ফিরে দেখা : মডেলকন্যা তিন্নি হত্যাকান্ড ও সাংসদ অভি স্ক্যান্ডাল

[ঘটনাটি ঘটেছে এখন থেকে প্রায় ১৩ বছর আগে। ২০১০ সালের দিকে বাংলাদেশ প্রতিদিনে যে ফলো-আপ প্রতিবেদন ছাপা হয় সেটি পাঠকদের জন্য আমরা প্রকাশ করলাম]

১১ নভেম্বর, ২০০২ সাল। সকাল ৮টা। বুড়িগঙ্গা নদীর বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতুর নিচে পিলারের উঁচু জায়গায় অজ্ঞাতনামা এক যুবতীর লাশ। কয়েকজন মানুষের ভিড়। শ্যামপুর থানার এসআই গোলাম মাওলাসহ কয়েকজন পুলিশ সদস্যও হাজির হলেন। ঘটনাস্থল কেরানীগঞ্জ থানা এলাকায় হওয়ায় বিষয়টি বেতার মারফত কেরানীগঞ্জ থানাকে জানানো হয়।

সকাল সোয়া ১০টার দিকে কেরানীগঞ্জ থানার এএসআই মো. শফিউদ্দিন ঘটনাস্থলে এসে লাশটি নদীর তীরে তোলেন। সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করেন। ময়নাতদন্তের জন্য মিটফোর্ড হাসপাতালের মর্গে লাশ নিয়ে যান। ময়নাতদন্ত শেষে দাবিদার না থাকায় বেওয়ারিশ হিসেবে লাশটি আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম কর্তৃক জুরাইন কবরস্থানে দাফন করা হয়।

লাশে জখমের চিহ্ন : সুরতহাল রিপোর্ট তৈরির সময় পুলিশ লাশের শরীরের বিভিন্ন অংশে থেঁতলানো জখম দেখতে পায়। মাথার খুলিতে ভোঁতা অস্ত্রের আঘাত দেখতে পায়। আঘাতের চিহ্ন দেখে পুলিশ নিশ্চিত হয়, এটি কোনো হত্যাকাণ্ড।

মামলা : এএসআই শফিউদ্দিন ওইদিন দুপুরে কেরানীগঞ্জ থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। মামলায় কাউকে আসামি করা হয়নি। মামলায় সন্দেহ করা হয়, আগের দিন রাতের আঁধারে অজ্ঞাতনামা তরুণীকে হত্যা করে লাশ গোপন করার জন্য বুড়িগঙ্গা সেতুর নিচে ফেলে দেওয়া হয়েছে।

কে জানত লাশটি তিন্নির : লাশটি মডেল তারকা তিন্নির তা কেউ জানত না। মিটফোর্ড হাসপাতালের মর্গ থেকে লাশটি আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের কাছে হস্তান্তরের সময় তুলে রাখা ছবি ২০০২ সালের ১৬ নভেম্বর দৈনিক জনকণ্ঠে ছাপা হয়। পত্রিকায় ওই ছবি দেখে আত্দীয়-স্বজন লাশটি তিন্নির ছিল বলে শনাক্ত করেন। তিন্নির চাচা সৈয়দ রেজাউল করিম কেরানীগঞ্জ থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। পত্রিকায় ছবি প্রকাশ না হলে হয়তো কেউ কোনোদিন জানত না লাশটি কার। কবর থেকে লাশ আবার তোলা হয়। আত্মীয়স্বজনও তিন্নির লাশ শনাক্ত করেন।

কে তিন্নির হত্যাকারী : তিন্নিকে কে হত্যা করতে পারে_মামলা হওয়ার পর তদন্ত কর্মকর্তার সামনে সেটিই উদ্ঘাটন ছিল মূল কাজ। তিনি্নর বাসার কাজের মেয়ে বিনা, গাড়ির চালক ও অন্যদের জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ নিশ্চিত হয় এক সময়কার প্রভাবশালী ছাত্রনেতা, সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম ফারুক অভি তিন্নিকে হত্যা করে লাশ গোপন করার চেষ্টা করেন।

কেন এই হত্যাকাণ্ড : মডেল কন্যা সৈয়দা তানিয়া মাহবুব তিন্নির সঙ্গে অভির পরিচয় হওয়ার পরই সখ্য গড়ে ওঠে। এক পর্যায়ে তাঁদের মধ্যে দৈহিক সম্পর্ক তৈরি হয়। তাঁরা দেশ-বিদেশে একত্রে ঘুরে বেড়ান। তিন্নি ছিলেন বিবাহিত। অভির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কারণে তিনি্নর সঙ্গে স্বামী শাফকাত হোসেন পিয়ালের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। ২০০২ সালের ৬ নভেম্বর অভি নিজে তিনি্ন ও তাঁর স্বামী পিয়ালের দাম্পত্য জীবনের অবসান ঘটান। এমনকি তিনি্নর দেড় বছরের শিশুকন্যাকে পিয়ালের হেফাজতে দিয়ে পিয়ালকে বাসা থেকে বের করে দেন অভি। অভি ওই বাসায়ই অবস্থান নেন।

দুর্ধর্ষ ও সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত অভি গোপনে তিন্নির সঙ্গে অবৈধ দৈহিক সম্পর্ক নিয়েই আগ্রহী ছিলেন। তিন্নিকে বিয়ে করে সামাজিক মর্যাদা দেওয়ার ইচ্ছা তাঁর ছিল না। কিন্তু তিনি্ন এ বিষয়েই অভির ওপর চাপ সৃষ্টি করতে থাকেন।

এদিকে পিয়ালের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি ও তিন্নির সঙ্গে অভির সম্পর্কের বিষয়টি মিডিয়ায় প্রচার হতে থাকে। ঠিক ওই মুহূর্তে অভি খুন করার পরিকল্পনা করেন তিনি্নকে। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী অভি ২০০২ সালের ১০ নভেম্বর সন্ধ্যার পর তিন্নিকে মাথায় আঘাত করে হত্যা করেন। লাশ গুম করার জন্য গাড়িতে করে নিয়ে বুড়িগঙ্গা সেতুর নিচে ফেলে রাখেন। লাশ গোপন করার পর অভি তিন্নির আত্দীয়স্বজনকে অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে হুমকি দেন।

অন্যদিকে লাশের ছবি পত্রিকায় প্রকাশের পর অভি পলাতক হন। একসময় তিনি দেশ থেকে পালিয়ে যান। এখনো পলাতক রয়েছেন অভি।

তিন্নি হত্যার আসামী গোলাম ফারুক অভি
শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমনের তথ্য : রাজধানীর শীর্ষ সন্ত্রাসী সানজিদুল ইসলাম ইমন গ্রেপ্তারের পর তিন্নি হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তাকে জানায়, অভি তিনি্নকে হত্যার পর প্রথমে ভারতে যান। সেখানে গিয়ে কানাডা যাওয়ার চেষ্টা করেন।

ইমনের সঙ্গে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে তদন্ত কর্মকর্তা দেখা করলে তাঁকে ইমন জানায়, ২০০২ সালে ইমন ভারতে পলাতক ছিল। সেখানে তার অভির সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। অভি ইমনকে সব কিছু খুলে বলেন। তিনি বলেন, তিনি্নর সঙ্গে তাঁর দৈহিক মেলামেশা ছিল। তিন্নি তাঁকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। অভি রাজি হননি। তিন্নির বিষয়টি মিডিয়ার কাছে ফাঁস করে দেওয়ার হুমকি দেন। তাই অভি তাঁকে খুন করে লাশ গাড়িতে করে নিয়ে বুড়িগঙ্গা সেতুর নিচে ফেলে দেন।

বর্তমান অবস্থা—
অভিনেত্রী ও মডেলকন্যা সৈয়দা তানিয়া মাহবুব তিনি্ন হত্যা মামলার বিচারকাজ দীর্ঘ আট বছরেও শেষ হলো না। নানা অজুহাতে সাক্ষী আদালতে হাজির না হওয়ায় বিচারকাজ পিছিয়ে যাচ্ছে।

তিন্নির বাবা সৈয়দ মাহবুব করিম গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, দীর্ঘ আট বছরেও আলোচিত এ হত্যাকাণ্ডের বিচার পাওয়া গেল না। আদৌ নিরপেক্ষ ও সঠিক বিচার পাওয়া যাবে কি না তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।

তিনি জানান, মামলার শুনানি এ পর্যন্ত অসংখ্যবার পিছিয়েছে। সাক্ষীরাও অজ্ঞাত কারণে আদালতে হাজির হন না। রহস্যজনকভাবে তিনি্নর স্বামী শাফকাত হোসেন পিয়ালকে বেকসুর খালাস দেওয়া হয়েছে। মামলায় বর্তমানে একমাত্র আসামি সাবেক এমপি গোলাম ফারুক অভিও ধরাছোঁয়ার বাইরে।

মাহবুব করিম আরও বলেন, মামলা ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে একটি মহল এখনো নানা ষড়যন্ত্র করছে। তিনি্ন হত্যাকাণ্ডের পরপরই এমপি অভি দেশত্যাগ করলেও আট বছরে দুইবার দেশে এসেছিলেন। কিন্তু পুলিশ তাকে গ্রেফতার করতে পারেনি। বিদেশ থেকে অভিকে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য সরকার কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।

আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু বিচার দ্রুত সম্পন্ন করার জন্য সরকারের কাছে তিনি আহ্বান জানান। মৃত্যুর ১১ দিন পর কবর থেকে তার লাশ তোলা হয়। এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে একটি হত্যা মামলা করে। ওই সময় এ হত্যাকাণ্ডটি ব্যাপক আলোচিত হওয়ায় মামলাটি পুনঃতদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডিকে। দীর্ঘদিন তদন্ত শেষে সিআইডি ২০০৮ সালে একমাত্র আসামি হিসেবে অভির নামে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয়। সিআইডি মামলাটি তদন্তের সময় তিনি্নর কর্মকাণ্ডের নানা গোপন তথ্য পায়। এমনকি ওই সময় তিন্নি ও সাবেক এমপি অভির পরকীয়া সম্পর্কের চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসে।

মামলাটি পরিচালনাকারী সরকারি আইনজীবী (পিপি) অ্যাডভোকেট রুহুল আমিন জানান, মামলাটি বর্তমানে সপ্তম অতিরিক্ত জেলা জজ মিজানুর রহমান খানের আদালতে বিচারাধীন। তিন মাস আগে আদালত শুনানির চার্জ গঠন করেন। এরপর কয়েকবার সাক্ষীদের সমন জারি করার পরও তারা কেউ হাজির হননি।

২২ নভেম্বর ফের সাক্ষীদের আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।অভিযোগপত্রে বলা হয়, অভি এখন কানাডায় রয়েছেন। ‘৯২ সালে রমনা থানায় দায়ের করা একটি অস্ত্র মামলায় ১৭ বছর সশ্রম কারাদণ্ডের রায়ের পর হাইকোর্ট থেকে জামিন নিয়ে তিনি দেশ থেকে পালিয়ে যান। ২০০৭ সালের ২৬ ফেব্র”য়ারি তার বিরুদ্ধে এ মামলার ঘটনায় রেড অ্যালার্ট জারি করা হয়।
হত্যার ব্যাপারে তিন্নির দুই গৃহপরিচারিকার ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি নেওয়া হয়।

গত ১৪ জুলাই অভিকে পলাতক দেখিয়ে তার অনুপস্থিতিতে মামলায় অভিযোগ গঠন করে ১৬ অগাস্ট এবং পরে ১৯ সেপ্টেম্বর এবং ১৯ অক্টোবর সাক্ষ্য গ্রহনের জন্য দিন নির্ধারণ করনে মিজানুর রহমান খান।

আভিযোগে বলা হয়, অভি ওই হত্যাকাণ্ডের আগে তিন্নির স্বামী পিয়ালের সঙ্গে তার দাম্পত্য সম্পর্কের অবসান ঘটিয়ে তাকে ফাঁদে ফেলে অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলেন। তবে অভি তাকে কখনোই স্ত্রীর মর্যাদা দেননি। বরং বিয়ের জন্য তিন্নি অভিকে চাপ দিলে পূর্বপরিকল্পিতভাবে তিন্নিকে খুন করে গড়িতে করে তার লাশ চীন মৈত্রী সেতুর নিচে ফেলে রাখেন।

হাইকোর্ট এক মাসের জন্য মডেল ও অভিনেত্রী সৈয়দা তানিয়া মাহবুব তিন্নি হত্যা মামলার বিচার স্থগিত করেছে। চলতি বছরের গত ২৩ জুন হাইকোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চ মামলাটি এই স্থগিতাদেশ দেন।

মামলার একমাত্র ও পলাতক আসামি সাবেক এমপি গোলাম ফারুক অভির পক্ষে হাইকোর্টে আবেদন করা হলে এক মাসের জন্য মামলার কার্যক্রমের ওপর স্থগিত আদেশ দেয়া হয় বলে জানিয়েছে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী শাহ ইলিয়াস রতন।

রোববার মামলার সাক্ষ্য গ্রহণের ধার্য তারিখে এ কারণে দুজন সাক্ষী সাক্ষ্য দিতে আদালতে আসলেও সাক্ষ্য গ্রহণ করতে পারেননি বিচারক।
ঢাকার সপ্তম অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ ফাতেমা নজীব আগামী ১৪ সেপ্টেম্বর সাক্ষ্য গ্রহণের পরবর্তী দিন ধার্য করেছেন।

২০০৮ সালের ৮ নভেম্বর গোলাম ফারুক অভিকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দাখিল করে সিআইডি। গত বছরের ১৪ জুলাই অভির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। মামলার অভিযোগ প্রাথমিকভাবে প্রমানিত না হওয়ায় অব্যাহতি দেয়া হয় তিন্নির স্বামী পিয়াল সহ ৫ জনকে।
তিন্নি খুনের সাড়ে আট বছর পর গত ১০ এপ্রিল আদালতে সাক্ষ্য দেন তিন্নির বাবা সৈয়দ মাহবুবুল করিম।

মাহবুবুল করিম জবানবন্দিতে বলেন, তিন্নির চিত্রজগতে আসার ইচ্ছা ছিল না। তার স্বামী পিয়ালই তাকে বিভিন্ন কৌশলে এ জগতে আনে। পিয়াল তিন্নিকে প্রতারনার আশ্রয় নিয়ে ব্যাংককে পাঠায় শপিংয়ের জন্য। তিন্নিকে বলা হয় ব্যাংককে বাবু নামে একজন তাকে শপিংয়ে সহায়তা করবে। বাবুই ছিল অভি। এভাবেই পিয়াল মিথ্যাভাবে অভির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়।

ঘটনার পর প্রথমে ভারত পালিয়ে যান অভি। এরপর ভারত থেকে কানাডা। ২০০৪ সালে কানাডায় রাজনৈতিক আশ্রয় নেন তিনি।



মন্তব্য চালু নেই