ঢাবির নিহত ছাত্র সুজনের মায়ের আহাজারি

‘পুলিশ আমাদের সব শেষ করে দিল’

পুলিশের গুলিতে নিহত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সুজন মৃধার (২৩) দাফন সম্পন্ন হয়েছে। আজ শুক্রবার বিকেলে মাদারীপুরের সদর উপজেলার ধুরাইল ইউনিয়নের দক্ষিণ বিরাঙ্গল গ্রামে নিজ বাড়ির কবরস্থানে তাঁর দাফন সম্পন্ন হয়েছে।

এদিকে জানাজায় অংশ নেওয়া সুজনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠীরা এ ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করেছেন। অন্যথায় কঠোর কর্মসূচির হুমকি দিয়েছেন তাঁরা।

এ ঘটনার কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী জানান, ধুরাইল ইউনিয়নের দক্ষিণ বিরঙ্গল নূরানী মাদ্রাসা কেন্দ্রে ভোট গণনা শেষে সন্ধ্যায় প্রিসাইডিং কর্মকর্তা আয়ুব আলীকে জয়ী ঘোষণা করেন। এ ফলাফল নিয়ে সুজনের চাচাতো দাদা সদস্য প্রার্থী আবদুল মোতালেব মৃধা সন্দেহ প্রকাশ করেন এবং প্রিসাইডিং কর্মকর্তার কাছে পুনরায় গণনার দাবি করেন। এতে দুই পক্ষের মধ্যে বাগবিতণ্ডার সৃষ্টি হয়। এ সময় পুলিশ সুজনকে লক্ষ্য করে গুলি করে। এতে সুজন আহত হলে তাঁকে মাদারীপুর সদর হাসপাতালে আনা হয়। রাত ৮টার দিকে তিনি মারা যান। সংঘর্ষের সময় আহাদুজ্জামান মৃধা ও কাজল আকন নামের দুই যুবক গুলিবিদ্ধ হয়। রাতে তাঁদের ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, ‘সুজন ও আমরা পাঁচ-ছয়জন বন্ধু মিলে ফলাফল শোনার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। কেন্দ্রের বাইরে দাঁড়িয়ে আমরা গল্প করছিলাম। এর মধ্যেই চিৎকার-চেঁচামেচির আওয়াজ পেয়ে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি। পুলিশ আমাদের গতিরোধ করে গুলি ছুড়তে থাকে। সঙ্গে সঙ্গে সুজনসহ কয়েকজন মাটিতে পড়ে যায়। সুজনকে হাসপাতালে নেওয়া হলে সে মারা যায়।’

সুজন মিঠাপুর এলএন উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও নটর ডেম কলেজে এইচএসসিতে জিপিএ ৫ পেয়ে পাস করেন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগে ভর্তি হন। সুজন বাবা-মায়ের বড় সন্তান। সুজনের বাবা বাচ্চু মৃধা অটোরিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। বাবা-মায়ের স্বপ্ন ছিল সুজন লেখাপড়া শেষ করে বড় কোনো চাকরি করে সংসারের দুঃখ ঘোচাবেন। সেই স্বপ্ন এক নিমিষেই ধ্বংস হয়ে গেল পুলিশের গুলিতে।

আজ সুজনের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, মা শান্তা বেগম ছেলের শোকে বিলাপ করতে করতে বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন। বাবাও প্রায় জ্ঞানহারা।

বিলাপ করে সুজনের মা বলেন, ‘আমার সোনা মানিক কখনো কোনোদিন কারো সঙ্গে ঝগড়া বিবাদ করেনি। কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গেও জড়িত না। ওর বাবা অটোরিকশা চালিয়ে সংসার চালাতেন। আমাদের স্বপ্ন ছিল লেখাপড়া শেষ করে সুজন অনেক বড় চাকরি করবে। কিন্তু আমাদের আর কিচ্ছু রইল না। পুলিশ আমাদের সব শেষ করে দিল।’

বাচ্চু মৃধা বলেন, ‘ভোট দেওয়ার জন্য ভোটের আগের দিন সুজন গ্রামে আসে। আমার ছেলেটা কারো চোখের দিকে তাকিয়ে কোনোদিন কথা বলেনি। ওর মতো নিরীহ মানুষ এ গ্রামে নেই। পুলিশ কেন আমার ছেলেকে গুলি করল। কেন তাকে মেরে ফেলল? তাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল আমাদের। বাড়িতে আসলে সুজন বলত, বাবা আর বেশিদিন তোমাদের কষ্ট করতে হবে না। আমি ভালো চাকরি পেয়ে যাব, তখন তোমাদের সব কষ্ট দূর হয়ে যাবে।’

নিহত সুজনের সহপাঠী বিপ্লব মজুমদার বলেন, ‘একজন মেধাবী বন্ধুকে হারিয়ে আমরা মর্মাহত। এই রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসকে আমরা ঘৃণা করি। এ অঞ্চলে সুজনের মতো মেধাবী ছাত্র ছিল না। সুজন বেঁচে থাকলে অনেক বড় কিছু হতো।’

সুজনের চাচা আলমগীর মৃধা বলেন, ‘নির্বাচনের দিন সন্ধ্যায় আমার চোখের সামনে উপপরিদর্শক (এসআই) এনামুলের নির্দেশে কনস্টেবল মাসুদ গুলি ছোড়ে। সেই গুলিতে সুজন ঘটনাস্থলেই নিহত হয়েছে।’

মাদারীপুর সদর হাসপাতালের চিকিৎসা কর্মকর্তা ডা. অখিল সরকার বলেন, ‘সুজনের গলায় ও পিঠের দিকে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে। প্রাথমিকভাবে আঘাতটি গুলির চিহ্ন বলে মনে হচ্ছে।’

তবে মাদারীপুরের সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) সার্কেল মো. মনিরুজ্জামান ফকির বলেন, ‘আমরা এখনো ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন হাতে পাইনি। পুলিশের গুলিতেই সুজন নিহত হয়েছেন কি না, এ বিষয়ে আমরা এখনো নিশ্চিত নই।’ এ ঘটনায় মামলা হয়েছে বলেও জানান তিনি।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ধুরাইল ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের দক্ষিণ বিরঙ্গল মাদ্রাসা কেন্দ্রে গতকাল সন্ধ্যায় ফলাফল ঘোষণা করার সময় দুই সদস্য প্রার্থী আব্দুল মোতালেব মৃধা ও আয়ুব আলী ফকিরের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়। এ সময় পুলিশের গুলিতে সুজন নিহত হন।



মন্তব্য চালু নেই