পেট্রল বোমায় নিহত এক কিশোরীর চিঠি
মাইশা নাইমা তাসনিন ৩ ফেব্রুয়রি ২০১৫ বাবা নুরুজ্জামান পভলু ও মা মাফরুহা বেগমের সঙ্গে কক্সবাজার থেকে যশোর ফিরছিলেন। ভোররাতে কুমিল্লায় তাদের বাসটিতে পেট্রল বোমা ছোঁড়ে অবরোধকারীরা। পভলু প্রথমে জানালা দিয়ে মাফরুহা বেগমকে ছুঁড়ে ফেলতে পারলেও মেয়ে মাইশা এবং নিজে জীবন্ত পুড়ে মৃত্যুবরণ করেন।
[লেখাটি কাল্পনিক। কাউকে আঘাত করার জন্য নয়। মাইশার পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা ]
প্রিয় ম্যাডাম,
আমার এই পা দুটিতে যখন আগুন লাগে তার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত ঘুমিয়ে ছিলাম। ঘুম ভাঙলো আগুনের ছ্যাঁকায়। পায়ের মোজা খুলতে খুলতেই আমার সাড়া শরীর জ্বলে উঠলো। প্রিয় ম্যাডাম, আপনি কি জানেন কী অপার্থিব কষ্ট ও যন্ত্রণা তখন আমার সারা শরীর জুড়ে? আমার শরীর পোড়া গন্ধ তখন চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। অদূরেই দেখি বাবা সারা শরীরে আগুন নিয়ে ছুটে আসছেন আমার দিকে- সন্তানের গায়ের আগুন নেভাতে। কিন্তু সর্বনাশা আগুন তারও সর্বস্ব গ্রাস করে নিয়েছে। আমি চিৎকার করছি ‘বাবা বাঁচাও, বাবা বাঁচাও’। বাবা জ্বলতে জ্বলতে দাঁড়ানো থেকে বসে পড়লেন। তার গতি শ্লথ হয়ে গেলো। বাসের মাঝখানের জায়গাটি অপ্রশস্ত। এই পথ ধরেই তিনি হামাগুড়ি দিয়ে আমার দিকে আস্তে আস্তে এগিয়ে আসতে থাকলেন।
প্রিয় আপসহীন ম্যাডাম,
আপনি কি ‘ঘোস্ট রাইডার’ সিনেমাটি দেখেছেন? আপনি কি দেখেছেন সন্তানকে রক্ষা করতে সারা শরীরে আগুন লাগা এক বাবা ঘোস্ট রাইডারের মতো আমার দিকে এগিয়ে আসছেন। দেখেছেন কি কখনও জীবিত একজন মানুষ জ্বলছে আর তার সারা শরীর থেকে মাংস খসে পড়ছে? দেখেছেন কখনও?
বাবা আমার দিকে আসছেন ক্ষীণ গলায় আমাকে কী যেন বলার চেষ্টা করছেন। কিন্তু আগুন বাবার মুখের সে কথাগুলো কেড়ে নিচ্ছে। আমি চিৎকার করছি।
আগুন আমার পা থেকে ওপরের দিকে উঠে আসছে। আমার চোখের সামনে বাবা পুড়ছেন। আমি পুড়ছি।
অদূরে চেয়ে দেখি আমার মা বাসের বাইরে চিৎকার করছেন আর তাকে ধরে রেখেছে কয়েকজন। সবাই যেন আমাদের পুড়ে যাওয়াটা নিয়তি হিসেবে মেনে নিয়েছে। আমার সামনেই বাবার মাথা আগুনে গ্রাস করে নিল। মুখ পুড়ে মাংস খসে পড়লো বাসের মেঝেতে।
এবার বাবার খুলি পুড়ছে। চোখ পুড়ছে। চোখগুলো থেকে কেমন যেনো আঁঠালো কালো কালো রস গড়িয়ে পরলো। মাথার খুলিটা যেনো কয়লার আগুনে লাল হয়ে যাওয়া লোহার পিণ্ড। বাবার হাত থেকে সব মাংস পুড়ে খসে পরলো। এখন শুধুই কংকাল। এটাকেও রেহাই দিলো না আগুন। এবার হাড়গোড় ও জ্বলছে আমার বাবার।
শেষবারের মতো বাবা আমার পায়ের কাছে এসে আছড়ে পড়লেন। বাবা আর পারলেন না। আপনার ফেসবুকের স্ট্যাটাস মেনে নিয়েই তিনি তার মানবীয় সব রূপ হারিয়ে একটি কাঁদার দলার মতো আমার পায়ের কাছে ছোট একটি পিণ্ডকায় বলের মতো আছড়ে পড়লেন।
ম্যাডাম, আপনি কি জানেন মানুষকে পোড়ালে ছোট হয়ে যায়? হাত পা মাথা এক জায়গায় হয়ে যায়। আমার এই ছোট্ট জীবনে এ এক নিদারুণ নিষ্ঠুর অভিজ্ঞতা। বাসের বাইরে মা তখনও আহাজারি করছেন। দিশেহারা হয়ে বুক চাপড়াচ্ছেন। আগুনের লেলিহান শিখা আর কালো ধোঁয়ার মাঝেও আমি এবার চিৎকার করে মাকে ডাকছি ‘মা আমাকে বাঁচাও।’ মা ছুটে আসতে চাইলেও তাকে আটকে রাখছে কয়েকজন।
আগুন আমার বুক পর্যন্ত উঠে এসেছে। এতক্ষণ আমি বাবার সাহায্যের অপেক্ষায় ছিলাম। এখন বাবা একটা পোড়া মাংসের দলা, মাঝখানে উঁকি-ঝুকি মারছে কিছু হাড়গোড়। আমার এত সুন্দর বাবা আজ এক কুৎসিত জড় থকথকে আঁঠালো পোড়া মাংস পিণ্ড।
জ্বলছে আমার সারা শরীর। এখন আমার শরীরে আর কোন যন্ত্রণা নেই। আমি ভাবছি কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে বাবার স্বপ্নের কথাগুলো। বলছিলেন ‘মা এটা হচ্ছে পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত। অপার সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও আমরা এর সদ্বব্যবহার করতে পারিনি। শুধু রাজনীতির হানাহানি আমাদের পিছিয়ে দিচ্ছে বারবার। সাগর পাড়ে বসে আমি শপথ নিয়েছিলাম আমিও রাজনীতি করবো। এই দেশ বদলাতে হলে সবার আগে রাজনীতির ত্রুটিকে বদলাতে হবে।
আগুন আমার মাথা পর্যন্ত উঠে এসেছে। জ্বলছে দাউ দাউ করে। আমার পোড়া চামড়া খসে পড়ছে, কোথাও কোথাও মাংসপিণ্ডও। এগুলো নিয়ে আর ভাববার সময় নেই। মনে পড়ছে বাবার কত স্বপ্ন ছিলো আমাকে নিয়ে। সেগুলো সব আমাকে পূরণ করতে হবে।
আমার হাতের দুটি আঙ্গুল জ্বলতে জ্বলতেই খসে পড়ে গেলো পায়ের কাছে। পা মানে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাওয়া একটি কাঠ কয়লার খণ্ড। আমার হাসি পেল। নিজের মাংস পোড়া গন্ধ নিজেই সহ্য করতে পারছি না। প্রচণ্ড হাসি পাচ্ছে, চোখে রাজ্যের ঘুমে জড়িয়ে আসছে।
প্রিয় নেত্রী,
আপনার বড় সন্তান তারেক রহমান আর আমার বাবা একই বয়সের। একবার ভাবুন তো এই বয়সে তারেক রহমানের দুই সন্তান জ্বলছে সঙ্গে তারেকও। আর বাসের বাইরে বসে আপনি আহাজারি করছেন। বাতাসে ভাসছে আপনার প্রাণপ্রিয় সন্তান ও নাতনিদের মাংস পোড়া উৎকট গন্ধ। আপনি সহ্য করতে পারছেন না সেই গন্ধ।
কতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলাম জানি না। মায়ের চিৎকারে আমার তন্দ্রা ছুটে গেলো। মা…..আমাকে ক্ষমা করে দিও। আমার বায়নাতেই তোমরা আমাকে কক্সবাজার দেখাতে নিয়ে এসেছিলে….. আমি আর কোনোদিন কক্সবাজার দেখতে চাইবো না।
মা চিৎকার করছেন- কেউ কি আছো আমার মেয়েটাকে বাঁচাও…..
বুকের ভেতর হু হু করে উঠলো। কান্নাও এলো, কিন্তু সর্বনাশা আগুন সেই জলটুকুও কেড়ে নিলো।
এবার আমার মাথার মগজ পুড়ছে। গলে বেরিয়ে আসছে চোখ মুখ ও নাকের কোটর দিয়ে। আমার কেমন যেন লাগছে। মনে হয় হাওয়ায় ভাসছি। এটাকেই মৃত্যু বলে তা হলে। কেমন যেন ভারসাম্যহীন হাওয়াই বেলুনের মতো লাগছে। সব কিছুই কেমন যেনো অন্যরকম লাগছে। আমি আস্তে আস্তে হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছি……
ভালো থাকুক বাংলাদেশ।
ইতি
মাইশা নাইমা তাসনিন
২০০১-২০১৫
মন্তব্য চালু নেই