রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহতের সংখ্যা বাড়ছেই
প্রতিদিন গড়ে দুইজন নিহত
বিএনপির চলমান আন্দোলনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক সহিংসতায় চলতি বছরের প্রথম ৪০ দিনেই অন্তত ৮০ জন নিহত হন। এই হিসাবে রাজনৈতিক সহিংসতায় প্রতিদিন গড়ে দুইজন করে নিহত হয়েছেন। এদের মধ্যে অধিকাংশই আগুনে পুড়ে মারা গেছেন। যাদের সবাই সাধারণ মানুষ। এই সময়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে অন্তত ১৫ জন সরকারবিরোধী রাজনৈতিক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) দেওয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী, রাজনৈতিক সহিংসতায় গত ১৫ বছরে সারাদেশে নিহতের সংখ্যা আড়াই হাজারের কাছাকাছি।
রাজনৈতিক দলগুলোর আন্দোলন, অবরোধ, হরতাল, নির্বাচনী সহিংসতা ও দলগুলোর মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোন্দলে এ সব মানুষ নিহত হয়েছেন।
আসকের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর ছয় বছরে এই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে এক হাজারে। এর মধ্যে ২০১৩ সালেই এই সংখ্যা ছিল ৫০৭ জন। এটি ছিল ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের আগের বছর। এর আগে নির্বাচনী বছর ২০০১ সালেও রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহত হয়েছিল ৫০০ জন। দুইবারই আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় ছিল।
২০০৯ সালে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার বছর দেশে রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহত হন ৪২ জন। এরপরের বছর ২০১০ সালে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৭৬ জনে। রাজনৈতিক সহিংসতায় ২০১১ সালে ৫৮ ও ২০১২ সালে ৮৪ জন নিহত হলেও, এরপরের বছরই এই সংখ্যা ছয়গুণ বেড়ে দাঁড়ায় ৫০৭ জনে। এরপর ২০১৪ সালে এই সংখ্যা ছিল ১৪৭ জন।
এদিকে চারদলীয় জোট সরকারের পাঁচ বছরে (২০০১-২০০৬) রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহত হয়েছেন সাত শতাধিক ব্যক্তি। তাদের ক্ষমতা ছাড়ার বছর, অর্থাৎ ২০০৬ সালে এই সংখ্যা ছিল ১২০ জন।
চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় আসার প্রথম বছর ২০০২ সালে রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় ৩২০ জনে। এরপরের বছর ২০০৩ সালে ২০৩ জন, ২০০৪ সালে ৫২ জন ও ২০০৫ সালে ৩৪ জন নিহত হয়।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী পরিচালক সুলতানা কামাল ২০১৪ সালের মানবাধিকার পর্যালোচনা প্রতিবেদন প্রকাশকালে বলেন, ‘দেশে এক বছরে ৬৬৮টি রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা ঘটে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রথম ছয় দিনেই রাজনৈতিক সহিংসতায় ২৪ জন নিহত হয়েছেন।’
তিনি দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি উদ্বেগজনক জানিয়ে বলেন, ‘দেশে বিচারহীনতার সংস্কৃতি বিরাজ করছে। প্রতিটি সরকারই রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে সরকারি বাহিনীতে পরিণত করে রাজনৈতিক কাজে ব্যবহার করে। ফলে রাজনৈতিক সংঘাত আরও বেড়ে যায়।’
তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলোর সহনশীলতার অভাবেই রাজনৈতিক সংঘাত সৃষ্টি হয়।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের চেয়ারম্যান অধ্যাপক নুরুল আমিন বেপারি বলেন, ‘গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে দেশের রাজনৈতিক সহিংসতারোধ করা যাচ্ছে না। বিশেষ করে, গণতন্ত্রের কথা বলে ক্ষমতায় আসার পর রাজনৈতিক দলগুলো কর্তৃত্ববাদী সরকার প্রতিষ্ঠা করতে চায়। অপরদিকে, বিরোধীপক্ষ আবার গণতন্ত্র রক্ষার জন্য আন্দোলনে নামে। ফলে রাজনৈতিক সংঘাত সৃষ্টি হয়।’
রাজনৈতিক সহিংসতার অন্যতম কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, ‘দেশে রাজনৈতিক দলের নেতাদের মধ্যে আদর্শের অভাব ও পরমসহিষ্ণুতার অভাবের কারণেই দেশে রাজনৈতিক সহিংসতার সৃষ্টি হয়। এই সহিংসতায় সাধারণ মানুষসহ অনেক মানুষ প্রাণ হারায়।’
সবচেয়ে কম নিহত হয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছর
রাজনৈতিক সহিংসতায় সবচেয়ে কম ব্যক্তি নিহত হয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছর (২০০৭-০৮)। এই দুই বছরে রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহত হয়েছে ১১ জন। এর মধ্যে ২০০৭ সালে সাতজন এবং ২০০৮ সালে চারজন নিহত হয়েছে।
চলতি বছরে রাজনৈতিক সহিংসতা
চলতি বছর ৫ জানুয়ারিকে কেন্দ্র করে সারাদেশেই ছড়িয়ে পড়েছে সহিংসতা। সরকার ও বিএনপির অনড় অবস্থানের কারণে সহিংসতার শিকার হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। এই সময়ে পেট্রোলবোমা ও বাসে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় নিহত হয়েছে অর্ধশত ব্যক্তি। অন্যান্য ঘটনায় নিহত হয়েছে আরও অন্তত ৩০ ব্যক্তি।
শুধু শুক্রবার রাতেই গাইবান্ধায় এবং বরিশালে দুর্বৃত্তদের পেট্রোলবোমায় নয়জন নিহত হয়েছেন। অগ্নিদগ্ধ হয়েছে আরও অন্তত ৩০ ব্যক্তি। এদের মধ্যে কেউ রিকশাচালক, কেউ দিনমুজর, কেউ পোশাককর্মী।
এর আগে ৩ ফেব্রুয়ারি ভোরে কুমিল্লায় একটি নাইটকোচে ছোড়া পেট্রোলবোমায় আটজন নিহত হন। অগ্নিদগ্ধ হয়েছেন আরও অন্তত ২৩ যাত্রী। গত ২৩ জানুয়ারি রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে একটি বাসে পেট্রোলবোমা নিক্ষেপের ঘটনায় ২৯ জন অগ্নিদগ্ধ হয়েছেন। এর মধ্যে নূর আলম নামে এক যাত্রী ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিনিয়তই ঘটছে পেট্রোলবোমা নিক্ষেপ ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা।
অবরোধ ও হরতালে শুধু ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছে নয়জন। চিকিৎসা নিয়ে ফিরে গেছেন আরও অন্তত ৬০ জন। এখন চিকিৎসাধীন আছেন ৬৪ জন।
বাড়ছে ক্রসফায়ার ও নিখোঁজ
চলতি বছরের প্রথম ৪০ দিনে সারাদেশে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’র নামে ক্রসফায়ারে অন্তত ২৬ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতা রয়েছে নয়জন।
এই সময়ে রাজধানীতে কথিত বন্দুকযুদ্ধের নামে ক্রসফায়ারে নিহত হন ১০ জন। এর মধ্যে চারজন সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতা।
এর বাইরে আরও চারজনকে পুলিশ পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে বলে অভিযোগ করেছে নিহতদের পরিবার। এই সময়ের মধ্যে রাজধানীতে রূপনগর থানা এলাকা থেকে এক ছাত্রদল নেতার গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। পরিবার বলছে, পুলিশ আটক করার পর তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে। এ ছাড়া চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও যশোরে পুলিশ ও র্যাবের হেফাজতে সড়ক দুর্ঘটনায় তিনজন নিহত হন। এই তিনজনকেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে বলে পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হয়। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে জানান, গত ২৬ ডিসেম্বর থেকে ২৭ জানুয়ারি পর্যন্ত মাত্র এক মাসে সারাদেশে প্রায় তিন শ’ রাজনৈতিক নেতাকর্মী খুন ও গুম হয়েছেন।
ছাত্রদল ও শিবির দাবি করেছে, চলতি বছর অন্তত ৩০ জন কর্মীকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আটক করার পর আর খোঁজ মিলছে না। বিএনপির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে, রাষ্ট্রীয় বাহিনী দিয়ে বিরোধী দলকে দমন করার চেষ্টা করছে।
স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সরকারের বিরুদ্ধে এই ধরনের অভিযোগ ঠিক নয়। সরকারবিরোধী আন্দোলন দমন করা উদ্দেশ্য নয়। আন্দোলনের নামে যারা নাশকতা করছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করছে।’ দ্য রিপোর্ট
মন্তব্য চালু নেই