ফরিদপুরের আকাশ বাতাস ভারী হচ্ছে অন্ধ মায়ের আর্তনাদে

ফরিদপুরের আকাশ বাতাস ভারী হচ্ছে অন্ধ মায়ের আর্তনাদে সবাই যেন তাকে শান্তনা দেওয়ার ভাষাও হারিয়ে ফেলেছে। ফরিদপুর জেলার নগরকান্দা উপজেলার ডাংগী ইউনিয়নের গ্রাম শংকরপাশা এখানেই থাকতেন সোহাগ নামে একটি ছেলে। অবরোধকারীদের পেট্রোল বোমা হামলার শিকার হয়ে জীবন্ত দগ্ধ হয়ে মারা গেছেন তিনি। আর এ গ্রামটিতে গত কয়েকদিন ধরে চলছে শোকের মাতম। গ্রামের ছেলে-বুড়ো থেকে শুরু করে সব বয়সী মানুষ একটি ঘটনায় হতবাক ও স্তম্ভিত হয়ে পড়েছে।

এ গ্রামের প্রতিবন্ধী একটি পরিবারের উপার্জনক্ষম শারিরিক প্রতিবন্ধী এক কিশোর অবরোধকারীদের পেট্রোল বোমা হামলার শিকার হয়ে জীবন্ত দগ্ধ হয়ে মারা গেছে। এ কিশোরটির নাম সোহাগ যার বয়স মাত্র ১৭ বছর। সোহাগের জন্মের ৭ বছরের মাথায় দিনমজুর বাবা সাগর বিশ্বাস মারা যায়। মা সেলিনা বেগম অন্ধ। বাবা মারা যাবার পর নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যদিয়ে নানা দলিলউদ্দিনের বাড়ীতে কোন রকমে দিন কাটছিল তাদের। বুদ্ধি হবার পর থেকেই সোহাগ স্থানীয় বাজারে চায়ের দোকানে কাজ করে সংসারের হাল ধরেছিল। অন্ধ মাকে দেখা শোনা আর সংসারের হাল ধরতে গিয়ে তার পড়ালেখার সুযোগ হয়নি।

গত কয়েক মাস আগে সোহাগ চাকুরী পায় ট্রাকের হেলপারের। এ কাজে যা আয় হতো তা দিয়ে মা-ছেলের সংসার কোন রকমে চলে যাচ্ছিল। কিন্তু গত ১৮ জানুয়ারি প্রতিবন্ধী এ কিশোরটি অবরোধকারীদের পেট্রোল বোমা হামলার শিকার হয়ে মারা যায়। ভোরে বরিশাল থেকে ট্রাকটি সুপারি বোঝাই করে ফরিদপুরে আসছিল। পথিমধ্যে বরিশালের উজিরপুরে দুবৃর্ত্তদের ছুড়ে মারা পেট্রোল বোমায় ট্রাকটিতে আগুন ধরে যায়। ট্রাকের চালক রিপন শেখ লাফিয়ে প্রানে বাঁচলেও গাড়ীতেই পুড়ে কয়লা হয়ে যায় সোহাগ। সোহাগের মর্মান্তিক মৃত্যুর খবর এলাকায় পৌছালে এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারনা হয়। সোহাগের লাশ নিয়ে স্থানীয়রা মিছিল করে। বিক্ষুব্দ লোকজন এ সময় ঢাকা-বরিশাল মহাসড়ক আধ ঘন্টা অবরোধ করে রাখে। এ ঘটনার জন্য দোষীদের শাস্তির দাবী করে মিছিল-

সমাবেশ করে স্থানীয়রা। গত কয়েকদিন ধরে শংকরপাশা গ্রামে সোহাগের বাড়ীতে ভীড় করছে বিভিন্ন স্থান থেকে আসা মানুষজন। তারা জঘন্য ও বর্বর এ ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের ফাঁসির দাবী জানিয়েছেন।

এদিকে, সোহাগের মৃত্যুর পর থেকেই মা সেলিনা বেগমের বুকফাটা আর্তনাদ এলাকার আকাশ-বাতাসকে ভারী করে তুলেছে। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে সে এখন পাগলপ্রায়। কাছে যাকেই পাচ্ছে তাকে ধরেই বলছে, আমার সোনা যাদুরে তোমরা আইন্যা দ্যাও। আমার যাদু আমারে ছাইড়্যা কই চইল্যা গেল। আমি যাদুরে ছাড়া কেমনে বাচুম। আমার যাদুরে পোড়াইয়া কয়লা বানাইয়া দিছে। এইড্যা দেহুম না বইল্যাই আল্লাহ আমারে অন্ধ বানাইছে। আমার সোনারে যারা মারছে তাগোর ফাঁসি চাই। সেলিনার আর্তনাদে চোখের পানি ধরে রাখতে পারছেনা উপস্থিত কেউই। সকলেই শান্তনা দেবার ভাষাও হারিয়ে ফেলেছেন। সোহাগের নানা দলিলউদ্দিনও একজন শারিরিক প্রতিবন্ধী। তিনি নাতিকে হারিয়ে হতবিহবল হয়ে পড়েছেন।

স্থানীয়রা জানান, এ গ্রামের দরিদ্র ব্যক্তি হচ্ছেন দলিলউদ্দিন মন্ডল। তার কন্যা সেলিনা বেগম আজ থেকে বিশ বছর আগে অন্ধ হয়। জ্বরের কারনে সেলিনার দু চোখের দৃষ্টি নষ্ট হয়ে যায়। অন্ধ সেলিনাকে বিয়ে দেয়া হয় যশোর থেকে এ গ্রামে দিনমজুরী করতে আসা সাগর বিশ্বাসের সাথে। বিয়ের তিন বছরের মাথায় জন্ম নেয় শারিরিকভাবে প্রতিবন্ধী সোহাগ। সোহাগের জন্মের ৭ বছর পর তার বাবা মারা যায়। সে সময় থেকেই অন্ধ মাকে নিয়ে শারিরিক প্রতিবন্ধী সোহাগের সংগ্রাম শুরু হয়। গ্রামের চায়ের দোকনে কাজ করে চলতো তাদের সংসার। এভাবেই চলছিল। গত কয়েক মাস আগে চাকুরী পায় ট্রাকের হেলপারের। সোহাগের স্বপ্ন ছিল টাকা জমিয়ে মায়ের চোখ ভালো করবে। কিন্তু সোহাগের সে স্বপ্ন সফল হলো না। দুবৃর্ত্তরা তার সে স্বপ্ন কেড়ে নিলো। সোহাগের করুন মৃত্যুর পর তাদের বাড়ীতে ছুটে গিয়েছিলেন প্রশাসনের কর্তা-ব্যক্তিরা। তারা এ ঘটনার সাথে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবী জানিয়েছেন। সোহাগের দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মা কিভাবে চলবেন সেটাই এখন প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে।

স্থানীয়রা বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই কেবল পারেন অন্ধ সেলিনাকে দু’বেলা খেয়ে পড়ে বাঁচার জন্য কিছু একটা করে দিতে। এদিকে, ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক সরদার সরাফত আলী জানান, সোহাগের মাকে সব রকম সহযোগীতা করবেন তিনি ।



মন্তব্য চালু নেই