টাকায় মিলছে হোটেলের সুব্যবস্থা
প্রতিদিন ৪০০ ব্যক্তি কারাগারে
সরকারবিরোধী আন্দোলনকারীদের গ্রেফতার করতে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে চলছে অভিযান। পুলিশের দেওয়া তথ্য মতে, গড়ে প্রতিদিন ৪০০ ব্যক্তিকে নাশকতার দায়ে আটক করা হচ্ছে। তাদের চাপ পড়েছে কারাগারে। ঠাসাঠাসিতে দম বন্ধ অবস্থা কারাবন্দীদের। তবে এই চাপ এখন কারা কর্তৃপক্ষের জন্য শাপেবর হয়েছে। বাণিজ্যের উপাদানে পরিণত হয়েছেন একেকজন কারাবন্দী। অভিযোগ উঠেছে, বন্দীদের থাকা ও খাওয়ার জন্য আবাসিক হোটেলের মতোই টাকা নেওয়া হচ্ছে।
পাঁচ দিন আগে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন জুয়েল (ছদ্মনাম) নামের এক যুবক। গত ৬ জানুয়ারি রাজধানীর মিরপুর এলাকার একটি বাসা থেকে তাকে পুলিশ আটক করে। আদালতে হাজির করার পর তাকে কারাগারে পাঠান হয়। জীবনে প্রথম কারাবন্দী হয়েছেন এ যুবক।
জুয়েল এ প্রতিবেদককে কারাগারের ভেতরের পরিবেশ সম্পর্কে বলেন, ‘দেশের মধ্যে আলাদা একটা জগৎ কারাগার। এখানে নিয়ম-কানুনের কোনো বালাই নেই। কারাগারের প্রতিটি বন্দীকেই টাকা দিতে হয়। আবাসিক হোটেল কক্ষের মতোই কারাগারের সেলগুলো। যে যত টাকা দেয়, সে তত ভাল থাকে। আর সাধারণ বন্দীদের বাধ্যতামূলক আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা দিতে হয়। শুধু তাই নয়, টাকার বিনিময়ে পোশাক-আশাকসহ ভাতের প্লেটও খাওয়ার পর পরিষ্কার করে দেওয়া হয়।’
কারাগারের প্রধান গেট থেকে ভেতরের কক্ষে নেওয়া পর্যন্ত কী হয় তার বর্ণনা দিয়ে জুয়েল বলেন, আদালত থেকে প্রিজন ভ্যানে করে কারাগারের প্রধান ফটকের সামনে সকল বন্দীকে নেওয়া হয়। সেখান থেকে সবাইকে আমদানি নামক একটি সেলে বসানো হয়। এ সময় থেকে তল্লাশীর নামে শুরু হয় শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন (যা প্রকাশ করার মতো নয়)। সেখানে চিফ রাইটারের দু’জন সহযোগী আসেন। তারা আমদানি সেলে আগত বন্দীদের রাজনৈতিক মামলা, পেশাদার অপরাধী ও সাধারণ অপরাধী (পারিবারিক) আলাদা করে দুই পায়ের ওপর ভর করে বসায়। তাদের মধ্যে আবার জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের সদস্যদের আলাদা রাখা হয়। এরপর চিফ রাইটার এসে বন্দীদের উদ্দেশে স্বল্প সময়ের একটি ব্রিফিং দেন। ব্রিফিংয়ে বলেন, ‘জেলখানা একটি ভয়ঙ্কর স্থান। এখানে থাকা, খাওয়া ও ঘুমানোর কোনো ব্যবস্থা নেই। তবে টাকা দিলে সব সম্ভব। ব্রিফিং শেষে চলে যান চিপ রাইটার। তার (চিফ রাইটার) সহযোগী ও দণ্ডপ্রাপ্ত বন্দীরা আগত বন্দীদের কিনে নেন।
জুয়েল আরও বলেন, ‘ব্রিফিংয়ের পরে যারা রাজি হন, তাদের চুক্তি অনুসারে সেলগুলোতে পাঠানো হয়। যারা রাজি হন না, তাদের ইলিশ ফাইলে (কাঁত করে ইলিশ মাছ রাখার মতো) রাখা হয়। কয়েক দিনের জন্য কাউকে কাউকে কাশিমপুর কারাগারে পাঠানো হয়।’
কারা অধিদফতর সূত্র জানায়, সারাদেশের মধ্যে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দীদের চাপ বেশী। এ কারাগারের ধারণক্ষমতা রয়েছে ২ হাজার ৬৮২ জন। এর মধ্যে পুরুষ বন্দীর ধারণক্ষমতা ২ হাজার ৫৪৮ জন ও নারী ১৩৪ জন। গত শুক্রবারের (১৩ ফেব্রুয়ারি) তথ্যানুসারে, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী রয়েছে ৭ হাজার ৫১৫ জন। তাদের মধ্যে সাধারণ বন্দী রয়েছে ৪ হাজার ৬৭২ জন ও সশ্রম, বিনাশ্রম, যাবজ্জীবন ও মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত কয়েদি রয়েছে ২ হাজার ১৫৯ জন। এর বাইরে ভিআইপি ৯ জন, বিদেশী ১৬ জন ও বন্দী মায়ের সঙ্গে ২৫ জন শিশুসহ ৬৮৪ জন অন্যান্য সাধারণ বন্দী রয়েছে।
কেন্দ্রীয় কারাগার সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতরে বন্দীদের সাধারণ সেলে থাকতে আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা দিতে হচ্ছে। এর বাইরে হাসপাতালে থাকতে এক বন্দীকে গুনতে হয় ১৫ থেকে ২৫ হাজার টাকা। এর বাইরে যমুনা ৩, ৪, ১০ ও ১৪ সেলে যেতে বন্দীদের ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা গুনতে হচ্ছে। এ সব সেলে যাওয়ার আগে আমদানি সেল থেকে চুক্তি করা হয়। সে অনুসারে কারাগারের নির্ধারিত ব্যক্তিদের একাধিক মোবাইল নম্বরে বিকাশ এ্যাকাউন্টে টাকা পাঠাতে হয়। এ ছাড়াও কারারক্ষীদের মাধ্যমে ভেতরে টাকা পাঠান যায়। সেক্ষেত্রে এক হাজার টাকা বহন করার জন্য কারারক্ষীদের ২০০ টাকা দিতে হয়। সেল থেকে লেনদেনের টাকা জমা হয় কারাগারের চিফ রাইটার কাওসার আহম্মদের কাছে।
কারা কর্তৃপক্ষের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, চিফ রাইটারের দায়িত্ব কারাগারের ভেতরকার বন্দীদের যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ ও সেগুলো লিপিবদ্ধ করা। আর এই দায়িত্ব দেওয়া হয় বন্দীদের মধ্য থেকে শিক্ষাগত যোগ্যতার ভিত্তিতে যে কোনো একজনকে। জেল সুপারের পরামর্শে এই পদের দায়িত্ব দেন সংশ্লিষ্ট জেলের জেলার।
কারাগার সূত্র জানিয়েছে, সৈকত কবিরকে ১৬ হাজার টাকার বিনিময়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে মেডিকেল ৪-এ বন্দী হিসেবে রাখা হয়। তিনি অসুস্থ না হলেও তাকে হাসপাতালে থাকার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছে। তিনি কুমিল্লার নাঙ্গলকোট থানা যুবলীগের সভাপতি হুমায়ুন কবিরের ছেলে। গত ৩১ জানুয়ারি কাফরুল এলাকা থেকে তাকে আটক করা হয়। তাকে কাফরুল থানার ৫৪ নম্বর মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়েছে।
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের হাসপাতালসহ বাইরের হাসপাতালেও বন্দীদের টাকার বিনিময়ে থাকার সুব্যবস্থা করে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে কারা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। হাসপাতালে ভর্তি তালিকার তথ্যানুসারে, কারাগারসহ রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ২৭১ জন বন্দীকে অসুস্থ দেখিয়ে ভর্তি রাখা হয়েছে। এদের মধ্যে কারা হাসপাতালে ভর্তি বন্দী ২১৮ জন ও বিভিন্ন হাসপাতালে রয়েছেন ৫৩ জন। এর বাইরে হাসপাতালে ভর্তি এ সব বন্দীর মধ্যে মাত্র ৭০ জন অসুস্থ বলে জানা গেছে। বাকিরা টাকার বিনিময়ে অসুস্থ হয়েছেন বলেও জানা গেছে।
এ সব অভিযোগ সম্পর্কে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার নেছার আলম বলেন, কারাগারের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার করছে কিছু ব্যক্তি। বন্দী অবস্থায় তাদের কিছু জানানো হয় না। হাসপাতালে ভর্তি সম্পর্কে বলেন, কারাগারে সহকারী সার্জন রয়েছেন। তাদের দিকনিদের্শনা অনুসারে বন্দীকে হাসপাতালে পাঠান হয়।
তিনি আরও বলেন, বন্দীদের কাছ থেকে কোনো প্রকার টাকা নেওয়া হয় না।
কারা অধিদফতরের তথ্যানুসারে, সারাদেশে মোট ৬৮টি কারাগার রয়েছে। এ সব কারাগারে মোট বন্দী ধারণক্ষমতা ৩৪ হাজার ৪৬০ জন। জানুয়ারি মাসের পরিসংখ্যান অনুসারে, বন্দী রয়েছে ৭১ হাজার ৮০২ জন। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগের ২১টি কারাগারে অনুমোদিত ধারণক্ষমতা ১০ হাজার ৯০২ জন। এদের মধ্যে পুরুষ ১০ হাজার ২৯৫ জন ও নারী ৬০৭ জন। কিন্তু বর্তমানে এই কারাগারগুলোতে ২৫ হাজার ৩৬ জন রয়েছে। রাজশাহী বিভাগের ৮টি কারগারের ১০ হাজার ১০৮ জন বন্দীকে রাখা হয়েছে। এ কারাগারগুলোর ধারণক্ষমতা ৪ হাজার ১৬৪ জন। রংপুর বিভাগের ৮টি কারাগারে ৫ হাজার ১৭৪ জন বন্দী রয়েছে। এই ৮টি কারাগারের ধারণক্ষমতা ৪ হাজার ৪৪৭ জন। চট্টগ্রামের ১১টি কারাগারে ১৫ হাজার ১৪৮ জন কারাবন্দী রয়েছে। এ সব কারাগারের ধারণক্ষমতা ৫ হাজার ৭২৯ জন। এ ছাড়া সিলেটের ৪টি কারাগারের ধারণক্ষমতা ২ হাজার ৩৪৬ জন। বর্তমানে সেখানে ৪ হাজার ৮৫৩ জন বন্দী রয়েছে। খুলনার ১০ কারাগারের ধারণক্ষমতা ৪ হাজার ৭৬০ জন। বর্তমানে রয়েছে ৮ হাজার ৩৪৬ জন। এ ছাড়া বরিশাল ৬টি কারাগারে ধারণক্ষমতা ১ হাজার ২৯৬ জন। বর্তমানে বন্দী রয়েছে ৩ হাজার ১৩৭ জন। দ্য রিপোর্ট
মন্তব্য চালু নেই