ফিরে দেখা ২০১৪ : ১০টি আত্মহত্যায় বেশামাল ছিল রাউজান
চট্টগ্রামের রাউজানে ২০১৪ সালে আলোচ্য ঘটনার মধ্যে ১০টি আত্মহত্যা ছিল টক অব দ্যা কান্ট্রি। গেল সালটিতে রাউজানে একের পর এক আত্মহত্যার ঘটনায় বেশামাল ছিল থানা প্রশাসন।
স্থানীয় ও জাতীয় পত্রিকায় একেক আত্মহত্যার ঘটনার সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর পর শিউরে উটত সারাদেশের মানুষ। এসব আত্মহত্যার পেছনে ছিল আর্থিক টানাপোড়ন, প্রেম সংঘটিত ঘটনা, পারিবারিক কলহ ইত্যাদি। ২০১৪ সালটিতে পাল্লা দিয়েই যেন আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছিল। এই সব আত্মহত্যার ঘটনাতে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিও বাদ যায়নি।
২০১৪ সালের এমনই অনেক পারিবারিক হত্যাকাণ্ডের খবর ফলাও করে প্রকাশিত হয়েছে দেশের অনলাইন ও প্রিন্ট সংবাদপত্র এবং বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে। নিজেদের মধ্যে বনাবনির অভাব, সম্পত্তির বিরোধসহ সামাজিক অবস্থার অবনতির কারনে উপজেলায় অপরাধ কর্মকান্ড ঘটেছিল বলে থানা পুলিশ ও সংশি¬ষ্ঠ মহল মনে করছে।
বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য জানা যায়, ২০১৪ সালের (জুলাই থেকে অক্টোবর) খুনের ঘটনা ঘটেছে ৬টি। আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে আটটি। রহস্যজনকভাবে মারা গেছে দুই গৃহবধূ। এরমধ্যে দুই প্রেমিক-প্রেমিকা একসাথে ঝুলে আত্মহননের ঘটনাও ঘটে। এছাড়া তিনজনের পরিত্যক্ত লাশ উদ্ধার হয়েছে উপজেলা থেকে। এমন ঘটনা ঘটায় মানুষ কতটা নিরাপদ- এ প্রশ্ন উঠছিল জনমনে। সমাজবিজ্ঞানী ও মানবাধিকারকর্মীরা এসব ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে এর জন্য সামাজিক অস্থিরতা ও অবক্ষয়কে দায়ী করেছেন।
উন্নত জীবনের হাতছানি, পরকীয়া, বহুবিবাহ, হতাশা, পারিবারিক ভগ্নদশা, বিবাহবিচ্ছেদ, বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ, দাম্পত্য কলহ, উন্নত জীবনের হাতছানি, অর্থের লোভ, মাদকাসক্তি, দারিদ্র্যসহ বেশকিছু কারণে এসব ঘটনা বাড়ছে বলে জানিয়েছেন বিশেজ্ঞরা। এলাকার সচেতন মহল জানিয়েছে পরকিয়া প্রেম, স্বামী ও শ্বশুর পরিবারের সাথে বনাবনি না হওয়ার কারনে গৃহবধূকে খুন এবং আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়েছে। এরকম সামাজিক অস্থিরতা কমানোর জন্যে সামাজিক সচেতনতা গড়ে তোলার পাশাপাশি মসজিদের ইমাম, স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা শিক্ষক ও রাজনীতিবিদদের ভূমিকা দরকার বলে মনে করছে সচেতন মহল।
২০১৪ সালে পারিবারিক হত্যাকান্ডের ঘটনায় ছিল এমন- গত ঈদুল আযহার দিন রাতে উপজেলার চিকদাইর ইউনিয়নে স্বামীকে নির্মমভাবে হত্যার পর নিজ ঘরেই মাটিচাপা দেন এক স্ত্রী। নিহত স্বামীর নাম দুদু মিয়া (৩৩)। হত্যাকা-ের ১০ দিন পর ২০১৪ সালের ১৬ আগস্ট বৃহস্পতিবার সকালে রাউজান থানা পুলিশ চিকদাইর ইউনিয়নের দক্ষিণ সর্তার সুনিত্তে পাড়া গ্রামের নিজ ঘরের মেঝে খুঁড়ে দুদু মিয়ার লাশ উদ্ধার করে। এ ঘটনায় গ্রেপ্তার করা হয় তার স্ত্রী শাহনাজ বেগমকে (২৬)।
২৪ সেপ্টেম্বর নোয়াজিষপুরে বনিবনা না হওয়ার জের ধরে বিয়ের ২১ দিনের মাথায় নববধূ রিমা আকতারকে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করে ফ্যানের সাথে ঝুলিয়ে দেয় স্বামী আবু বক্কর, মা সেলিনা আকতার ও মামী পারভিন আকতার।
৯ অক্টোবর পাহাড়তলীর ভাড়া বাসায় রহস্যজনকভাবে মারা যায় চুয়েট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে স্কুল শিক্ষিকা সুবর্ণা বড়–য়া। এই ঘটনাকে স্বামী হাতে খুন বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। স্বামী চন্দন বড়ুয়া গ্রেপ্তার হয়।
১৩ জুলাই রাতে রাউজান পৌরসভার ছিটিয়াপাড়ায় নিজ বসতঘরে জায়গার বিরোধের জের ধরে নিজের বোন হালিমা আকতারকে জবাই করে হত্যা করে ছোট বোন জান্নাতুল ফেরদৌস।
২০ জুলাই গভীর রাতে ঘর থেকে বের হয়ে পাশ্ববর্তি হাটহাজারির নাঙ্গলমোড়া এলাকায় গেলে সেখানে রহস্যজনক গুলিতে খুন হন রাউজান নোয়াজিষপুর ইউপির ৭নং ওয়ার্ডের মেম্বার আনোয়ার হোসেন প্রকাশ জসিম।
৩১ জুলাই রাতে পাহাড়তলী ইউনিয়নের ঊনসত্তরপাড়া গ্রামের সন্দ্বীপ পাড়ায় নব বিবাহিত স্ত্রীকে ঘরে তুলে না নিয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করার প্রতিবাদ করায় স্বামী, দেবর ও বোনেরা মিলে পিটিয়ে হত্যা করে প্রথম স্ত্রীর মা বিবি হাজেরা বেগম (৪৫) কে।
২১ আগষ্ট চিকদাইর দক্ষিন সর্তায় শ্বশুর বাড়িতে স্বামী লিটন চৌধুরী বাপ্পি ও তার পরিবারের হাতে খুন হয় অন্তঃসত্ত্বা গৃহবধূ পিংকি মুহুরী (১৯)।
৩০ জুন হলদিয়ায় উত্তর সর্তা মনুপেটান তালুকদার বাড়ির পাশে ক্ষতবিক্ষত লাশ উদ্ধার করা হয় মাদ্রাসা ছাত্র হাফেজ রাকিব উদ্দিন (১২)’র। আগস্ট মাসের শেষের দিকে পশ্চিম গুজরা ইউনিয়নের মীরধার পাড়া এলাকার মৃত আহমদ মিয়ার পুত্র আল-হেলাল ফুট বেকারীর খাদ্যদ্রব্য পরিবেশক মোবারক আলী (৩৪)’র লাশ পাওয়া যায় পাহাড়তলী ইউনিয়নের বদুপাড়া এলাকায়।
২৫ আগস্ট সকালে পশ্চিম গুজরা ইউনিয়নের উত্তর গুজরা গ্রামের একটি বিলে পাওয়া যায় ইদ্রিচ আলী (৫০) নামের এক পড়ে থাকা ব্যক্তির লাশ। আগস্ট মাসে উপজেলা সদরের মুন্সিরঘাটায় মুনির বেকারীর মোহাম্মদ আজগর (২৫) নামের এক যুবক গুলিবিদ্ধ হয়।
১৬ সেপ্টেম্বর রাতে নিজ ঘরের কিচেন রুমে ফাঁসিতে ঝুলে রহস্যজনকভাবে আত্মহত্যা করে পাহাড়তলীর শেখপাড়ার ব্যবসায়ী আবুল হাশেম। এই মৃত্যু নিয়ে রহস্য ধাঁনা বাঁধে।
২৩ সেপ্টেম্বর বিকেলে পাহাড়তলী ইউনিয়নের দুর্গম পাহাড়ী এলাকায় বিয়েতে মা-বাবা রাজি না হওয়ায় একই ওড়নায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করে মো. হাছান ও জান্নাত নামের দুই প্রেমিক-প্রেমিকা। আগস্ট মাসে ডাবুয়া ইউনিয়নের হিংগলায় শামসুন নাহার নামের ছয় মাসের অন্তস্বর্ত্তা গৃহবধুর রহস্যজনক মৃত্যু হয়। বাবার পরিবারের দাবি ছিল এটি হত্যাকান্ড। আর শ্বশুর বাড়ির পরিবারের দাবি ছিল এটি আত্মহত্যা।
২৪ আগস্ট অনুমান ৫টার দিকে কদলপুর ইউনিয়নে আরমান (১৩) নামের ৬ষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র ফাঁসিতে ঝুলে আত্মহত্যা করে। এর আগে কদলপুর খলিফাপাড়া এলাকায় রোকসানা আকতার (৬০) নামের এক মহিলা বিষপানে আত্মহত্যা করে।
১৫ সেপ্টেম্বর বিষপান করে নোয়াপাড়ার মো. মুরাদ নামের এক যুবক।
১৭ সেপ্টেম্বর চিকিৎসাধীন অবস্থায় হাসপাতালে মারা যায় সে। এরপর আত্মহত্যার ঘটনাটি ঘটে গত ১১ অক্টোবর বিকেলে কদলপুরের লস্করদীঘি পাড়ের পূর্ব পাশে। সেখানে রহস্যজনকভাবে আবদুর শুক্কুর (৩৫) নামের এক ব্যক্তি বিষপানে আত্মহত্যা করে।
অক্টোবরে বেতবুনিয়ার গুচ্ছগ্রামের সিএনজি চালক আবদুল হামিদ (৪৫) ঘরের ছাদের সাথে গলায় রশি লাগিয়ে আত্মহত্যা করে। সর্বশেষ যে আত্মহত্যার ঘটনাটি ছিল ডাবুয়া ইউনিয়নের ইউপি সদস্য পুতুল মল্লিক প্রকাশ ধনা । সে বাড়ীর পাশে পুকুড় পাড়ে একটি গামারী গাছের সাথে গলায় রশি লাগিয়ে আত্মহত্যা করে। তার আত্মহত্যাটি ছিল আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে।
এরপর নতুন ২০১৫ সাল ঢুকতে গত ১৩ই জানুয়ারী নোয়াজিষপুর এলাকায় গলায় রশি লাগিয়ে আত্মহত্যা করে নতুন হাট বাজারের ব্যবসায়ী মোহাম্মদ ইউছুপ (৬৭)। সেও আর্থিক অভাব অনটনের কারনে আত্মহত্যা করেছে।
এদিকে আত্মহত্যা ও নারী ঘটিত কারন সর্ম্পকে উপজেলা নির্বাহি কর্মকর্তা কূলপ্রদীপ চাকমা বলেন ‘সামান্য ঝগড়া-ঝাটি হলেই মানুষ নারী নির্যাতন আইনে মামলা ঠুকে দেয়। অথচ এই ধরনের সামাজিক অপরাধের অভিযোগ উপজেলা নির্বাহি কর্মকর্তার কাছে পাঠালে তা সমাধানযোগ্য হয়। কিন্ত তা না করে মামলা করে দিলে তা নিস্পত্তির সুযোগ থাকেনা। একারনে আত্মহত্যা, হত্যাসহ বিভিন্ন সামাজিক অপকর্মগুলো হচ্ছে। এজন্যে সবাইকে সজাগ থেকে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।
মন্তব্য চালু নেই