলেন, এ আদর্শিক লড়াই না থাকলে এবং ত্যাগী নেতা-কর্মীদের মূল্যায়ন না হলে সংগঠন এক পর্যায়ে অবক্ষয়ের দিকে চলে যাবে। আওয়ামী লীগের এখন অপরিহার্য দায়িত্ব হচ্ছে আদর্শিক, ত্যাগী ও পরীক্ষিতদের দিয়ে দলকে ঢেলে সাজানো।নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এক উপাচার্য বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সবখানে অতি আওয়ামী লীগার হওয়ার ভাবটা দলের জন্য খারাপ লক্ষণ। ক্ষমতায় থাকলে তারা জোয়ার-ভাটার মতোই আসবে আবার চলে যাবে। তারা দলে ভিড়ছে আদর্শের জন্য নয়, নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য। এসব হাইব্রিড নেতার কারণে ত্যাগী-পরীক্ষিত নেতারা কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। তারা আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে পড়ছে। এদের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী মহলকে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও প্রবীণ রাজনীতিক শেখ আবদুল আজিজ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা যখন রাজনীতি করেছি তখন কর্মীদের দলের প্রতি ভক্তি, নেতাদের প্রতি শ্রদ্ধা ছিল। এখন চেয়ার দখলের রাজনীতি চলছে। নেতার প্রতি শ্রদ্ধা ও দলের প্রতি ভক্তি দেখা যায় না।’জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মজীবনীতে যার কথা বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগের সেই প্রবীণ নেতা কুমিল্লার বাসিন্দা আহমেদ আলী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। বঙ্গবন্ধু ছিলেন তার শিষ্য। দলের মধ্যে গণতন্ত্রের চর্চা কমে গেছে, যার কারণে নেতা-কর্মীরা এখন বিপথগামী হচ্ছে। নেতা-কর্মীদের প্রতি এ কথাই বলব, ভোগের নয়, ত্যাগের রাজনীতি করুন।’বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, শুধু আওয়ামী লীগেই নয়, চাটুকাররা সব রাজনৈতিক দলের জন্যই ক্ষতিকর। যখন মন্ত্রীরা কোনো অনুষ্ঠানে যান, তখন ইস্ত্রি করা মুজিবকোট পরে বড় বড় মিছিল-শোডাউন দেন। এদের দেখলেই বোঝা যায়। তবে কখনই মুজিবের আদর্শ বিশ্বাস করেন না বা তারা বঙ্গবন্ধুর আÍজীবনী কেনেননি বা পড়েননি। দেশের প্রাচীনতম রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের চাটুকারদের চিহ্নিত করে বের করে দেওয়া উচিত। এ জন্য শেখ হাসিনাকেই দায়িত্ব নিতে হবে। না হলে দল ও সরকার ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সুবিধাবাদীদের বের করে দিলে আওয়ামী লীগ ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, বরং লাভবান হবে। যারা আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি জড়িত নন তারাও তখন আওয়ামী লীগ করতে উৎসাহ পাবেন। জেলা পর্যায়ে সব নেতাও যে সততা নিয়ে কাজ করছেন তা নয়। আবার বিএনপির ক্ষেত্রেও একই অবস্থা।বাংলাদেশ প্রতিদিন
মন্তব্য চালু নেই