প্লিজ, সবার দিকে আঙুল তুলবেন না
অঞ্জন রায় : হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ বাংলাদেশের সকল সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধিত্ব করে না। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি- সব সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্য বলে যে ব্যানারটি ব্যবহার করা হয়- সেই ব্যানার ‘অসাম্প্রদায়িক’ নয়। সেই সংগঠনের নেতা বা অন্য কোনও নেতা কোন সংবাদ মাধ্যমকে কী বলেছেন- সেটা তাদের কথা, দেশের সকল দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকের কথা না।
অপরদিকে তাদের নামে যে বক্তব্যের কথা প্রচারিত হয়েছিল- তারা বলেছেন, তারা ওই ধরনের কথা বলেন নাই। এমন বক্তব্য কোট করে যখন জাতীয় সংসদে কোনও সংসদ সদস্য বক্তব্য দেন, সেই বক্তব্য যখন দেশের দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকদের দিকে প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে ওঠে। আমরা তখনই শঙ্কিত হই। আমি মনে করি যদি দেশের কোনও নাগরিক ‘ভারতের প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ’ করার কথা বলে থাকলে অবশ্যই সেটির তদন্ত হওয়া উচিত- একই সঙ্গে তারা এই ধরনের কথা বলেননি বলে যে বিবৃতি দিয়েছেন সেটি আমলে নিয়ে পিটিআইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা উচিত। কিন্তু সেই বক্তব্যকে পুঁজি করে জাতীয় সংসদে বক্তব্য দিলে দেশের অনিরাপদ মানুষগুলো আরও একবার নিজেদের নিরাপত্তাহীনতায় শঙ্কিত হয়ে ওঠেন।
শনিবার সংসদে প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর সাধারণ আলোচনায় হবিগঞ্জের সংসদ সদস্য আব্দুল মজিদ খানের বক্তব্য, ‘হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ভারতের প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চেয়েছেন। … বাংলাদেশের বিরুদ্ধে তিনি কি উসকানি দিচ্ছেন?’ আমার মনে হয় তার এই প্রশ্নটি কতিপয়ের বিরুদ্ধে হলেও, এই বক্তব্যের থেকে যারা ঘোলা পানিতে মাছ ধরতে নেমেছে তারা সুযোগ নেবে।
আমার সবিনয় প্রশ্ন মাননীয় সংসদ সদস্য জনাব আব্দুল মজিদ খান আপনার কাছে- মানবতাবিরোধী অপরাধে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর রানা দাশগুপ্ত ‘পাকিস্তানপন্থিদের মতো’ কথা বলেছেন বলেও মন্তব্য করেছেন আপনি। তাহলে এই ‘পাকিস্তানপন্থীদের মতো’ লোকটিকে কেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটরের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিলো? সেটার তদন্তেরও দাবি আপনি করুন। কারণ আপনিই বলেছেন-‘বাংলাদেশে থেকে যেভাবে পাকিস্তানের পক্ষে অনেকেই কথা বলেন, তিনি (রানা দাশগুপ্ত) সেভাবেই কথা বলেছেন।’ মনে রাখা দরকার- রানা দাশগুপ্ত এই ধরনের বক্তব্য দেওয়ার খবর অস্বীকার করেছেন। সেটির কি আপনি খোঁজ নিয়েছেন?
আপনি বলেছেন, ‘বিএনপির সময়ে তারা (হিন্দু) দুর্গাপূজা করতে পারতো না। সারা বাংলাদেশের মানুষ তাদের পেছনে ছিল, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা তাদের পেছনে ছিল। আজ তারা স্বাচ্ছন্দে ধর্ম পালন করতে পারে।’ পারে, তবে তারা চাপাতির কোপে যে মরছে- সেটি কি আপনার স্মরণে আছে? আবারও বলছি, অবশ্যই মোদির হস্তক্ষেপ কামনা করলে সেটি দেশবিরোধী উসকানি, আর বিষয়টি গভীরভাবে না দেখে কথা বলাটা সাধারণ মানুষের জন্য আতংকের।
মাননীয় সাংসদ দয়া করে বিষয়টি বুঝবেন আশা করি। দল আওয়ামী লীগের একটা নিজস্ব অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতি রয়েছে। সেই সংস্কৃতির প্রতি দেশের দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকদের রয়েছে আস্থা। তাই যখন মহান জাতীয় সংসদে একজন মাননীয় সংসদ সদস্য কথা বলবেন- তার কাছেও আমরা সেই ভাবনারই প্রতিধ্বনী শুনতে চাই। শুনতে চাই সাধারণ মানুষের আশা জাগানোর কথা। কোনও সাম্প্রদায়িক বেদনাবোধ জাগ্রত হয়- এমন কথা অন্তত তাদের কাছে শুনতে চাই না, শুনতে চায় না বাংলাদেশের কোনও সাধারণ নাগরিক।
আমার বিশ্বাস, সম্মানিত সংসদ সদস্য নিজেই বিষয়টি বুঝবেন- এই টান টান সময়ে তিনি একজন ব্যক্তিকে আক্রমণ করতে গিয়ে একাধিক সম্প্রদায়ের সাধারণ মানুষকে আহত করেছেন- সেটা উপলব্ধিতে এনে আগামী দিনে কথা বলবেন। কোনও অনুরাগ বা বিরাগ নয়- সাদা আর কালোকে সাদা অথবা কালো দেখি বলেই লেখাটি লিখলাম- ব্যক্তিগত আক্রমণ না ভেবে একটু উদার চোখে দেখলেই এই সমস্যা অতিক্রম সম্ভব। কারণ বাংলাদেশের প্রান্তিক মানুষেরা যখন শঙ্কায় আছেন, তখন দায়িত্বশীলদের কাছে আরও সতর্ক বক্তব্য আশা করাটাই সঙ্গত- সেটার অভাব দেখতে চাই না। একজন রানা দাশ গুপ্তকে ধরতে গিয়ে একটি বা একাধিক সম্প্রদায়ের দিকে আঙুল তুলবেন না- এটাই প্রত্যাশা।
শেষে আবারও বলবো, হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ বাংলাদেশের সকল সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধিত্ব করে না। সে কারণেই তাদের যা বলার সেটা তাদের বলুন, এমন তীর ছুড়বেন না- যে তীরে সাধারণ মানুষের বেদনাবোধ জাগ্রত হবে। মাননীয় সংসদ সদস্য, মনে রাখবেন সাধারণ মানুষের কারণেই আপনারা অসাধারণ হতে পারেন।
লেখক: বেসরকারি গণমাধ্যমে কর্মরত
[email protected]
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্ত নিজস্ব। আওয়ার নিউজ বিডি’র সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আওয়ার নিউজ বিডি আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না)
মন্তব্য চালু নেই