প্রভাবশালী নেতাদের জেলায় হয় না আ’লীগের সম্মেলন
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী অধিকাংশ নেতাদের জেলায় সম্মেলন হয় না। কোনো কোনো জেলায় পেরিয়ে গেছে একযুগের বেশি সময়। এ প্রভাবশালী নেতাদের মধ্যে দলীয় সভানেত্রী, দলের সাধারণ সম্পাদকসহ দলের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্যদের জেলাও রয়েছে।
২০১২ সালের ১৯তম কেন্দ্রীয় সম্মেলনের পর ৭৩টি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে ২১ জেলায় এখনও সম্মেলন হয়নি। দলীয় গঠনতন্ত্র অনুযায়ী বর্তমান কেন্দ্রীয় কমিটিরও মেয়াদ শেষ হচ্ছে চলতি বছরের ডিসেম্বরে।
বিভিন্ন জেলা সূত্রে জানা গেছে, অনেক ক্ষেত্রে দলের কেন্দ্রীয় প্রবীণ ও প্রভাবশালী নেতারা জেলা সম্মেলনে নিজ পছন্দের প্রার্থীকে পদ দেওয়ার জন্য জোর চেষ্টা চালান। সভাপতি-সম্পাদক মনোনয়নে তারা হস্তক্ষেপ করেন। যা সম্মেলনের পথে অন্তরায়।
দলটির সাত বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রংপুর বিভাগের ৯টি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে একটি, চট্টগ্রাম বিভাগের ১৪টির মধ্যে চারটি, ঢাকা বিভাগের ২১টির মধ্যে ১১টি, বরিশাল বিভাগের সাতটির মধ্যে তিনটি, সিলেট বিভাগের একটি ও খুলনা বিভাগের একটি সাংগঠনিক জেলার সম্মেলন এখনও হয়নি।
কমিটি গঠন নিয়ে আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রের ৬-এর ক ধারায় বলা হয়েছে : ‘প্রতি তিন বৎসর অন্তর জেলা আওয়ামী লীগসমূহ ও বিভিন্ন মহানগর আওয়ামী লীগ দ্বারা নির্বাচিত নির্দিষ্ট সংখ্যক কাউন্সিলার সমবায়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কাউন্সিল গঠিত হইবে। জেলা আওয়ামী লীগসমূহ এবং ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, বরিশাল ও সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কর্মকর্তা নির্বাচনের উদ্দেশ্যে আহূত ত্রি-বার্ষিক নির্বাচনী সভার নির্দিষ্ট তারিখের মধ্যে তাহাদের ত্রি-বার্ষিক কাউন্সিল সভায় নিজস্ব কর্মকর্তা ও তাহাদের স্ব-স্ব জেলা হইতে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কাউন্সিলের জন্য নির্দিষ্ট সংখ্যক সদস্য নির্বাচন করিয়া তাহাদের পূর্ণ ঠিকানাসহ নামের তালিকা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে অবশ্যই প্রেরণ করিবেন।’
দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জেলা গোপালগঞ্জ আওয়ামী লীগের সর্বশেষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ২০০৪ সালে। এতে সভাপতি নির্বাচিত হন মোহাম্মদ আলী খান আবু মিয়া এবং সাধারণ সম্পাদক চৌধুরী এমদাদুল হক। আবু মিয়া মারা গেলে ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব পান রাজা মিয়া বাটু। মেয়াদ শেষ হওয়া এ কমিটি চলছে ভারপ্রাপ্ত সভাপতিকে দিয়ে।
সম্মেলন বিষয়ে জানতে চাইলে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রাজা মিয়া বাটু বলেন, ‘সম্মেলন কেন হয় না প্রধানমন্ত্রীকে জিজ্ঞেস করুন।’
দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের জেলা কিশোরগঞ্জে সর্বশেষ সম্মেলন হয় ১৯৯৭ সালে। সভাপতি নির্বাচিত হন এ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ, সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক গোলাপ। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হয়ে ক্ষমতায় এলে স্পিকার নির্বাচিত হন আবদুল হামিদ। একই বছর মারা যান সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক গোলাপ। তারপর থেকে দীর্ঘ ছয়বছর ভারপ্রাপ্ত নেতৃত্ব দিয়ে মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি চলছে। এ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার আগে জাতীয় সংসদের স্পিকার হওয়ায় দল থেকে পদত্যাগ করেন।এর পর এ কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন সৈয়দ ওয়াহিদুল ইসলাম। তিনি সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের চাচা। সেখানে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক এ্যাডভোকেট এম এ আফজাল। এরপর গত ১৮ বছর ধরে এ জেলায় কোনো সম্মেলন হয়নি।
এই জেলার ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক এম এ আফজাল বলেন, বিভিন্ন রাজনৈতিক কারণে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়নি। একাধিকবার সম্মেলনের তারিখ হলেও রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে হয়নি। তবে খুব শীঘ্রই হবে।
সংসদ উপনেতা ও দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, কাজী জাফরউল্লাহ ও কেন্দ্রীয় নেতা আবদুর রহমান এমপির নিজ জেলা ফরিদপুরে প্রায় দেড় যুগ সম্মেলন হয় না।
ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের শেষ কাউন্সিল হয় ২০০৫ সালে। এর একবছর পর কাজী জাইনুল আবেদীনকে সভাপতি ও হাসিবুল হাসান লাবলুকে সাধারণ সম্পাদক করে কমিটি ঘোষণা হয়। ২০১০ সালে মারা যান সাধারণ সম্পাদক হাসিবুল হাসান লাবলু। জেলা কমিটির প্রথম যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ মাসুদ হোসেনকে জেলা কমিটির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক করা হয়।
দলের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য ও সাবেক রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের নির্বাচনী এলাকা সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সর্বশেষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯৭ সালে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সিলেট বিভাগের সুনামগঞ্জ জেলার পদপ্রত্যাশী একজন নেতা বলেন, ‘দাদার (সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত) কারণে আমাদের জেলার সম্মেলন হচ্ছে না। আগে উনাকে বলতে হবে সভাপতি ও সম্পাদক কে হবেন? আর যদি তার পছন্দের প্রার্থী তালিকায় না থাকেন তাহলে তিনি বিঘ্ন সৃষ্টি করেন। এবারও একই সমস্যা হচ্ছে।’
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, ‘এগুলো ভুয়া খবর। কেউ ইচ্ছা করে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে।’
সিলেট বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ বলেন, ‘সুনামগঞ্জ ছাড়া আমার বিভাগের সকল জেলার সম্মেলন হয়েছে। অল্প সময়ের মধ্যে সুনামগঞ্জের তারিখ ঘোষণা করা হবে।’
জেলা নেতাদের অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি কিছু জানি না। এমন অভিযোগ আমার কাছে কেউ করেনি।’
ঢাকা বিভাগের কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে চাইলে সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন বলেন, ‘ঢাকা বিভাগ সাংগঠনিক জেলার কলেবর অন্য যে কোনো বিভাগের চেয়ে দ্বিগুণ। এখানে ২১টি জেলা রয়েছে। ইতোমধ্যে ১২টি জেলার সম্মেলন হয়েছে। বাকি জেলার সম্মেলন তাড়াতাড়ি হবে।’
জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার এ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বী মিয়ার গাইবান্ধা জেলায় সর্বশেষ ২০০৩ সালে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
রংপুর বিভাগের সম্মেলন সম্পর্কে জানতে চাইলে সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘গাইবান্ধা জেলা ছাড়া সকল জেলার সম্মেলন হয়েছে। শিগগিরই এ জেলার সম্মেলনের তারিখ জানানো হবে।’
চট্টগাম বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদক বীর বাহাদুর বলেন, ‘কুমিল্লা উত্তর, দক্ষিণ, চাঁদপুর এবং কক্সবাজারে সম্মেলন এখনও হয়নি। খুব তাড়াতাড়ি সম্মেলন হবে।’
বর্তমান পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক, সাবেক আইনমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের আইন বিষয়ক সম্পাদক এ্যাডভোকেট আবদুল মতিন খসরুর জেলা কুমিল্লা। কুমিল্লা জেলায় (উত্তর ও দক্ষিণের) ১৯৯৭ সালে সর্বশেষ সম্মেলন হয়।
সম্মেলন বিষয়ে কুমিল্লা দক্ষিণ জেলার যুগ্ম-আহ্বায়ক এ্যাডভোকেট আফজাল খান বলেন, ‘এ বিষয়ে আপনি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করেন।’
সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ডা. দীপু মনি, ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনামন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার জেলা চাঁদপুরে সর্বশেষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ২০০৫ সালে।
এই জেলার বর্তমান সাধারণ সম্পাদক আবু নঈম পাটোয়ারী দুলাল বলেন, ‘বিভিন্ন সময়ের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের কারণে সম্মেলন হয়নি।’
দলটির উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য ও শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমুর জেলা ঝালকাঠি। ২০০৬ সালে এ জেলায় সর্বশেষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
দলের আরেক উপদেষ্টা ও বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমদের নিজ জেলা ভোলা। ভোলা জেলা আওয়ামী লীগের সর্বশেষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ২০০৫ সালে।
জাতীয় সংসদের চীফ হুইপ আ স ম ফিরোজের পিরোজপুর জেলায় ২০০৩ সালে সর্বশেষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
বরিশাল বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদক আ. ফ. ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, ‘ভোলা, ঝালকাঠি ও পিরোজপুর ছাড়া বাকি জেলার সম্মেলন হয়েছে।’ (এগুলোর সম্মেলন না হওয়ার কারণ ও কবে হবে সে বিষয়ে কিছু বলা হয়নি।)
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সাংগঠনিক সম্পাদক বলেন, ‘আমরা যারা সাংগঠনিক সম্পাদক আছি তারা অনেক জেলা-উপজেলা নেতার চেয়েও বয়সে ছোট। অনেক জেলায় গিয়ে দেখা গেছে অনেক জেলার নেতারা আমাদের বাবা-চাচাদের সঙ্গে রাজনীতি করছেন। তাই অনেক সময় তাদের অনেক কিছু বলা যায় না। এ জন্য প্রাথমিক পর্যায়ে আমরা কাজ করতে গিয়ে সমস্যায় পড়েছিলাম। আর কারণে সম্মেলন করতে দেরি হয়।’ দ্য রিপোর্ট
মন্তব্য চালু নেই