প্রশাসনিক পদক্ষেপের ওপরই ভরসা আ’লীগের
চলমান রাজনৈতিক সঙ্কট উত্তরণে প্রশাসনিক পদক্ষেপের ওপরই ভরসা করছে আওয়ামী লীগ। বিরোধী জোটের ডাকা টানা অবরোধ ও হরতালসহ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড মোকাবিলায় প্রশাসনিক ও আইনি পদক্ষেপ ছাড়া সরকারের পক্ষ থেকে অন্য কোন উদ্যোগ দৃশ্যমান হয়নি এ পর্যন্ত। এমনকি পরিস্থিতিকে নিছক আইনশৃঙ্খলা সমস্যা বলে আসছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতারা। দলের শীর্ষ পর্যায় থেকে হরতাল-অবরোধে ক্ষতির খতিয়ান দেয়া হলেও এটি রাজনৈতিক সমস্যা বলে স্বীকার করা হয়নি। বিরোধী জোটের আন্দোলনকে সন্ত্রাসী নাশকতামূলক কাজ আখ্যা দিয়ে তা দমনে সরকার ও প্রশাসনের উদ্যোগের ওপরই জোর দিয়ে আসছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতারা। সুশীল সমাজ, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও অন্যান্য দল এবং আন্তর্জাতিক মহলের পক্ষ থেকে সঙ্কট সমাধানে রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনা ও সংলাপের তাগিদ দেয়া হলেও এ পর্যন্ত সংলাপ বা আলোচনার পক্ষে সরকারের দৃশ্যমান কোন উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। বরং সংলাপের বিষয়ে নেতিবাচক মনোভাবই দেখানো হচ্ছে সরকারি দলের তরফে। বিরোধী জোটের অবরোধ শুরুর পর বলা হয়েছিল এক সপ্তাহের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার। তবে অবরোধের দুই মাস পার হলেও এখনও সরকারই রাতে যাত্রীবাহী যান চলাচল বন্ধ রেখেছে নির্দেশনা দিয়ে।
স্বাভাবিকের অর্ধেক যানবাহনও চলাচল করছে না মহাসড়কে। ব্যবসা-বাণিজ্যে ক্ষতির পরিমাণ বাড়ছে দিন দিন। কাজ না থাকায় শ্রমিকরা মানবেতর জীবন যাপন করছেন। এমন অবস্থায় সমালোচনা আসছে খোদ সরকার ঘনিষ্ঠ মহল থেকে। গত দুই মাসে রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে মৃত্যুর ঘটনায় কড়া সমালোচনা হচ্ছে আন্তর্জাতিক ও মানবাধিকার সংগঠনের পক্ষ থেকে। এমন অবস্থায় পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে বর্তমান উদ্যোগ কতটা ফল আনবে এবং আর কতদিন এমন অবস্থা চলবে এ প্রশ্ন মানুষের মুখে মুখে। চলমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ক্ষমতাসীন দলের নীতি-নির্ধারক পর্যায়ের কয়েকজন নেতার সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে এখন পর্যন্ত বিরোধী জোটের সঙ্গে আলাপ বা সংলাপের কোন আলোচনা হয়নি দলীয় ফোরামে। এ নিয়ে কোন চিন্তাও করা হচ্ছে না। নেতারা বলছেন, টানা অবরোধ-হরতাল মানুষ বেশিদিন মেনে নেবে না। ইতিমধ্যে তা স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। মানুষ ভয় ভেঙ্গে রাস্তায় নামছে। যানবাহন চলাচল বেড়েছে। কর্মসূচির নামে মানুষকে যানবাহনে পুড়িয়ে মারা হচ্ছে।
এর বিরুদ্ধে এখন সাধারণ মানুষ সোচ্চার হচ্ছে। এভাবে হরতাল-অবরোধ চললে মানুষ একসময় তা পরোয়া করবে না। সব স্বাভাবিক হয়ে আসবে। তবে কবে নাগাদ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে এমন কোন প্রশ্নের উত্তর স্পষ্ট মিলছে না নেতাদের কাছ থেকে। রাজনৈতিক টানাপড়েনের মধ্যে শনিবার ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের সমাবেশের আগে অনেকে আশা করেছিলেন ওই সমাবেশে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য থেকে রাজনৈতিক সঙ্কট সমাধানের কোন ইঙ্গিত আসতে পারে। তবে তেমন কিছু মেলেনি প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে। বরং বিরোধী পক্ষের প্রতি আক্রমণই ছিল তার বক্তব্যজুড়ে। একই দিনে দলের পক্ষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানোর পর আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য তোফায়েল আহমেদ জানিয়েছেন, সারা দুনিয়াতে যারা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করে তাদের সঙ্গে কারও সংলাপ হয় না। দেশে যারা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করছে তাদের সঙ্গে কোন সংলাপ হবে না। তিনি বলেন, ২০১৯ সালের আগে কোন নির্বাচন হবে না। বর্তমান সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগের ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন হবে। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব- উল-আলম হানিফ সম্প্রতি জানিয়েছেন, বিএনপির মতো একটি বড় দলের অনেক কর্মী-সমর্থক রয়েছে। তারা বিভিন্ন নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত। তাই এসব নিয়ন্ত্রণ করতে আরও সময় লাগবে।
দুই রাজনৈকি জোটের মধ্যে সমঝোতার লক্ষ্যে কূটনীতিকরা সরব থাকলেও তাদের উদ্যোগের বিষয়ে ইতিবাচক কোন মনোভাব দেখাচ্ছে না সরকার। সম্প্রতি জাতিসংঘ মহাসচিবের দেয়া চিঠি, সর্বশেষ ১৬ জন কূটনীতিকের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেয়া চিঠির বিষয়ে এখন পর্যন্ত স্পষ্ট কোন বক্তব্য পাওয়া যায়নি সরকারি দলের। তবে জাতিসংঘ মহাসচিবের চিঠির যে জবাব দেয়া হয়েছে তাতে সংলাপের বিষয়ে অনেকটা নেতিবাচক মনোভাবই দেখানো হয়েছে বলে সূত্র দাবি করেছে। এ ছাড়া ১৬ কূটনীতিকের চিঠির বিষয়ে এখন পর্যন্ত কিছুই স্পষ্ট করা হয়নি। তবে দলীয় সূত্র জানিয়েছে, কূটনীতিকদের কাছে সরকারের অবস্থান ইতিমধ্যে স্পষ্ট করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। এরপরও তাদের কোন বক্তব্য বা আলোচনার বিষয় থাকলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পরবর্তীতে এ বিষয়ে তাদের ব্রিফিং করবে।
‘উদ্বিগ্ন’ নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে নেয়া সংলাপ উদ্যোগের বিষয়ে সরকারের নেতিবাচক মনোভাব দেখানোয় ইতিমধ্যে এ উদ্যোগে শ্লথ গতি দেখা যাচ্ছে। যদিও সংলাপের উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন তারা তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাবেন। নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর কাছে সংলাপ ও সমঝোতার উদ্যোগ অহ্বান করে যে চিঠি দেয়া হয়েছিল তারও জবাব মেলেনি এখন পর্যন্ত। উল্টো এ উদ্যোগ নেয়ার পর থেকে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কটু বক্তব্য দেয়া হচ্ছে। এমন অবস্থায় উদ্বেগ প্রকাশ ছাড়া ত্বরিত কোন উদ্যোগের বিষয়ে ভাবছেন না নাগরিক সমাজ। তবে দুই রাজনৈতিক জোট শেষ পর্যন্ত সমঝোতায় আসতে বাধ্য হবে এমনটি ধরে নিয়ে উদ্যোগ অব্যাহত রাখার পক্ষে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা।
এদিকে গত জানুয়ারি থেকে চলমান বিরোধী জোটের আন্দোলনের বিপরীতে আওয়ামী লীগ বা ১৪ দলের পক্ষ থেকে তেমন কোন রাজনৈতিক তৎপরতাও লক্ষ্য করা যায়নি। রাজধানীতে আওয়ামী লীগ সহযোগী সংগঠনের হরতাল এবং অবরোধী বিরোধী কর্মসূচি পালিত হলেও সারা দেশে অনেকটাই নিষ্প্রাণ দলীয় কর্মকাণ্ড। অনেক এলাকায় দলের সংসদ সদস্য ও মন্ত্রীরা নিয়মিত যাচ্ছেন না। এছাড়া হরতাল-অবরোধ শুরুর পরই আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ঘোষণা দেয়া হয়েছিল সারা দেশে সন্ত্রাস প্রতিরোধ কমিটি গঠনের। কিন্তু এ পর্যন্ত হাতেগোনা কয়েকটি জেলায় নামমাত্র কমিটি গঠন করা হলেও খোঁজ নিয়ে জানা গেছে অধিকাংশ জেলা এবং উপজেলায় এ ধরনের কোন কমিটি হয়নি। এমনকি কমিটি গঠনের উদ্যোগও নেই। এমন অবস্থায় আজ ১২টি জেলায় পালন করা হবে সন্ত্রাস ও সহিংসতা বিরোধী পদযাত্রা কর্মসূচি।
চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে দলীয় অবস্থান জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ড. নূহ-উল-আলম লেনিন বলেন, কেউ যদি আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ করে তাহলে সংবিধান ও আইনের মাধ্যমেই তার বিরুদ্ধে যথোচিত ব্যবস্থা গ্রহণ করার কথা বলা হয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে নাগরিকের নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। সেক্ষেত্রে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ বন্ধে প্রচলিত আইনেই ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, বিএনপির আন্দোলন যদি যৌক্তিক ও জনসম্পৃক্ত হতো তাহলে কোন কথা ছিল না। কিন্তু হরতাল-অবরোধের নামে গত দু’মাস ধরে যা হচ্ছে তা কোন আন্দোলন নয়। এর সঙ্গে জনগণের কোন সম্পৃক্ততা নেই। তিনি বলেন, এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য সরকার সর্বতোভাবে চেষ্টা করছে। সরকারের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি ও বেসরকারি বিমান চলাচল ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বলেন, দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য যা প্রয়োজন সরকার তাই করবে। এটি সরকারের দায়িত্ব।
মন্তব্য চালু নেই