প্রবীণদের নিয়ে বিব্রত আ.লীগ
বিতর্ক যেন পিছু ছাড়ছে না ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের। ৫ জানুয়ারির ‘বিতর্কিত’ নির্বাচনের পর ছাত্রলীগ, যুবলীগের বিতর্কিত কর্মকাণ্ড, এমপি-মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতাদের বেফাঁস মন্তব্যে বেকায়দা পড়তে হচ্ছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগকে।
শেখ হাসিনার টানা দুই মেয়াদের সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে এমপির সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে স্কুলের কোমলমতি শিশুদের রোদে দাঁড়িয়ে রাখা, সভামঞ্চে মন্ত্রীর প্রাকাশ্যে ধূমপান, নিজ দলের বিশ্বাসের বাইরে গিয়ে বই লেখা, হজ্জ ও তাবলীগকে নিয়ে কটূক্তি, ঘুষ প্রধানকে ‘স্পিড মানি’ বলা, ছাত্রলীগকে ‘অবাঞ্ছিত প্রস্তাব’ ও ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের ‘ম্যাকানিজম’ জনসমক্ষে প্রকাশসহ আওয়ামী লীগ নেতারা বেফাঁস মন্তব্যে শেখ হাসিনার সরকারকে আরো বেশি বিতর্কিত ও বেকায়দায় ফেলেছে।
শুধু তাই নয় নিজ দলের নেতাকর্মীদের নৃশংসভাবে হত্যা, প্রকৌশলীকে চড়-থাপ্পড়, প্রকাশ্যে ঘুষ দাবি, সোনার নৌকা উপহার গ্রহণ, ক্রেস্ট নয় ‘ক্যাশ’ চাই একের পর এক বিতর্কিত কর্মকাণ্ড করে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ নেতারা। অবশ্য সবকিছু সামাল দিতে পারলেও মন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকীর হজ্জ ও তাবলীগ নিয়ে কটূক্তি করা ও সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতা একে খন্দকারের লেখা বই ‘১৯৭১: ভেতরে বাইরে’ শেখ হাসিনার সরকারকে বিরোধী পক্ষের কঠোর সমালোচনার মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। আর এ কারণে প্রবীণ রাজনৈতিক লতিফ সিদ্দকীকে মন্ত্রিসভা ও দল থেকে বহিষ্কার করতে হয় আওয়ামী লীগকে। কিন্তু সর্বশেষ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষেদের সদস্য ও প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচটি ইমাম বেফাঁস মন্তব্য করে দলকে আবার ফেলেছেন বিতর্কের মুখে।
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা হোসেন তৌফিক (এইচটি) ইমাম বলেন, ‘নির্বাচনের সময় (৫ জানুয়ারির নির্বাচন) আমি তো প্রত্যেকটি উপজেলায় কথা বলেছি, সব জায়গায় আমাদের যারা রিক্রুটেড, তাদের সঙ্গে কথা বলে, তাদেরকে দিয়ে মোবাইল কোর্ট করিয়ে আমরা নির্বাচন করেছি। তারা আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছে, বুক পেতে দিয়েছে।’ ওই সময় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘তোমাদের লিখিত পরীক্ষায় ভালো করতে হবে। তার পরে ‘ভাইভাটা’ আমরা দেখবো।’
এইচটি ইমামের এমন বক্তব্যের পর দলের ভেতরে-বাইরে নানা গুঞ্জন শুরু হয়। দলের শীর্ষ নেতারা বলছেন, দায়িত্বশীল পদে থেকে এমন বক্তব্যে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে নতুন করে বির্তকের সৃষ্টি হয়েছে। সাবেক মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর মতোই তিনি দল ও সরকারকে বেকায়দায় ফেলেছেন বলে তারা মনে করেন।
এইচটি ইমামের বক্তব্যে ক্ষোভ প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘দায়িত্বশীল পদে থেকে সরকার ও দলের ক্ষতি হয় এমন বক্তব্য দেয়া ঠিক হয়নি।’ গত শুক্রবার রাতে গণভবনে দলের সংসদীয় বোর্ডের সভায় তিনি এ কথা বলেন বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।
এইচটি ইমামের সমালোচনা করে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত তাকে সতর্ক হয়ে কথা বলার পরামর্শ দিয়েছেন। সুরঞ্জিত বলেন, ‘আমাদের একজন উপদেষ্টা পাবলিক সার্ভিস কমিশন সম্পর্কে কথা বলেছেন। কিন্তু পাবলিক সার্ভিস কমিশন একটি স্বাধীন ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। এতে সবারই পরীক্ষা দেয়ার সমান সুযোগ আছে। এ নিয়ে একটু সতর্ক হয়ে কথা বলতে হবে।’
তিনি আরো বলেন, ‘৫ জানুয়ারি নির্বাচনের বিজয় কোনো বাহিনীর ক্রেডিট নয়। এটা মানুষের ক্রেডিট। জনসমর্থনের ওপর ভিত্তি করে সরকার ক্ষমতায়। আমরা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে বিশ্বাস করি বলে আমাদের এ অবস্থা। পুলিশ বাহিনীকে বিভাজন করা যাবে না। পুলিশ রাষ্ট্রের, সকলের।’
এদিকে এইচ টি ইমামের বক্তব্য নিয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘প্রশাসনে দলীয়করণের যে অভিযোগ বিএনপি করে এসেছে এতোদিন তার প্রমাণ এইচটি ইমামের বক্তব্য।’ একই বক্তব্যে নির্বাচনে কারচুপির সত্যতাও দেখিয়েছেন ফখরুল।
আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের বিভিন্ন সূত্র জানায়, এইচটি ইমামের হাত দিয়ে গত ৬ বছরে ছাত্রলীগের একজনেরও চাকরি হয়নি। ৩৩তম বিসিএস পরীক্ষায় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় পদধারী ৩০ থেকে ৩৫ জন নেতা মৌখিক পরীক্ষা দিলেও তারা চাকরি পায়নি। এ জন্য বিক্ষুব্ধ ছাত্রলীগ নেতারা ইমামের বাসায় পর্যন্ত হামলা চালিয়েছিল। ছাত্রলীগ নেতারা বলেন, যখন এইচটি ইমাম প্রধানমন্ত্রীর জনপ্রশাসন উপদেষ্টা ছিলেন তখনো কারো চাকরি দেননি। উল্টো ভিন্ন মতাদর্শের অনেকের চাকরি হয়েছে উপঢৌকনের মাধ্যমে। এখন তার ক্ষমতার লেজ কেটে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী, ইমাম এখন শুধু রাজনৈতিক উপদেষ্টা তাই ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের নিজের আয়ত্তে রাখতেই এ প্রলোভন দেখিয়েছেন।
এর আগে আওয়ামী লীগ সরকারের ২০০৯-২০১৩ মেয়াদের পরিকল্পনামন্ত্রী ও মুক্তিবাহিনীর উপপ্রধান একে খন্দকারের লেখা ‘১৯৭১: ভেতরে বাইরে’ গত ৩ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে তা নিয়ে তুমুল আলোচনা-সমালোচনা চলছে। বইয়ে তিনি লিখেছেন, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু তার ভাষণ শেষ করেছিলেন ‘জয় পাকিস্তান’ বলে। আর সশস্ত্র যুদ্ধের কোনো প্রস্তুতি ছিল না রাজনৈতিক নেতৃত্বের। এ প্রসঙ্গে বিএনপি নেতারা বলছেন, একে খন্দকারের বইয়ের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন বক্তব্যের অসারতা প্রমাণিত হয়েছে।
একে খন্দকারের বই বিতর্ক কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই হজ্জ ও তবলীগ জামাতের মতো অত্যন্ত স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে বেফাঁস মন্তব্য করে হঠাৎ সবকিছু এলোমেলো করে দিলেন আবদুল লতিফ সিদ্দিকী। তিনি বরেন, ‘আমি কিন্তু হজ আর তবলীগ জামাতের ঘোরতর বিরোধী, আমি জামায়াতে ইসলামীরও বিরোধী, তবে তার চেয়েও হজ ও তবলীগ জামাতের বেশি বিরোধী, এই হজে যে কত ম্যানপাওয়ার নষ্ট হয়, হজের জন্য ২০ লাখ লোক আজ সৌদি আরবে গেছে, এদের কোনো কাম নেই, এদের কোনো প্রডাকশন নেই, শুধু রিডাকশন দিচ্ছে, শুধু খাচ্ছে আর দেশের টাকা দিয়ে আসছে। গড়ে যদি বাংলাদেশ থেকে এক লাখ লোক হজে যায়, প্রত্যেকের পাঁচ লাখ টাকা করে পাঁচশ কোটি টাকা খরচ হয়।’
তার এমন মন্তব্যের পর দলের সভাপতিমণ্ডলীর জ্যেষ্ঠ সদস্য সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী তাকে ‘মুখফোড়’ বলে মন্তব্য করেছিলেন। তাকে অব্যাহতি দেয়া হয় বস্ত্র ও পাট এবং তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় থেকে। পরে জরুরি বৈঠক ডেকে তাকে বহিষ্কার করা হয়েছে দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্যপদসহ প্রাথমিক সদস্যপদ থেকেও। ১৯৮১ সালে শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের সভাপতি হওয়ার পর এভাবে দল থেকে বহিষ্কারের ঘটনা এটাই প্রথম।
এছাড়া আরেক প্রবীণ মন্ত্রী অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। তার প্রিয় দু’টি শব্দ গত ৬ বছরে বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এর একটি হচ্ছে ‘বোগাস’ এবং অন্যটি ‘রাবিশ’। হরহামেশাই এ শব্দ দু’টি আউড়িয়ে তিনি বেশ আলোচিত ও সমালোচিতও হয়েছেন। সর্বশেষ বলেছেন ‘স্পিড মানি’ বৈধ। তিনি বলেন, ‘যেটা কোনো কাজের গতি আনে, আমি মনে করি সেটা বৈধ। উন্নত বিশ্বে এটাকে বিভিন্ন নামে বৈধ করে দেয়া হয়েছে।’ কিন্তু কাজের গতি আনতে ঘুষকে বৈধ বলে তিনি স্তব্ধ করে দিয়েছেন দলকে। তার এ বক্তব্যে ইসলামী দলগুলো তার বহিষ্কারও দাবি করেছে। এছাড়া শেয়ারবাজার থেকে যখন লাখ লাখ বিনিয়োগকারী সবকিছু হারিয়ে নিঃস্ব, অনেকেই আত্মহত্যা করছেন, তখন শেয়ারবাজার নিয়ে অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য ‘শেয়ার মার্কেটে কোনো ইনভেস্টর নেই, সব জুয়াড়ি, ফটকাবাজ,’ ‘আই অ্যাম একদম ফেডাপ…।’ বলেও সমালোচিত হন নিজে, সমালোচনার মুখে ফেলেন দলকেও।
এদিকে তৃণমূলের প্রবীন নেতা সমাজকল্যাণমন্ত্রী সৈয়দ মহসিন আলী একটি সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রকাশ্যে ধূমপান করে বেশ সমালোচিত হন। কিন্তু এরপর তিনি থেমে থাকেননি। আরেক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘এরা সবক’টা খবিশ, চরিত্রহীন! স্বাধীন কমিশন হলে পরে দেখে নেবো তোমরা (সাংবাদিকরা) কতটুকু যেতে পারো!’
সাংবাদিকদের উদ্দেশে তিনি পরিষ্কার করে বলেন, ‘আই এম ভেরি ক্লিয়ার, আপনারা রংবাজি করবেন, আর আমি মিষ্টি খাওয়াবো- তা হবে না। আমারও শক্তি আছে। কার কী চরিত্র আমার জানা আছে। ডিএসবি দিয়ে চারিত্রিক ডাটা বের করতে সময় লাগবে না। এরা কেউ জার্নালিজম (সাংবাদিকতা) পড়ে সাংবাদিক হয়নি। একমাত্র আমার মেয়ে জার্নালিজমে এমএ করেছে। আর এরা কলেজে ঘোরাঘুরি করে সাংবাদিক বনে গেছে।’ তার এমন বেফাঁস কথাবার্তায় বিভিন্ন সময় বিব্রত হয়েছে সরকার।
সাংবাদিকদের সম্পর্কে সমাজকল্যাণমন্ত্রীর অশালীন, অশোভন ও অরুচিকর মন্তব্যের কঠোর নিন্দা জানান সাংবাদিক নেতারা। একই সঙ্গে মন্ত্রীকে ‘মানসিক ভারসাম্যহীন’ আখ্যায়িত করে আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে তাকে অপসারণ ও গ্রেপ্তারের দাবি জানানো হয়। পরে অবশ্য মন্ত্রী দুঃখ প্রকাশ ও কষ্টবোধ করেন।
এমন বিতর্কিত বক্তব্য ও কর্মকাণ্ডে বিব্রত এক মন্ত্রিসভার বৈঠকে সমাজকল্যাণমন্ত্রী সৈয়দ মহসিন আলীকে সতর্ক করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও। তিনি বলেন, ‘কী হলো আপনার? মঞ্চে সিগারেট খেলেন, পত্রিকায় আসলো। এরপর সিগারেট ছেড়ে দিলেন। এগুলো তো আপনার জন্য ভালোই।’ এরপর শেখ হাসিনা সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতা নিয়ে নানা বিতর্কিত মন্তব্যের প্রসঙ্গ তুলে সমাজকল্যাণমন্ত্রীকে সতর্ক করে দেন, যাতে তিনি ভবিষ্যতে এ ধরনের কোনো মন্তব্য করে বিতর্ক সৃষ্টি না করেন।
এছাড়া সংসদের চিপ হুইপ ও আওয়ামী লীগের মনোনিত সংসদ সদস্য আ স ম ফিরোজ এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘ক্রেস্ট নয় ‘ক্যাশ’ চাই।’
ফেনী ও নারায়ণগঞ্জে নিজ দলের নেতাকর্মীদের নৃশংসভাবে হত্যার অভিযোগ উঠেছে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য নিজাম হাজারী ও শামীম ওসমানের বিরুদ্ধে। এসব ঘটনায় শেখ হাসিনার সরকারকে বেশ বিতর্কিত করে তুলছে।
মন্তব্য চালু নেই