ফেরি মৌসুমে হকারি হাঁক
ফেরি করে জিনিস বিক্রির ভরা মৌসুম। এই সময়টাতে রাজধানীর প্রতিটি পাড়ায় ও মহল্লায় নেমে গেছেন অনেক ফেরিওয়ালা বা হকার। সকাল ৮ টার আগেই অলিগলিতে পণ্য নিয়ে শুরু হয়ে যায় তাদের হাঁকাহাঁকি।
নগরবাসী যারা একটু আয়েসী এবং বেলা করে ঘুম থেকে ওঠেন, তাদের বারটা বেজে যায় হকারের গলাফাটা চিৎকারে।
কি নেই হকারের তালিকায়! সবজি থেকে শুরু করে দা-বটি, গৃহস্থালী পণ্য, জামা কাপড় এমনকি অন্তর্বাস পর্যন্ত সবকিছু বিক্রির জন্য আনেন তারা। কিনে নেন পুরোনো হাড়ি পাতিল, কাপড়, জুতা, শ্যাম্পু, সেন্টের খালি বোতল থেকে শুরু করে কম্পিউটার ল্যাপটপ পর্যন্ত সবকিছু। গ্যাসের চুলা থেকে শুরু করে বেতের সোফা-টেবিল সারাইয়ের কাজও খোঁজেন তারা। এই কাজ খোঁজা, পুরোনো জিনিস কিনে নেওয়া আর নতুন জিনিস বিক্রি করার জন্য তারা হেঁকে হেঁকে পথ হাটেন, নগরবাসীর কান পর্যন্ত পৌঁছানোর চেষ্টা করেন। এই হাঁক ছাড়ার ক্ষেত্রে খালি গলার সাথে যুক্ত হয়েছে ছোট মাইক্রোফোন অর্থাৎ হ্যান্ড মাইক।
ফেরি করে জিনিস বিক্রি অনেক পুরোনো একটি ব্যবসায়িক ধারণা। পণ্য নিয়ে গ্রাহকের দোড়গোড়ায় পৌঁছানোর চল আছে বহু আগে থেকেই। সামাজিক সভ্যতার সাথে জড়িয়ে আছে ফেরি করে জিনিস বিক্রির ঐতিহ্যবাহী ইতিহাস। অতীতে যারা ফেরি করে জিনিস বিক্রি করতেন তাদের বলা হতো নিলামওয়ালা। এক শতাব্দী আগে অর্থাৎ ১৮০০ শতকে তারা পরিচিতি পান কাবুলিওয়ালা হিসেবে। ১৯০০ শতকের শুরু থেকে এই শ্রেণির ক্ষুদে ব্যবসায়ীরা পরিচিত হয়ে ওঠেন ফেরিওয়ালা হিসেবে। ফেরি করে পণ্য বেচাকেনা করেন, এমন আলাদা জাতি বা গোষ্ঠীই আছে। এদের মধ্যে আছেন বেদে, সান্দার, টুকরা, মাছুয়া। সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, কিশোরগঞ্জ ও জামালপুর জেলা সদরে বিপুল সংখ্যায় সান্দার বাস করেন। জামালপুর শহরে সান্দার পাড়া নামে আলাদা একটি পাড়াই আছে যেখানে কেবল সান্দাররাই বাস করেন।
বেদে, সান্দার, টুকরা বা মাছুয়া গোষ্ঠীর মানুষরাই কেবল ফেরি বা হকারির কাজে যুক্ত তা নয়, সারা দেশে এ কাজে যুক্ত আছেন বিপুল সংখ্যক মানুষ। তবে ফেরির জন্য সবচেয়ে সুবিধার জায়গা রাজধানী ঢাকা। এ কাজটি রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে ঘুরে করতে হয় বিধায় পথ হাটার পরিশ্রম রয়েছে। আরো আছে বোঝা বহনের কষ্ট। ফলে অল্প পথ হেঁটে বেশি ফায়দা- এই ফর্মুলায় কাজ করার উপযুক্ত স্থান ঢাকা নগরী।
সব ব্যবসারই মরসুম বা মৌসুম আছে। ফেরিওয়ালাদের মতে, তাদের কাজের উপযুক্ত মৌসুম শীতকাল। এর মধ্যে ডিসেম্বর, জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি সবচেয়ে ভালো সময়। এ সময় বিক্রি বেশি হয়। রাজধানীর গৃহীনিদের মন-মেজাজ এই সময়টাতে বেশ ফুরফুরে থাকে, জিনিস কেনার প্রতি আগ্রহ থাকে। ফেরির জিনিসের ক্রেতা বেশির ভাগ নারী। তা ছাড়া এ সময়টাতে গ্রামে কৃষি কাজ কম। তাই অনেক বেকার কৃষি শ্রমিক খণ্ডকালীন কাজ হিসেবে হকারি করে দু’পয়সা আয় করেন। তাছাড়া শীতের সময় জিনিস বহন ও রাস্তা হাটায় ঘাম ঝরে না- এটা বাড়তি সুবিধা। এ কারণে অক্টোবর-নভেম্বর মাস থেকে রাজধানীতে হকার বেড়ে যায়। মার্চ-এপ্রিল মাসে এসে আবার এই মৌসুমি হকারের সংখ্যা কমে যায়। হকার সবচেয়ে বেশি থাকে ডিসেম্বর, জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে।
রাজধানীর গ্রিনরোডে কাঁঠালবাগান এলাকার গৃহীনি উম্মে জাহানারা জানান, তিনি বেশিরভাগ সময় সবজি কেনেন হকারের কাছ থেকেই। এতে কাঁচা বাজারে যাওয়া আসার ঝামেলা ও সময় দুইই বাঁচে। এ ছাড়া অনেক সময় বিভিন্ন জিনিসপত্রও কেনা হয় ফেরিওয়ালার কাছ থেকে। বিশেষ করে অ্যালুমিনিয়ামের জিনিসপত্র হকারের কাছ থেকেই কেনা হয়।
রাজধানীর মোহম্মদপুরে চাঁন মিয়া হাউজিং সোসাইটির ৩ নম্বর রোডের বাসিন্দা গৃহীনি মর্জিনা আফরোজ কেয়া বলেন, ‘শাক-সবজি প্রায় সবই আমি হকারের কাছ থেকেই কিনি। এখান থেকে কাঁচাবাজার একটু দূরেই হয়। সাহেব থাকেন অফিসে, বাচ্চারা কলেজে ইউনিভার্সিটিতে। একলা সামলে ওঠা বেশ কঠিন। তাই হকারই আমার ভরসা।’
মোহম্মদপুর শেখের টেক ২ নম্বর রোডের বাসিন্দা আব্দুল আজিজ বলেন, ‘হকারি তো এখন ডিজিটাল হয়ে গেছে। আজকাল আমাদের সময় মেলে না। আমরা বাসার সামনে হকারের কাছ থেকে জিনিস নেই। ইন্টারনেটের মা্ধ্যমে ই-শপ অর্থাৎ ইলেকট্রনিক মার্কেটপ্লেস থেকেও কেনাকাটা করি। তিনি রসিকতা করে বলেন, ‘ইন্টারনেট হকারদের কল্যাণে সময় বেঁচে যায়, ঝক্কিও পোহাতে হয় না।’
মোহম্মদপুরে আবাসিক এলাকায় ফেরি করে সবজি বিক্রি করেন আলিম শেখ। তার বাড়ি নওগাঁ জেলার বদলগাছি উপজেলায়। বেশ কিছুদিন সৌদি আরবে ছিলেন। দেশে ফিরে এটা সেটা করে লোকসান গুণে এখন পথে এসে দাঁড়িয়েছেন। ঢাকায় আছেন ৫ মাস। ঢাকা উদ্যান এলাকায় মেসে থাকেন। সাইকেল ভ্যানে সবজি নিয়ে সকাল সাড়ে ৭টায় বেরিয়ে পড়েন। আবাসিক এলাকায় গলিতে ঢুকে ৮টার দিকে প্রথম হাঁক ছাড়েন।
উচ্চ মাধ্যমিক পাস আলিম জানান, তিনি দিনের প্রথম ভাগে বেলা ১টা পর্যন্ত এ কাজ করেন। রয়ে যাওয়া সবজি নিয়ে বেলা ৪টার দিকে আবার বের হন এবং কোন এক মোড়ে ভ্যান নিয়ে দাঁড়িয়ে রাত ১১টা পর্যন্ত বিক্রি করেন। এভাবে সপ্তাহে চার দিনের বেশি কাজ করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। তিনি ও তার এক সহপাঠী বন্ধু এ কাজে যুক্ত আছেন। এই ফেরি থেকে তার ঢাকায় থাকা খাওয়াসহ সব খরচ বাদ দিয়ে মাসে বিশ হাজার টাকার মত থাকে। সেটা তিনি গ্রামে পাঠিয়ে দেন।
ফেরি করে মাছ বিক্রি করেন সেলিম আহমেদ। তিনি দীপনগর আড়ৎ থেকে মাছ কেনেন এবং মোহম্মদপুর এলাকায় বিক্রি করেন। প্রায় তিন বছর ধরে তিনি এ কাজে যুক্ত আছেন। সেলিম বলেন, তিনি ভালোই আছেন, দিন শেষে চারশ-পাঁচশ টাকা লাভ রয়ে যায়।
দা-বটি ও লোহায় তৈরি গৃহস্থালী পণ্য ভ্যানে নিয়ে ফেরি করে বিক্রি করেন বিমল কান্তি দাস। তিনি জানান, তিনি ৫ বছর ধরে এই কাজ করছেন। কারওয়ান বাজারে মহাজনের কাছ থেকে জিনিস নেন। একেক দিন একেক এলাকায় গিয়ে এগুলো বিক্রি করেন। বিক্রিও ভালোই হয়। এই রাজধানীতে পরিবার নিয়ে ভালোই আছেন।
মন্তব্য চালু নেই