ফার্মাসিস্ট যেখানে ডাক্তার !
খুলনার দিঘলিয়া উপজেলার সেনহাটি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের (মেডিকেল সাব সেন্টার) মেডিকেল অফিসার ডা. ওমর ফারুক দীর্ঘ নয় বছর ধরে সাময়িক বরখাস্ত রয়েছেন।
প্রশাসনিক কারণে ২০০৭ সালের ১১ জুন কর্তৃপক্ষ তাকে সাময়িক বরখাস্ত করেন। আর এ সুযোগটি পুরোপুরিই কাজে লাগাচ্ছেন ওই কেন্দ্রের ফার্মাসিস্ট মো. আবু সুফিয়ান খাঁন। তিনি এলাকাবাসীর কাছে ‘ডা. মো. আবু সুফিয়ান খাঁন’ নামেই পরিচিত।
বিষয়টি এ প্রতিবেদকের কাছ থেকেই প্রথম জানলেন খুলনায় সদ্য যোগদান করা সিভিল সার্জন ডা. এ এস এম আব্দুর রাজ্জাক।
‘ফার্মাসিস্ট’ কখনই ‘ডাক্তার’ হিসেবে পরিচয় দেওয়া এবং চিকিৎসা করতে পারেন না- উল্লেখ করে তিনি বলেন, খোঁজ-খবর নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তবে দ্রুত ওই কেন্দ্রে মেডিকেল অফিসার পদায়ন করা হবে বলেও জানান তিনি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সেনহাটি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের মেডিকেল অফিসার ডা. ওমর ফারুক বরখাস্ত হওয়ার পর থেকেই ইউনিয়ন স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রে আসা রোগীদের সব ধরনের চিকিৎসাই করে থাকেন ফার্মাসিস্ট আবু সুফিয়ান। রোগী দেখেন, ব্যবস্থাপত্র (প্রেসক্রিপশন) দেন এবং বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরামর্শও দিয়ে থাকেন নিয়মিত। আবার ডায়াগনস্টিক রিপোর্টও দেখেন তিনি।
নামের পাশ থেকে ‘ফার্মাসিস্ট’ পদবী তুলে নিজেকে ‘ডাক্তার’ হিসেবেই পরিচয় দিতে বেশি আনন্দবোধ করেন সুফিয়ান। যথারীতি ‘ডা. মো. আবু সুফিয়ান খাঁন’ নামে সিল তৈরি করে তা ব্যবস্থাপত্রে ব্যবহারও করছেন তিনি। এভাবেই ইউনিয়ন স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রের ‘বড়’ চিকিৎসক হিসেবে নিজেকে জাহির করে বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের কাছ থেকে মোটা অংকের অর্থ এবং ফিজিশিয়ান স্যাম্পল ও অন্যান্য সুবিধাও গ্রহণ করছেন তিনি।
সম্প্রতি ওই কেন্দ্রে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ফার্মাসিস্ট আবু সুফিয়ান চেম্বারে বসে রোগী দেখছেন। রোগী দেখার পর যথারীতি সাদা কাগজে সিল স্বাক্ষর করে ব্যবস্থাপত্রও দিচ্ছেন। রোগীরাও বিষয়টি না বুঝে ডাক্তার ভেবে তার কাছ থেকে পরামর্শ নিচ্ছেন। তার পরামর্শ অনুযায়ী কয়েকজন রোগী ডায়াগনস্টিক রিপোর্ট নিয়ে এলে তিনি রিপোর্ট দেখে তাদের ওষুধও লিখে দিলেন।
ফরমাইশখানা গ্রামের বৃদ্ধ রোগী মো. ইয়ার আলী মাথায় ঘা জনিতকারণে তার কাছে এলে তিনি এন্টাসিড এবং ইন্ডোমেটাসিন সেবনের পরামর্শ দেন।
সেনহাটি মদিনা মসজিদ এলাকার গৃহবধূ নিপা বেগম মেয়েলী সমস্যা নিয়ে এলে তাকে আয়রণ ট্যাবলেট এবং এ্যালার্জিও ওষুধ সেবন করতে বলেন।
কিশোরী মুর্শিদা খাতুনকেও এভাবে ওষুধের ব্যবস্থাপত্র দিতে দেখা যায়। ফার্মাসিস্ট আবু সুফিয়ান এভাবে প্রতিদিন কমপক্ষে ৬০ থেকে ৭০ জন রোগীর চিকিৎসা দিয়ে থাকেন বলে তিনি নিজেই দাবি করেন।
অভিযোগ আছে, সেনহাটি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে কোনো মেডিকেল অফিসার গেলে ফার্মাসিস্ট আবু সুফিয়ান কৌশলে বিভিন্ন অভিযোগ দিয়ে সেখান থেকে তাকে চলে যেতে বাধ্য করেন।
এর কারণ হিসেবে সূত্র বলেছে, মেডিকেল অফিসার না থাকলে বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের কাছ থেকে মোটা অংকের অর্থ, ফিজিশিয়ান স্যাম্পল ও অন্যান্য সুবিধা এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষা বাবদ বিভিন্ন প্যাথলজি থেকে মোটা অংকের কমিশন পান ফার্মাসিস্ট আবু সুফিয়ান। এছাড়া তার বিরুদ্ধে স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রের সরকারি ওষুধ বিক্রিরও অভিযোগ রয়েছে।
রোগী দেখা অবস্থায় হঠাৎ সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে কিছুটা বিব্রতকর অবস্থায় পড়েন ফার্মাসিস্ট আবু সুফিয়ান। তবে রোগীদের বিষয়টি বুঝতে না দিয়ে ভিন্ন প্রসঙ্গে কথা বলেন। আত্মপক্ষ সমর্থন করে প্রথমে তিনি নিজেকে ডিপ্লোমা পাস দাবি করলেও পরে বলেন, ‘আনপাস’ (আংশিক কোর্স) করেছেন। নিজেকে কেন ডাক্তার হিসেবে পরিচয় দিয়ে রোগী দেখছেন- এ প্রশ্নের জবাবে বলেন, মাঝে মধ্যে ২/১টি মেডিকেল রিপোর্ট দেখি, সেজন্য ডাক্তার না লিখলে হয়না, তাই লিখি। তবে এটি করা অপরাধ স্বীকার করে আর করবেন না বলে এ প্রতিবেদককে প্রতিশ্রুতি দেন তিনি।
দিঘলিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা (প.প.) কর্মকর্তা ডা. আতিয়ার শেখ বলেন, ওই কেন্দ্রে চিকিৎসক না থাকায় তিনি রোগী দেখতে পারেন। তবে তিনি ডাক্তারী সিল ব্যবহার করে কোনো প্রেসক্রিপশন দিতে পারবেন না।
মন্তব্য চালু নেই